শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

১৬৪ ধারা জবানবন্দী : তিন কারনে হত্যার শিকার প্রবীর

প্রকাশিত: ১৫ জুলাই ২০১৮  

শিমুল মোহাম্মদ (যুগের চিন্তা ২৪) : স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষ হত্যার ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দী দিয়েছে হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথ। এর মধ্য দিয়েই  অবশেষে উন্মোচিত হলো চাঞ্চল্যকর প্রবীর হত্যার রহস্য। হত্যার কারন হিসেবে উঠে এসেছে পিন্টুর অর্থ আত্মসাৎ, ‘প্রবীরের হাতে পিন্টু প্রতারিত হতে পারে’ তৃতীয় পক্ষের এমন ইন্দন এবং প্রবীরের রুঢ় আচরণসহ নানান কারনে প্রবীরের প্রতি পিন্টুর জন্ম নেয়া ক্ষোভ।

 

এমন সব কারনেই অতীতে আরো তিনবার হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ ঈদুল ফিতরের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে প্রবীরকে হত্যা করে পিন্টু। নিজ ভাড়া বাসায় একাই হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছে সে। প্রবীর হত্যার দায় স্বীকারের পূর্ব পর্যন্ত বাপন জানতোই না প্রবীরকে খুন করা হয়েছে।

 

শনিবার দুপুর ২ টা থেকে রাত সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দেয় পিন্টু দেবনাথ। জবানবন্দীর পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চত করেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই মফিজুল ইসলাম।

 

ডিবির সংবাদ সম্মেলন নিয়ে প্রবীরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হলে প্রবীরের ছোটভাই বিপ্লব ঘোষ যুগের চিন্তা ২৪কে বলেন, আমরা প্রশাসনের উপর আস্থা রাখছি। তাদের কাছে একটাই চাওয়া আসামীদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত করা হয়।  

 

এদিকে জবানবন্দী দেয়ার আগে শনিবার সকালে আমলাপাড়ায় পিন্টুর মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পিন্টুকে নিয়ে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ।

 

সেখান থেকে নগদ ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ৫ ভরি ১০ আনা ৩ রতি স্বর্ণ ও বন্ধকী স্বর্ণের একটি হিসেব খাতা জব্দ করে পুলিশ। সে সময় কালীরবাজার স্বর্ণপট্টি এলাকার ব্যবসায়িদের উপস্থিতিতে পিন্টুর দোকানটিকে সীলগালা করে দেয়া হয়। তাছাড়াও পিন্টুর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় পিন্টুর ব্যবহৃত রক্ত মাখা বুকের বেল্ট যা তাকে বাইপাস সার্জারীর পর ব্যবহার করতে দেয়া হয়।

 

তিন কারনে হত্যাকান্ড :

প্রবীরকে হত্যার কারন হিসেবে পিন্টুর দেয়া জবানবন্দীতে উঠে এসছে হত্যার তিন কারন। পিন্টু বলছে, পিন্টু ও প্রবীরের বন্ধকী সোনার ব্যবসায় পিন্টুকে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার বন্ধকী সোনা দিয়েছিলো প্রবীর। কথা ছিলো সেই সোনা ফেরত দিয়ে টাকা ক্যাশ করবে সে। কিন্তু সেই স্বর্ণালঙ্কারগুলো আত্মসাৎ করে পিন্টু। সোনা গুলো ভেঙ্গে বিক্রী করে ফেলে সে। সেটা জানতে পারে প্রবীর। 

 

এছাড়াও প্রবীরের কাছ থেকে পিন্টু প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ধার নেয়। প্রবীর ধারের টাকা ফেরত চেয়ে চাপ প্রয়োগ করে পিন্টুকে। তবে সে টাকা ফেরত পায়নি প্রবীর। সব কিছু মিলিয়ে পিন্টু ও প্রবীরের মধ্যে চলতে থাকে নীরব মনো মালিন্য। সঙ্গে যুক্ত হয় ২ বছর আগে ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে পিন্টুকে প্রবীরের চড় মারা ঘটনায় পুঞ্জিভুত ক্ষোভ ও নানান সময়ে পিন্টুর সঙ্গে করা প্রবীরের রুঢ় আচরণ।

 

পিন্টু যখন নানান কারনে প্রবীরের উপর ক্ষুব্ধ ঠিক তখনই প্রবীরের সঙ্গে পিন্টুর সম্পর্ক বিষিয়ে তুলতে কাজ করে তৃতীয় একটি পক্ষ। তৃতীয় পক্ষের সেই ব্যাক্তি পিন্টুকে জানায়, প্রবীর প্রকৃত পক্ষে পিন্টুর বন্ধু নয়। কারন হিসেবে বলে, যে কোন সময় প্রবীর পিন্টুকে নারী কেলেঙ্কারীকে ফাঁসিয়ে কৌশলে পিন্টুর দোকান হাতিয়ে নিতে পারে। প্রমাণ দেখাতে সেই ব্যক্তি টেলিফোন করে প্রবীরের কাছে। লাউড স্পীকারে পিন্টুকে শোনায় প্রবীর তার সর্ম্পকে কী ধারণা পোষণ করে। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে প্রবীর বলতে থাকে, পিন্টুতো খারাপ।

 

ওরে মেয়ে মানুষের সঙ্গে উলঙ্গ করে ছবি তুলে ডিবি পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবো। তৃতীয় পক্ষের সেই ব্যাক্তি পিন্টুকে প্ররোচনা দেয়, ডিবির কাছে ধরিয়ে দিলে তোমাকে ছাড়িয়ে আনতে যে টাকা লাগবে  সে টাকার বিনিময়ে প্রবীর তোমার দোকান কিনে নেবে। তখনই পিন্টুর মনে দোকান হারানোর ভয় কাজ করতে থাকে।

 

প্রবীরের উপর নজরদারি এবং পিন্টু সম্পর্কে প্রবীরের ধারণা জানানোর বিনিময়ে তৃতীয় পক্ষের সে প্ররোচনা দাতাকে কয়েক দফায় ৩ লাখ টাকা দেয় পিন্টু।

হত্যার বর্ণনা:

১৮ জুন রাত ১০ টা নাগাদ বিয়ার খাওয়ানোর কথা বলে প্রবীরকে ফোন করে ডেকে আনে পিন্টু। পরে নিয়ে যায় নিজের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে। তবে সেখানে বিয়ার খায়নি তারা। প্রবীরকে স্প্রাইট ও বিস্কুট খেতে দিয়ে ফুটবল খেলা দেখে দুজন মিলে।

 

প্রবীর যখন খেলা দেখছে তখনই রান্না ঘর থেকে চাপাতি নিয়ে এসে প্রবীরকে পেছন থেকে ঘাড়ে আঘাত করে পিন্টু।  জীবন বাঁচাতে পিন্টুর বুকে পা দিয়ে আঘাত করে প্রবীর। তারপর উপর্যোপরি আরো ২-৩ টি কোপ দেয় প্রবীরকে। এক পর্যায়ে প্রবীর গোঙ্গাতে থাকলে পিন্টু প্রবীরের বুকের উপর উঠে মুখে বালিশ চাপা দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত হলে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে প্রবীরের দেহকে ৭ খন্ডে বিভক্ত করে পিন্টু।

 

আগে থেকে কিনে রাখা বাজারের ৪টি ব্যাগে প্রবীরের খন্ডিত দেহগুলো ভরে ফেলে সে।  আর অপর একটি ব্যাগে বালিশ ও বিছানার চাদর। ঘরের রক্ত ধুয়ে মুছে নিজে গোসল করে পরিস্কার হয়ে নেয় পিন্টু।

 

রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে পিন্টু তার বাসার সেপটিক ট্যাঙ্কে লাশ ভর্তি ব্যাগ গুলো ফেলতে শুরু করে। তিনটি ব্যাগ ফেলার পর  চতুর্থ ব্যাগটি ফেলতে গেলে সেটির স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাসার পাশের একটি নর্দমার ড্রেনে ফেলা হয় সে ব্যাগ। ওই ব্যাগটিতে প্রবীরের খন্ডিত পা দু’টি ছিল। বাসার সামনের নর্দমান ভাগাড়ে ফেলা হয় হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি ও প্রবীরের জুতা। তবে ঘরেই ছিলো প্রবীরে হাত ঘরি, রুমাল, পেন্ট, শার্ট, সেন্ডু গেঞ্জি, জাঙ্গিয়। যা পরবর্তীতে পিন্টুর বাসা থেকে জব্দ করে পুলিশ। রক্তমাখা বালিশসহ  বিছানার কাপড় ফেলে আসে চারার গোপ আলুর ঘাট শীতলক্ষা নদীতে।  

 

লাশ উদ্ধারের আগে বাপন জানতোই না প্রবীর খুন হয়েছে:

এদিকে প্রবীর হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার পিন্টুর সহযোগি বাপন ভৌমিক প্রবীরের লাশ উদ্ধারের আগে প্রবীরের খুন হওয়ার বিষয়টি জানতোই না বলে জানায় ডিবি পুলিশ।  পিন্টু তাকে বলেছিল প্রবীর ভারতে পালিয়ে গেছে। কিন্তু ফোনটি তার কাছে রেখে গেছে।

 

রিমান্ডে বাপন পুলিশকে জানায়, ১৮ তারিখ নিখোঁজ হবার পর ১৯ তারিখ সকালে প্রবীরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানাতে পিন্টুকে ফোন করে বাপন। বাপন টেলিফোনে পিন্টুকে বিষয়টি জানালে পিন্টু বলে আগে থেকেই বিষয়টি জানে সে। সেদিন বাপন ঢাকার বসুন্ধরায় চলে যায় তার কাজে।

 

দুপুর সাড়ে তিনটায় বাপনকে ফোন করে পিন্টু। বলে, আমার শরীরটা খারাপ, তুই রাতে আমার সঙ্গে থাকিস। রাতে ফিরে এসে পিন্টুর ফ্ল্যাটে যায় বাপন। সেখানে গিয়ে বাপন দেখে পিন্টুর ঘরে নতুন চাদর, বালিশ। রাতেই এক সময় কান্না জড়িত কণ্ঠে পিন্টু বাপনকে বলে, আমি বিপদে পড়েছি ভাই, আমাকে বাঁচা।

 

বিপদের কারন জানতে চাইলে পিন্টু তাকে জানায়, প্রবীর ভারতে পালিয়ে গেছে। কিন্তু ফোন রেখে গেছে তার কাছে। এখন এটা নিয়ে থানা পুলিশ হচ্ছে। মোবাইল তার কাছে থাকাটা ঝুকিপূর্ণ। সুতরাং এই মোবইলটিকে নষ্ট করে ফেলতে হবে।

 

কিভাবে সাহায্য করবে জানতে চায় বাপন। পিন্টু বলে, ভারত সীমান্ত থেকে প্রবীরের ফোন ব্যবহার করে একটি ম্যাসেজ পাঠাতে হবে প্রবীরের ভাইয়ের নাম্বারে। তারপর ফোনটি নদীতে ফেলে দিতে হবে।

 

২১ জুন প্রবীরের ফোন ব্যবহার করে কুমিল্লার শিবের বাজার এলাকা থেকে ক্ষুদে বার্তা পাঠায় বাপন। তবে কথা মতো মোবাইল না ফেলে সিম ফেলে দেয় সে। আর প্রবীরের মোবাইল ফোনটি রেখে দেয় নিজের কাছে। এরপর নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসে পিন্টুর ফ্ল্যাটেই থাকতে শুরু করে বাপন। আর প্রবীরের মোবাইল ফোনটি রাখে তার দোকানের ড্রয়ারে। ৭ জুলাই বাপন ফোনটিতে নিজের সিমকার্ড ব্যবহার করলে সেটি জানতে পারে পুলিশ।

 

ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয় বাপন। বাপনের দেয়া তথ্য মতে ৯ জুলাই পিন্টুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৯ জুলাই রাতে পিন্টুর তথ্য মতে প্রবীরের খন্ডিত লাশ তার বাসার সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার হলে বাপন পুলিশের মাধ্যমে জানতে পারে যে প্রবীর খুন হয়েছে আর হত্যাকারী খোদ বন্ধুরুপী নরঘাতক পিন্টু দেবনাথ।

 

ডিবির সংবাদ সম্মেলন:

পিন্টুর আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দী দেয়ার ঘটনায় শনিবার রাতেই আদালত প্রাঙ্গনে সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বর্ণনা দেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই(ডিবি) মফিজুল ইসলাম। বলেন, পিন্টুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়ি প্রবীর হত্যার রহস্য উদঘাটন হলো। তবে চতুর পিন্টু বাইপাসের রোগি হওয়ায় সে প্রায়ই পুলিশকে বিভ্রান্ত করছিল। এঘটনায় বিস্তারিত জানান জন্য তদন্ত অব্যাহত থাকবে।

 

উল্লেখ্য, গত ১৮ জুন রাতে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় কালীরবাজার স্বর্ণপট্টি এলাকার ভোলানাথ জুয়েলার্সের মালিক প্রবীর চন্দ্র ঘোষ। প্রবীরের মোবাইল বন্ধ পেয়ে পরদিন ১৯ জুন বাবা ভোলানাথ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। ২১ জুন নিখোঁজ প্রবীরের মোবাইল ফোন থেকে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে তার ছোট ভাই বিপ্লবের কাছে এক কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়।

 

তারপরই সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। নিখোঁজ হবার ২২ দিন পর প্রবীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পিন্টু দেবনাথের আমলাপাড়া এলাকার ভাড়া বাসার সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে প্রবীরের খন্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই বিভাগের আরো খবর