শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

“ছেলেধরা, গুজব, গণপিটুনি ও বিচারহীনতা”

১১ দিনে ৬ জনকে গণপিটুনি

প্রকাশিত: ২১ জুলাই ২০১৯  

মাহফুজ সিহান (যুগের চিন্তা ২৪) : বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার মতো নারায়ণগঞ্জেও ‘ছেলে ধরা এসেছে’ এমন গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনী দেয়ার ঘটনা ঘটছে। জুলাইয়ের শুরু থেকে এধরণের ঘটনা নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জায়গায় শুরু হলেও এই সপ্তাহে এটি মহামারী আকার ধারণ করেছে।

 

গত ২১ দিনে ছেলেধরা সন্দেহে ৬ জনকে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। ছেলেধরা সন্দেহে গত দুই দিনে সিদ্ধিরগঞ্জ (২), ফতুল্লায় (১) এবং আড়াইহাজারে (১) মোট ৪টি গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটেছে সিদ্ধিরগঞ্জে।

 

ছেলেধরা সন্দেহে ২০ জুলাই সকাল ৮টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জ মিজমিজি পূর্বপাড়া আলামিন নগর এলাকায় বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজকে (৩০) গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডে পাইনাদী নতুন মহল্লার শাপলা চত্ত্বর এলাকায় শারমিন (২০) নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে জানা গেছে ওই নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।

 

এই দুই ঘটনার একই দিন রাতে ফতুল্লার লালখা এলাকায় রাসেল (৪৫) নামে এক ফুল ব্যবসায়ীকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে মারাত্মক আহত করা হয়। আড়াইহাজারে সদর পৌরসভার মসজিদের সামনে ছেলেধরা সন্দেহে (৬৫) বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে পিটুনি দেয় স্থানীয় জনতা। পরে পুলিশ জানতে পেরেছে  সেই বৃদ্ধা মানসিক প্রতিবন্ধী। সে ওই এলাকায় ভিক্ষা করতো।  

 


এরআগে নগরীর ১০ জুলাই নগরীর ২নং রেলগেট এলাকায় বকাঝকা করতে করতে নিজের বাচ্চাদের নিয়ে রিক্সায় যাওয়ার পথে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশ বক্সে দেয় জনতা। ১১ জুলাই সোনারগাঁয়ের শম্ভুপুরা এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে গণপিটুনি দেয়া হয়। 

 

সম্প্রতি ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি ছাড়া মাত্র একজনকেই পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। ২১ জুলাই  ফতুল্লা স্টেডিয়াম এলাকা থেকে শেফালি নামে এক নারীকে আটক করে থানা পুলিশ। 


আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনাকে একটি গোষ্ঠীর আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটনোর চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করছেন। গণপিটুনি দেয়ার ঘটনাকে বিশিষ্টজনেরা আবার বলছে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব। তবে এটিকে বিচারহীনতার বহিঃপ্রকাশ কোনক্রমেরই বলা যাবেনা বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁশুলি।

 

গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করাটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায়না এবং এটি সমর্থনযোগ্য নয় বলে মত মানবাধিকার কর্মীদের।  আর ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে যারা গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।  


ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়ার কারণ হিসেবে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি মনে করেন, ‘বর্তমানে আইন অকার্যকর। আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কমে গেছে। আইনের শাসন একেবারে ঘটতে পারে। এবং ঘটাই স্বাভাবিক। এটা সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে।

 

এটি আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা এবং বিশ্বাসহীনতার প্রতিফলন। বিচারহীনতার যেই সংস্কৃতি এর বহিঃপ্রকাশ। এর থেকে উত্তোরণের জন্য সমাজটাকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনতে হবে। আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষকে আইনের প্রতি, সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তাহলেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেনা।’  

 
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ঢাকা বিভাগ দক্ষিণের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ‘ছেলে ধরা গুজব আসলে একটি সামাজিক অস্থিরতা। আর এটি মানবতাবিরোধী। মানুষকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা মানবাধিকারে কোন সংজ্ঞাই পড়েনা।

 

সরকার এখন ছেলে ধরা গুজবটাকে হাইলাইট করে মাইকিংসহ প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে এটি যখন শুরু হয়েছে তখনই এই গুজবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো উচিৎ ছিলো। গুজবে মানুষ তার সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।

 

সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে একটি বাকপ্রতিবন্ধী ছেলেকে পিটিয়ে মারার ঘটনাটি নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই ছেলের পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার দাবি জানাই। জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে আমি আহবান জানাই, এধরণের ঘটনা ঘটলে তাকে না পিটিয়ে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলে দেবেন।

 

সমাজের মানুষে যখন মনে করে তার সন্তান নিরাপদ নয় তখনই এ ধরণের অস্থিরতা তৈরি হয়। এটি দূর করার দায়িত্ব ছিলো সরকারের। তবে সেটি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে পারিনা। কোন মৃত্যু, কোন খুন, কোন হত্যাকা- সমর্থনযোগ্য না।’     


নারায়ণগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রুমন রেজা বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাটি একটি নৃশংস ঘটনা। এধরণের ঘটনা দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উচিৎ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে নেপথ্যের প্রকৃত ঘটনা উদঘাটিত করা। কারা এসব প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।

 

যদি বাস্তবিকঅর্থে ছেলেধরাও হয় তাহলেও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া উচিৎ নয়। প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ছড়িয়ে কারা এধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে এরনেপথ্যে জড়িতদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিৎ। সব ধরণের হত্যাকা-ের ঘটনাই নিন্দনীয়। কেউ অপরাধী হলে প্রচলিত আইনেই তার বিচার হওয়া উচিৎ।’  

 

নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁশুলি (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ‘শুধু ছেলেধরা কেন যে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সহনশীলতার মধ্যে আনবে এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসবে পুলিশ প্রশাসন। এখানে তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা থাকতে হবে। ছেলে ধরা ঘটনাগুলো গত ১৫/২০ বছরেও এমনটি দেখা যায়নি।

 

উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কারা এসব করছে, কারা আছে এসব পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে বের করবে। জনসচেতনাটাও বৃদ্ধি করতে হবে। জনগণ ধরবে তারপর আইনের কাছে সোপর্দ করবে। বাংলাদেশে ঘটনাপ্রবাহে বিচার হচ্ছেনা এমন ঘটনা নেই। নারায়ণগঞ্জে প্রতি মাসে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সাজা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলা নেয়ার পর ১৫দিন অন্তর অন্তর তারিখ দিয়ে মামলাগুরো ৩ মাসে নিষ্পত্তি করে দেয়া হচ্ছে। বিচারহীনতা বিষয়টি ভিন্ন জিনিস।’  


তবে পুলিশ সুপারের বক্তব্য একটি গোষ্ঠী এই ছেলে ধরাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করছে। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘গুজবে কান দেবেন না। ছেলেধরা সন্দেহে কেউ নিজ হাতে আইন তুলে নিবেন না। যদি কাউকে ছেলে ধরা সন্দেহ হয় তাহলে পুলিশকে খবর দিন। পুলিশ যাঁচাই-বাঁছাই করে ব্যবস্থা নিবে।

 

আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর লক্ষ্যে ‘ছেলেধরা ’গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যারা গুজব ছড়িয়ে আইন গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে তাদের মধ্যে কিছু কিছু ব্যক্তি আমরা চিহ্নিত করেছি। এ সিদ্ধিরগঞ্জে  দুটি ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে । সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে বাকপ্রতিবন্ধী ছেলেকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে ।

 

ছেলেধরা সন্দেহে আরেক নারীকে একই অভিযোগে মারধর ও ফতুল্লায় ব্যবসায়ীকে ছেলেধরা সন্দেহে পেটানোর ঘটনাতেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিছু কিছু জনপ্রতিনিধিও এই গুজবে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার অনুরোধ আপনারা গুজবে জড়াবেন না। নিজেরাও সর্তক থাকুন অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করুন। ছেলেধরা গুজব থেকে সতর্ক করার জন্য আমরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মাইকিং করছি ।’
 

এই বিভাগের আরো খবর