বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

হয়তো কোন একদিন ক্ষমা চাইতে হবে

প্রকাশিত: ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে জাতীয় নির্বাচনের ছদ্মাবরণে যে ঘটনা ঘটে গেল, যাকে শেখ হাসিনা সরকারের মহাবিজয় বলতে দেশের গোটা বুদ্ধিজীবি সমাজ, যারা সরকারের অধীনে বড় বড় চেয়ারে অধিষ্ঠিত আছেন তারাতো বটেই বরং দেশী-বিদেশী অভিনন্দন বার্তা সব মিলিয়ে ইতিহাসের পাতায় কোথায় অবস্থান নিবে তা এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বহুবার বলা হয়েছে যে, গায়েবী মামলা বিরোধী দলকে নির্যাতন নিষ্পেষণ করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সরকার তাদের কথা মত একটি সুষ্ঠ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে যার জন্য সরকার প্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫জানুয়ারি জনসভায় নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। 

 

উপকারীর উপকার স্বীকার করতে হয় বিধায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়ে কোন ভুল করেছেন তা বলতে চাই না। তবে গায়েবী মোকদ্দমা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ইতিহাসের পাতায় কোথায় স্থান করে দিবে তিনি হয়তো এখনো উপলব্ধি করেননি। উপলব্ধি না করার কারণ এও হতে পারে যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের গ্রিন সিগন্যাল থেকেই গায়েবী মোকদ্দমার উৎপত্তি যার কারণে এতো সমালোচনার পরও সরকার বা কোন মহল বা সরকারি ঘারনার বুদ্ধিজীবি গায়েবী মামলার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন না। 

 

গায়েবী মোকদ্দমা কি? জাতীয় পত্রিকায় ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদ থেকেই গায়েবী মামলার আকার, রং, প্রকার প্রভৃতি চিত্রায়িত করা যাবে। সংবাদটিি ন¤œরুপ “পঙ্গু তারা মিয়া, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দেয়া হয়েছিলো, তাকে নিয়ে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ২৩ জানুয়ারি তিনি হাই কোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। পুলিশের করা ওই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের দুদিন আগে বিকাল ৪টার পর সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর বাজারে চাপাতি, হকিস্টিক ও লোহার রড নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মামলায় ৫২ জনকে আসামি করে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের  একজন।

 

তবে জামিনের সময় শেষ হয়ে গেলে তারা মিয়াকে সুনামগঞ্জের নি¤œ আদালতে আতœসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। জানা গেছে, ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন, নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না ডান হাত দিয়ে। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। এটি তার জন্মগত সমস্যা। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাকানো। খুব কষ্ট করে বাম হাত দিয়ে খেতে হয়। পঙ্গু এই মানুষটির ডান হাত অচল, বাম হাতও প্রায় অচল। তিনি সুনামগঞ্জের অধিবাসী, নাম তারা মিয়া। তারা মিয়া চাপাতি, হকিস্টিক ও লোহার রড হাতে নিয়ে আক্রমণ করেছেন পুলিশের ওপর।

 

ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ’ুদিন আগে বিকাল ৪টার পর মল্লিকপুর বাজারে এই আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ৫২ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের একজন।” 

 

যার উপলব্ধি বোধ রয়েছে তিনি এই সংবাদ পাঠ করার পর নিশ্চয় গায়েবী মামলা সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাবে। আর যিনি একটি একতরফা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে গায়েবী মামলার সমর্থক তার কথা ভিন্ন। কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষ কোন কারণেই এ গায়েবী মোকদ্দমার সমর্থন করার কথা নয়, যদিও গায়েব থেকে সৃষ্ট এই গায়েবী মোকদ্দমাই বিরোধী দলের উপর বিষফোড়া হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যদিও পদোন্নতির ভাগ্যাকাশ অনেকের জন্যই খুলে গেছে।


 
অথচ বাম জোটের মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ বলেছেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পথে। তারা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত এ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গত ২৮ জানুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোটের নজিরবিহীন ভোট জাকাতির নির্বাচন গণশুনানির অভিজ্ঞতা নাগরিক সমাজের ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। 

 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পৃথিবীর দু’শোটি দেশের মধ্যে পঞ্চাশটি দেশে গণতন্ত্র আছে। বাকিগুলোতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মিছিলে ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি অবস্থায় নিহত হন। কেউ বলতে পারবে না কোন নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। 

 

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় এবং লোভ ব্যবহার করে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। তিনি এ ধরণের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলার আহবান জানান। 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পন্থায়। বাংলাদেশ অন্ধকার পথে প্রবেশ করেছে। এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। অধ্যাপক আকাশ বাম জোটকে “আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব” আন্দোলন গড়ে তুলতে আহবান জানান। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে পূর্ব পরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্বাচনে অতি বিজয় অর্জন করেছে (সূত্র: ২৯/০১/২০১৯ ইং তারিখের জাতীয় পত্রিকা)।


 
এছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবে আওয়ামী লীগকে জেতানো হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর সম্মানের প্রতি আঘাত করা হয়েছে। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন, তারা কেউ আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্খী না। এতে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে (সূত্র: ২৯/০১/২০১৯ ইং তারিখের জাতীয় পত্রিকা)।


 
নির্বাচনে মহাবিজয় সম্পর্কে ২৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজয়ের কারণ হিসাবে ১৪টি এবং বিএনপি’র জোটের তথা ঐক্যফ্রন্টের পরাজয়ের ০৭টি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক ভাবে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে ০৭টি ব্যর্থতার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করে মন্তব্য করেছেন, সেহেতু বিএনপি’র পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খন্ডানো দরকার। 

 

নতুবা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অখন্ডিত ভাবেই থেকে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই রাজনৈতিক দলের ধর্ম হওয়া বাঞ্চনীয়। প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা না থাকলে “রাজনীতি” থাকে না। নির্বাচনে হেরে যাওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে ০৭টি কারণ উল্লেখ করেছেন তার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা প্রদান করা জনগণের মধ্যে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার করবে, অন্যদিকে কর্মীদের নিকট জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। 

 

বিএনপি’র উপরে শেখ হাসিনা সরকার যে স্টীম রোলার চালিয়েছে তা তিনি জেনেও সাফাই গাওয়ার জন্যই ২৫জানুয়ারি জনসভায় নির্বাচনের মহাজয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, যা তার নিজস্ব আঙ্গিকেই তিনি করেছেন, যা সুনির্দিষ্টভাবে খন্ডানোর দায়িত্ব বিএনপি’র রয়েছে বলে আমি মনে করি। 

 

প্রবাদ রয়েছে যে, “চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না।” এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খন্ডানের বিষয়ে বিএনপি পিছিয়ে থাকলে পরিস্থিতি বিএনপি পিছনের দিকে ঠেলে দিবে। ফলে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। স্মরণ করা দরকার যে, কে কী করে তা অনেকেই ফাঁকি দিয় যায়, কিন্তু নিজেকে ফাঁকি দেয়া কি সম্ভব ? ঘটে যাওয়া “নির্বাচন” নামক নির্বাচন সম্পর্কে ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে, বিদেশীদের চোখে ধূলো দেয়া যাবে, কিন্তু তারা কি তাদের নিজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন যারা ভূমিদস বিজয় অর্জনের কারিগর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন ? 

 

জনগণের কষ্ঠার্জিত অর্থে যাদের স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন লালিত-পালিত তাদের বিবেক কি জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে একটুও কুন্ঠাবোধ করে নাই? জাতির বিবেক কি নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যাবে? কারো কারো পদোন্নতি, বিলাসবহুল জীবন ধারণ ও আকাশচুম্বি উন্নতির কামনা বাসনার নিকট কি জাতি হেরে যাবে ? ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট জবাবদিহিতার কি কোন প্রয়োজন নেই ? তবে এই গায়েবী মামলার জন্য একদিন জাতির নিকট ক্ষমা চাইতে হবে ।

 

অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার
  
লেখক : কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)  
মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬

E-mail: [email protected]  

এই বিভাগের আরো খবর