স্মৃতিতে শিক্ষাগুরু-অধ্যাপক ড.করুণাময় গোস্বামী
প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯
২০১৭ সালের ১ জুলাই সকালে টিভি তে খবর দেখছিলাম। সব খবর ছাপিয়ে অকস্মাৎ একটি খবর বুকে বিঁধে গেল। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ড.করুণাময় গোস্বামী আর নেই। গত রাতে ইহকালের সকল লেনদেন চুকিয়ে অনন্তপথে যাত্রা করেছেন।
এমন একটি খবরের জন্য নারায়ণগঞ্জবাসী এমনকি দেশবাসী কারোরই বিন্দুমাত্র মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। আহত হৃদয় নিয়ে শিক্ষাগুরুর আত্মার সদগতি কামনায় দু’চোখে হাত রাখলাম । কলেজ জীবনের শুরুতে যার পাদপদ্মে বসে শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছিল আজ তাঁর প্রয়াণ সংবাদে তাঁর সাথে টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো প্রখর হয়ে মানসপটে পতপত করে উড়তে লাগল। এই স্মৃতি মন্থনই শিক্ষাগুরুর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধ্যা হিসাবে নিবেদন করছি।
১৯৭৮ এর শেষভাগ। মাধ্যমিক পাশ করে নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে ভর্তি হয়েছি। এখানেই স্যারের সাথে প্রথম দর্শন ফর্সা, সম্য চেহারায় সাহেবী গড়নের ব্যক্তিত্যপূর্ণ এক মানুষ। স্পষ্ট উচ্চারণে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। হাঁটা চলায় গুন গুন করে গান গান। গান নিয়ে তাঁর পা-িত্যের কথা পরে আমরা সবাই জেনেছি।
পড়াতেন ইংরেজি।পড়ানোর ধাঁচ ছিল একটু ভিন্ন। কথার ফাঁকে ফাঁকে অনানুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে পড়ানো। একদিন William Wordsworth-এর Daffodil কবিতা পড়াচ্ছিলেন। দৈব চয়নে আমার উপর হুকুম হল কবিতা পাঠের। পড়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু গ্রাম থেকে সদ্য আসা কিশোরের ইংরেজি উচ্চারণ স্যারের পছন্দ হবে কেন।
বললেন, আর কে পড়তে পারবে ? উঠে দাঁড়ালেন ফজলুল হক। গড় গড় করে নেটিভ উচ্চারণে করিতাটি পড়ে দিলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মত অবাক হয়ে শুনল পুরো ক্লাশ এবং শিক্ষক মহোদয়। একাধিকবার আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ বললেন ফজলুল রহমানকে। তার পরিচয় ও খোঁজ খবর জানলেন। সেদিনই হয়ত জানান দিয়েছিল এই ছেলে একদিন বিকেএমইএ এর প্রেসিডেন্ট হবে। সাফল্য ছোঁয়া ফজলুল হকের সহপাঠি হয়ে আমরা গর্বিত।
ক্লাশ শেষে বললেন, পড়াতো হল, আর কি? পরমুহূর্তে প্রশ্ন করলেন, ‘আর কি’-এর ইংরেজি কি? আমরা আকাশ পাতাল খুঁজতে লাগলাম উত্তর না পেয়ে স্যার বলে দিলেন, What more সহজ অথচ অজানা ইংরেজি জেনে খুব মজা লাগল ।
ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের আয়োজিত এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, বিচারক হিসাবে। আবৃত্তি, কৌতুক ইত্যাদি চলছির। অনুষ্ঠান শেষে স্যারকে অনুরোধ করা হল একটি কৌতুক বলার জন্য । স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্যার বলেলেন, আমার কৌতুক শুনে হয়তো হো হো করে হাসা যাবে না, তবে মজা পাবে।
এক মেয়ে তার বাবার কাছে আবদার করল, আমি কোন সাধারণ ছেলেকে বিয়ে করব না। আমাকে যদি বিয়ে দিতে হয় তবে সর্বগুণে গুণান্বিত পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে হবে। সে হবে লেখাপড়ায় সেরা, বুদ্ধিতে সেরা, গায়ক হিসাবে সেরা, নায়ক হিসাবে সেরা, লেখক হিসাবে সেরা, খেলোয়ার হিসাবে সেরা ইত্যাদি। শর্ত শুনে মেয়ের বাবা হতাশ হয়ে পরলেন। অনেক ভেবে চিন্তে একদিন একটি বড়সর বাক্স নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।মেয়েকে ডেকে বললেন, মা তোমার যোগ্য পাত্র এনেছি। মেয়ে বাক্স খোলে দেখল একটি টেলিভিশন। বাবা বললেন, এটিই একমাত্র পাত্র যার সর্বগুণ এবং সেরাগুণ রয়েছে। সেদিন আমরা না হেসে পারলাম না।
একবার চাকুরীর প্রয়োজনে আমার কিছু কাগজপত্র সত্যায়িত করা প্রয়োজন। নিয়ম রক্ষার্থে জীবনে বহুবার তথাকথিত সত্যায়নের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এবার ভাবলাম একটা খাঁটি কাজের জন্য খাঁটি মানুষদের দ্বারাই সত্যায়ন করাই।কাগজপত্র নিয়ে গোস্বামী স্যারের বাসায় হাজির হলাম। সাথে নিলাম বিশিষ্ট সমাজ-সাংস্কৃতিককর্মী, রাজনৈতিক কর্মী সর্বজন পরিচিত আমার এক প্রিয় বন্ধুকে। ৎ
স্যার দরজা খুললেন। প্রয়োজনের কথা শুনে মজা করে বললেন-সত্যায়িত করব যে, এই ছেলেকে কি আমি চিনি? কাগজগুলো নিয়ে বললেন, দাড়াও। আমরা বারান্দায় দাঁড়ালাম।ঘর মোছা হচ্ছে, সুতরাং ঘরে ঢােকার সুযোগ নেই, প্রয়োজনও নেই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে স্যার কাজটি করে দিলেন। খঁটি মানুষের খাঁটি সত্যায়ন পেয়ে ভাল লাগল বটে কিন্তু আবার মনে হল এই সামান্য কাজের জন্য এতবড় মানিষীর কাছে যাওয়া ঠিক হল কি ?
একবার এক সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরব, বাসে উঠে বসেছি । কিছুক্ষণের মধ্যে করুনাময় গোস্বামী স্যার আমার পাশে এসে বসলেন। এই মহান শিক্ষকের পাশে বসে আমি পুলকিত হচ্ছিলাম, শিহরিত হচ্ছিলাম। এমন মহাজনের পাশে এভাবে কোনদিন বসার সুযোগ হয়নি, হবেও না। সেদিন চল্লিশ মিনিটের বাস যাত্রায় স্যার কত যে কথা বলরেন।
কিছুদিন আগে স্যারের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী দর্শন, সেখানকার অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা, তাঁদের আপ্যায়ন, আন্তরিকতা ইত্যাদি নিয়ে কতকথা। হয়ত সময় কাটানোর প্রয়োজনেই আমাকে এতকথাগুলো বলেছিলেন। আমি আগ্রহী শ্রোতা হিসাবে পেয়ে গেলাম এই বারতি পাওনা আমি বিনীতভাবে অনুমতি চাইলাম, স্যার আপনার ভাড়াটা আমি দিই। স্যার আপত্তি করলেন না (তখন বাসের ভিতরে ভাড়া কাটা হত)। মূল্যবান, তথ্যপূর্ণ কথার ধারা ধরেই রাখলেন। এই চল্লিশ মিনিট হয়ত স্যারের সাথে আমার শ্রেষ্ঠ সময়।
মানুষতো চলেই যাবে। তবে গুণীজনদের অসময়ে চলে যাওয়ায় দেশ, জাতি বঞ্চিত হয় তাদের অমূল্য সৃষ্টিশীলতা থেকে। এই মহান শিক্ষাগুরুর পরকালও হউক পরম শান্তিময়।
অধ্যাপক ড. করুণাময় গোস্বামীর জন্ম ১১ মার্চ ১৯৪৩ - মৃত্যু ৩০ জুন, ২০১৭। একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ও সাহিত্যিক। বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরূল ইসলামের স্থান বিষয়ে মূল্যবান গবেষণায় ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার পান। ২০১২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০১৩ সালে পান বাংলা একাডেমি কর্তৃক রবীন্দ্র পুরস্কার।
সঞ্জয় সাহা
- H2o নিয়ে আমরা হাসি, দিন শেষে আমাদের নিয়ে হাসে তারা!
- একজন তরুন কবির চোখে বঙ্গবন্ধু
- আশীর্বাদ না অভিশাপ কিং মেকার!
- একজন বাঙালী মা ও মুক্তিযুদ্ধ
- আজ গৌর পূর্ণিমা, শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাব তিথি
- দীপাবলী শ্যামাপূজা ও বাঙালি নারী
- পরিবেশ সুরক্ষা ও নান্দনিক পরিবেশ বাস্তবায়িততেই -সামাজিকের অগ্রগতি
- নারী দিবসের তাৎপর্য নেই
- সাইফুল্লাহ বাদল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক
- শেখ হাসিনার একটি বাড়ি একটি খামার বিষয়ক আশ্রয়ণ প্রকল্প
- মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুলালকে দাদা’র প্রার্থী ঘোষণা
- বসন্তে বাসন্তী পূজার ইতিবৃত্ত
- রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়
- পোষ্টার লাগানোর সময় বৈধ, পরে অবৈধ!
- বায়ুদূষণ রোধে করণীয়