শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ও অমিয় গীতা

প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০১৯  

কৃষ্ণ পক্ষ জন্মাষ্টমী তিথি। দ্বাপর যুগে এই তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ গভীর নিশিতে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। আসুরিক রাজাদের অবাঞ্চিত সামরিক শক্তির প্রভাবে পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। তখন মাতা বসুন্ধরা ব্যথিত চিত্তে ব্রহ্মার কাছে তার দুঃখ নিবেদন করেন। ব্রহ্মা ক্ষীর সমুদ্রের তীরে গিয়ে শ্রীবিষ্ণুর বন্দনা করেন। শ্রীবিষ্ণু ব্রহ্মাকে জানালেন, আমি অচিরেই পৃথিবীতে আবির্ভাব হবো। সমস্ত দেবতারা যেন সেখানে উপস্থিত থাকেন।

 

শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় ভগবান নিজেই জ্ঞানযোগে তার প্রিয় শিষ্য শ্রী অর্জুনকে বলেছেন, “হে ভারত! যখন ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, আমি নিজকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।” যখনই অসুরেরা অথবা আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা সৎ কর্মে বাধার সৃষ্টি করে তখন আরাধ্য স্বয়ং বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণ রূপে ধুলার ধরণীতে অবতরণ করেন। শ্রী গীতায় ভগবান ৪র্থ অধ্যায় ৮ম শ্লোকে অবতরণের কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, “পরিত্রাণায় সাধুনাং.....” সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য ও দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।


যুগে যুগেই যার আবির্ভাব সেই মহান সৃষ্টিকর্তা দ্বাপর যুগে কেন, কোথায়, কী জন্য পদার্পন করলেন? এসব পৌরাণিক ইতিহাস অনেকেরই জানা। বৈদিক পদ্ধতি অনুসারে কন্যার বিবাহের পর তার ভাই তাকে শ্বশুরালয় পৌঁছে দিয়ে আসে যাতে ভগ্নী নিঃসঙ্গ বোধ না করে। দেবকীর পিতা দেবক তাঁর কন্যার বিবাহে অতুল ঐশ্বর্য্য দান করেছিলেন। সুবর্ণ অলংকারে ভূষিত চারশ হাতি, পনের হাজার সুসজ্জ্বিত অশ্ব, আঠারশো রথদান করেন। কন্যার সাথে দু’শো সুন্দরী দাসী দান করেছিলেন। নববধূকে নিয়ে তার শ্বশুরালয়ে যাওয়ার পথে আকাশ বাণী হলো। “হে মূঢ় কংস যাকে নিয়ে এত আনন্দ করে যাচ্ছো, তার অষ্টম গর্ভের সন্তান তোমার মৃত্যুর কারণ হবে।”


ভোজবংশীয় রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংস ছিলো আসুরিক ভাবাপন্ন। এ আকাশবাণী শোনা মাত্র ভগ্নী দেবকীর কেশাকর্ষণ করে অন্য হাতে অসি কোষমুক্ত করে হত্যা করতে উদ্যত হয়। বসুদেব তার বুদ্ধিমত্তার বলে উত্তেজিত কংসকে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে নিবৃত করলেন। পরিশেষে এক এক করে কংসের কারাগারে সদ্য প্রসূত ছয় সন্তানকে কংস নিজহাতে হত্যা করে। কারাগারে অন্তঃস্বত্তা জননী দেবকী বিষ্ণু আরাধনায় মগ্ন হলেন। স্বামী-স্ত্রী বসুদেব-দেবকী শ্রী বিষ্ণুর দর্শন লাভ করলেন। আজ থেকে দশ মাস দশদিন পর আমি শ্রীবিষ্ণু তোমার সন্তান কৃষ্ণ রূপে আবির্ভূত হবো। যার জন্ম নেই, জন্ম রহিত, যার আকার নেই নিরাকার সেই ব্রহ্ম, ভক্তির শীতলায় আকার রূপে ধুলার ধরণীতে পদার্পন।


শ্রাবণ মাস কৃষ্ণ পক্ষ অষ্টমী তিথি অন্ধকার রজনী প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতির বুকে নেমে এসেছে অলৌকিক নীরবতা। পাইক-প্রহরী নিদ্রায় নিদ্রিত। স্বয়ং বিষ্ণু কংসের কারাগারে আলোকিত রূপ ধারণ করে বললেন, আমাকে নন্দালয়ে রেখে এসো। বসুদেব নবজাত শিশু গোপালকে নিয়ে যমুনা পাড় হয়ে নন্দালয়ে মা যশোদার বুকে গোপালকে রেখে, যশোদার যোগমায়া রূপী নবজাত কন্যাকে নিয়ে এলেন মথুরায়। অন্ধকার আকাশ ভোরের নীলাভো রূপ ধারণ করলে উষাদেবীর প্রকাশ ঘটে। 


কারাগারে নবজাত শিশুর কান্না শুনে প্রহরীরা বার্তা জানায় রাজা কংসকে। কংস রাজ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত নয়নে অট্টহাসি হেসে কারাগারে প্রবেশ করেন। দেবকী-বসুদেবের হাজারো কাকুতি মিনতি থাকা সত্ত্বেও ঈগল পাখির ন্যায় ছিনিয়ে নেয় নবজাতক কন্যা সন্তানকে পাষ- পাপিষ্ট রাজা কংস পাথরে নিক্ষেপ করে। শূন্যে মিলিয়ে যায় যোগমায়া। শব্দ ভেসে আসে “তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বারিছে সে।” এ শব্দ শুনে কংস তাঁর রাজ্যে শিশু হত্যা শুরু করে। 


কংস তার সর্বশক্তি এবং সব চর অনুচরদের দিয়ে গোকুলের গোপাল হত্যার চেষ্টা করে। সব শক্তি পরাভূত হয়। এতে করে কংস হয়ে উঠে উন্মাদ। সে তার চারিদিকে মৃত্যু রূপী গোপালকে দেখতে পায়। হিংসার অগ্নিগর্ভ থেকে সর্বদা কৃষ্ণ কৃষ্ণ শব্দ বেরিয়ে আসে। ঘুমের মাঝেও দুঃস্বপ্ন দেখে কংস। কংস বিষ্ণু-বৈষ্ণব হিংসায় মেতে উঠে। এদিকে লীলাময় গোপাল কৃষ্ণ, অসুর নিধনে মেতে উঠেন। পুতমা বধ, বৎসাসুর, বকাসুর, অঘাসুর, ধেনুকাসুর, কালীয়দমন. প্রলম্বাসুর, কেশীদানব ও ব্যোমাসুর বধ, কুবলয়াপীড় বধ করেন।


দুষ্টমতি কংসের কালপুরণের লক্ষ্যেই মহাযজ্ঞের আয়োজন করে কংস। পরিশেষে অক্রুর মুনিকে গোকুলে পাঠান কৃষ্ণ বলরামকে আনতে। অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় এসে কুবজার সাথে ভাব করেন। মথুরার সমস্ত তত্ব জেনে শ্রীকৃষ্ণ যজ্ঞস্থলে গিয়ে মল্ল যোদ্ধাদের হত্যা করেন। কংসের বীর বলে যারা খ্যাত একে একে সবাই পরাস্থ হয়। এ দেখে কংস নিজেই মল্ল যুদ্ধে মিলিত হন। শিশুদের সাথে রাজার এ যুদ্ধ দেখার আগ্রহ কেউ করেনি। অনেকেই কংসের এই নিষ্ঠুর আচরণে ধিক্কার দিতে লাগলেন। আবার কেউ কেউ কংসের শেষ পরিণতি দেখার জন্য অপেক্ষা করলেন। কংস যেদিকে তাকায় সেই দিকেই তার শত্রুরূপী হাস্যজ্জ্বল শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পান। শ্রীকৃষ্ণের মুষ্টি আঘাতে কংস ধরাশায়ী হয়ে রক্তবমন করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে।


কংসের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার আট ভাই এগিয়ে এলো। বেদের অনুশাসন অনুযায়ী শত্রু ছয় প্রকার। বেদ এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা। কিন্তু কংস তার ভ্রাতাগণ কৃষ্ণকে জানতে পারে নাই। কংসের ভ্রাতা কঙ্ক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ ভ্রাতারা দলবদ্ধভাবে কৃষ্ণকে বধ করার জন্য ছুটে আসেন। এরা সবাই ছিলেন কৃষ্ণের মামা। মাতুল বধ হচ্ছে বৈধিক অনুশাসন বিরোধী। অনিবার্য কারণেই কংসকে বধ করতে হয়। রুহিনী নন্দন ভাই বলরাম দুষ্ট দুরাচারদের বিনাশ করার দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে মাতা দেবকী ও পিতা বাসুদেবসহ শত শত রাজবন্দিদের মুক্ত করেন।


দ্বাপর যুগে শেষ প্রান্তে লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ জগতের কল্যাণের জন্য কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের ময়দানে প্রিয় শিষ্য অর্জুনের রথের সারথীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধের ময়দানে এসে অর্জুন তার জ্ঞাতি গোষ্ঠিদের সম্মুখ সমরে দেখে তিনি যুদ্ধ করবেন না বলে ধনুর্বান রেখে রথে বসে পরলেন। বললেন, হে কৃষ্ণ আমি যুদ্ধ করবো না।


ভূভার হরণ করার লক্ষ্যে পার্থ সারথী শ্রীকৃষ্ণ তার প্রিয় শিষ্যকে গীতাদান করলেন। মানুষের কর্তব্য কী ? কীভাবে সে কর্তব্য পালন করবে ? কর্তব্য পালনে মানুষের কী গতি হবে। সেই অগতির গতি নিয়ন্ত্রা কে ? তাকে জানার বিস্তারিত উল্লেখ করলেন শ্রীকৃষ্ণ। বেদের সারবস্তুকে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটে জগতের কল্যাণে অক্ষয় অমিয় গীতা দান করলেন অর্জুনের মাধ্যমে জগতবাসীকে। ভগবান মর্ত্যলোকে অবতরণ করেন তাঁর আনন্দময় বৃন্দাবন লীলা প্রদর্শন করার জন্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রকৃত লীলা সমূহের বিবরণ এমনই আকর্ষণীয় যে, তা স্বাভাবিকভাবে সকলকে বার বার অনুপ্রাণিত করে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এই অনুরাগই ভগবদ্ধাম গোলোক বৃন্দাবন প্রাপ্তির যোগ্যতা। হরে কৃষ্ণ....

 

রণজিৎ মোদক
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক এবং সভাপতি-ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ
মুঠোফোন : ০১৭১১ ৯৭ ৪৩ ৭২

এই বিভাগের আরো খবর