মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ৫ ১৪৩০

রূপগঞ্জের বালু সেতু নিয়ে গোলক ধাঁ-ধাঁ, ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকাবাসী

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০১৯  

রূপগঞ্জ (যুগের চিন্তা ২৪) : দ্বিতীয় দফায় নতুন করে কাজ শুরু হওয়ার আগেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)-এর বাঁধার মুখে আটকে গেলো রূপগঞ্জের  বালু স্বপ্নের সেতু। সেতুটি নিয়ে গত ৪৭ বছর ধরেই চলছে গোলক ধাঁ-ধাঁ। 


উপজেলার কায়েতপাড়ার নগরপাড়ার বালু নদের উপড় বালু সেতুর দুটি স্প্যান দেখেই গত ১৭ বছর ধরে স্বপ্ন দেখে আসছে স্থানীয়রা। সবশেষ চলতি বছরে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিআইডব্লিউ-িএর কারণে তা-ও ভেস্তে গেলো।


বুধবার (২০ নভেম্বর) এ সেতু নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে বৈঠক রয়েছে। এ বৈঠকে সেতুর ভাগ্য নির্ধারণ হবে বলে জানা গেছে। তবে নতুন করে সেতু নির্মাণে বাঁধা হওয়ায় স্থানীয়রা ক্রমেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, সেতু নির্মাণ না হলে বিক্ষোভ, মানবন্ধন, সড়ক অবরোধসহ বড় ধরণের কর্মসূচি পালন করা হবে। 


নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের অধীনে মাঝিনা-কায়েতপাড়া-ত্রিমহনী সড়কের বালু নদের উপড় সেতুর নির্মাণের দরপত্র আহবান করা হয় বিগত বিএনপি সরকারের (২০০১) আমলে। প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৫.৩০ মিটার দৈর্ঘ্য এ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু ২০০৩ সালে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধানে এক বছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব পান মের্সাস ইস্টর্নি ট্রেডার্স লিমিডেটের তৎকালীন ঠিকাদার জাহিদ হোসেন। গত ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে বরাদ্দ মেলে মাত্র ৫০ লাখ টাকা।এরপর আর কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।ফলে ২ টি স্প্যান নির্মাণের পর সেতুর নির্মাণ কাজ থমকে যায়। পালিয়ে যায় ঠিকাদার জাহিদ হোসেন। 

 

সূত্র জানায়, অসমাপ্ত বালু সেতু নির্মাণে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহবান করা হয়। এসময় নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ১৩ কোটি টাকা। মের্সাস ইউনুস এন্ড বাদ্রার্স এবং মের্সাস সরদার এন্টারপ্রাইজ (জেভি) সেতু নির্মাণে কাজ পায়। সে অনুযায়ী চলতি বছরের মে মাস থেকে কাজ শুরু করার কথাও ছিলো।

 

কিন্তু গত ২৫ জুন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ সেতু নির্মাণে বাঁধা প্রদান করে। এসময় বিআইডব্লিউএ কর্তৃপক্ষ বালু নদকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার তকমা দেখিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি (যার নং ২৬৭৯৯০০৮১৬) প্রদান করে। এরপর থমকে যায় নতুন করে সেতুর নির্মাণ কাজ। 


জানা গেছে,  সওজের অধীনে বালু নদের উজানে গত ২০০৩ সালে ১০৯ মিটার ও ১৯৯৩ সালে ১১০ মিটার দুটি সেতু নির্মাণ করেছে। এছাড়া এলজিইডি-এর অধীনে আরও দুটি সেতু রয়েছে।শুধু এ সেতু নিয়ে বিআইডব্লিউটি-এর হঠ্যাৎ বাঁধায় হতবিহ্বল সওজ। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে স্থানীয়রা ক্রমেই ফুঁসে উঠছে। সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না হলে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবরোধসহ বড় ধরণের কর্মসূচি পালনের আলটিমেটাম দিয়েছেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধরা। 


স্থানীয়রা বলেন, সেতু নির্মাণ হলে এলাকার মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেতো। খুলে যেতো সম্ভবনার দুয়ার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সেতুবন্ধন তৈরি হতো। কমে যেতো রাজধানী ঢাকার যানজট। একটি মাত্র সেতুর জন্য রূপগঞ্জসহ আশপাশের লাখো মানুষকে ১২ কিলোমিটার পথ ঘুরে রাজধানী ঢাকায় যেতে হয়। অথচ এ সেতুটি হলে মাত্র ২০ মিনিটে এলাকার বাসিন্দারা ঢাকায় যেতে পারবে। স্বাধীনতার পর থেকে সেতুটির কথা এলাকাবাসী শুনে আসলেও গত ৪৬ বছরে এটির বাস্তবায়ন হয়নি। সেতুটি নিয়ে দু’দফায় টেন্ডারও হয়েছে। বুক ভরা আশা আর স্বপ্ন নিয়ে এখনো লাখো মানুষ সেতুটিকে ঘিরে বুক বেঁধে আছেন। 


সরেজমিনে ঘুরে ও এলাকার প্রবীণ লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রামপুরা-কায়েতপাড়া সড়ক ও বালু নদে সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ৭৫’ পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। গত ৪৬ বছরে ঢাকার সঙ্গে সহজে যোগাযোগের জন্য বালু নদের রূপগঞ্জ অংশের চনপাড়া, ইউসুফগঞ্জ ও ভোলানাথপুরে তিনটি সেতু নির্মাণ করা হলেও এ সেতুটির ভাগ্যে বইছে বঞ্চনা। প্রভাবশালীদের ক্ষমতার লাল ফিতায় বন্দী হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেতু!  


স্থানীয়রা জানান, সেতুটি নির্মাণ হলে রূপগঞ্জসহ রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠের খিলগাও, সবুজবাগ, ডেমরা ও আশপাশের কয়েক লাখ মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তৈরি হবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা ও গার্মেন্ট শিল্প। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। সেতুটি নির্মিত হলে কাচপুর ও সুলতানা কামাল সেতুর যানজট কমে যাবে। দেশের উত্তরাঞ্চল সিলেট, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদীসহ ১০ জেলার যানবাহন অতি সহজে ভুলতা দিয়ে কায়েতপাড়া হয়ে রাজধানী রামপুরায় প্রবেশ করতে পারবে। 


খামারপাড়া এলাকার প্রবীণ আউয়াল আলী বলেন, ৭১’ সালের পরে বাসাবো মাঠে এক জনসভায় শেখ মুজিব রামপুরা-কায়েতপাড়া রাস্তা আর বালু গাঙ্গে (নদে) বিরিজ (সেতু ) কইরা দিব কইছিলো। কত সরকার আইলো-গেলো আমাগো স্বপ্ন পূরণ অইলো না। শেখ মুজিব বাইচ্যা থাকলে এ বিরিজ হগলতের আগে অইতো। 


দেলপাড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা যহন যুদ্ধ করছি, তহন গাঙ (নদ) পার অইয়া যুদ্ধ করছি। যুদ্ধের পরে শেখ মুজিবুর রহমান নাকি কইছে এহান দিয়া ব্রিজ কইরা দিবো। বাপ-দাদাগো মুখে হুনছি। এহন ওনার মেয়ে ক্ষমতায়। ওনি যদি ওনার পিতার স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছা করেন তাইলে এই ব্রিজ অইবো।


বাগবাড়ী এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহম্মেদ রঞ্জু বলেন, জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণে জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় সচেষ্ট। যেহেতু এ সেতু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেক্ষেত্রে নেত্রী এ সেতু নির্মাণ করবেন এটা আমাদের আশা। সেতু নির্মাণের দাবিতে বিভিন্ন সময় বালু নদী অবরোধ-মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর ( বীরপ্রতিক ) সেতু মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দৌড়ঝাপ করছেন। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই আশার আলো দেখা যাবে।


 
নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-প্রকৌশলী মো.সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সেতুটির ভাগ্যে কী আছে আমরাও জানিনা। নতুন করে বরাদ্দ হয়েছে। কাজও শুরু করার কথা ছিলো। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ বালু নদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে এমন অজুহাত দাঁড় করিয়ে সেতু নির্মাণে বাঁধা দেয়। ফলে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে আশা রাখি এ সেতু হবে। 


নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর (বীরপ্রতিক) বলেন, বালু নদের সেতুটি হলে রূপগঞ্জের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ খুব সহজ হবে। আর কায়েতপাড়া ইউনিয়নবাসীর জন্য এ সেতু স্বপ্ন। তাই লাখো মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ এ সেতু হবেই। 

এই বিভাগের আরো খবর