বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রাস্তায় রাস্তায় বাঁশের ব্যারিকেড, বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা

প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২০  

বিশেষ প্রতিনিধি : করোনার গ্রাস থেকে নারায়ণগঞ্জ মহানগরীকে বাঁচাতে সিটিতে লকডাউন চলছে। এই লকডাউন এর প্রভাব পড়েছে প্রতিটি মহল্লায়। করোনা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন মহল্লার লোকজন স্বপ্রনোদিত হয়ে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়েছে রাস্তায়। রাস্তাঘাট দুপুরের পর থেকেই সুনসান নিরব। 

রাস্তার দু’পাশে প্রতিটি বাড়িতে করোনা আতঙ্ক। অধিকাংশ বাড়ির মূল গেট বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছেন না। কিছু কিছু বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াদের চাহিদা মত খাদ্যপন্য সরবারহ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। টাকা দিলেই বাড়ির মালিক নিজস্ব লোক দিয়ে ভাড়াটিয়ার খাদ্যপণ্য এনে দিচ্ছেন। 

সর্বশেষ সোমবার (৬ মার্চ) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন নারায়ণগঞ্জ ১৮ নং ওয়ার্ডের বাপ্পীচত্বর এলাকার বাসিন্দা ফারুক আহমদে (৫৫) নামে আরো এক ব্যক্তি। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাড়ালো ৫ জনে।
দুপুর সোয়া ১টায় রাজধানীর কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।  নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ মোস্তফা আলী এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে, শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কটি শহরের মাঝখান দিয়ে চাষাড়া থেকে সোজা নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত চলে গেছে। বঙ্গবন্ধু সড়কের দু’পাশ দিয়ে অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দিয়ে শাখা সড়কগুলো শহরতলীর বিভিন্ন এলাকা পর্যন্ত গিয়েছে। সকল সড়কে ব্যারিকেড। রিক্সা ও অটো বন্ধ। চলছে দু’ চারটা  মোটর সাইকেল। 


এছাড়া অধিকাংশ পথচারীকে  হেঁটেই  যেতে  দেখা যাচ্ছে গন্তব্যে। প্রতিটি মানুষের মনে ভয় শংকা। গত ২৪ ঘন্টায় নারায়ণগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।  জেলা প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে নতুন ইতিহাস রচনা করতে চলেছে প্রাচ্যেরডান্ডি নারায়ণগঞ্জ। 


এ যেন এক অপরিচিত নারায়ণগঞ্জ। এমন ফাঁকা নগরী ইতপূর্বে কখনো হয়েছে বলে জানেন না কেউ। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে  গণপরিবহন বন্ধ। বন্ধ দোকানপাট। সকালে সড়কে দু-চারটি মোটরসাইকেল ছাড়া গণপরিবহন  দেখা যায়নি। জরুরি সেবার যান ও মালবাহী ট্রাকও খুব একটা দেখা যায়নি।


বিভিন্ন স্পটে আইনশৃংখলাবাহিনী সড়কে অবস্থান নিয়ে আছেন। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার দেখলেই থামাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। জানতে চাচ্ছেন কেন বের হয়েছেন,  কোথায় যাচ্ছেন ?


জানাগেছে, দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ৩১ দফা নির্দেশনার মধ্যে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, হোমকোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেসনে থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে করনীয়, সামাজিক দূরত্ব ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, ত্রাণ সহায়তা ও মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন অব্যহত রাখতে প্রশাসনসহ সকলের করনীয় সম্পর্কে নির্দেশনাসমূহকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসন, নারায়ণগঞ্জ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। 


সমাজের সকল স্তরের মানুষ, শিল্পমালিক, ব্যবসায়ী, কৃষক ও ব্যক্তি পর্যায়ে প্রত্যেকের করনীয় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও গুজব রটানো বন্ধ করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা হচ্ছে। 


কেউ যেন অভুক্ত না থাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সে নির্দেশনার আলোকে করোনা ভাইরাসের কারণে যে সকল কর্মজীবি মানুষ কর্মহীন হয়ে খাদ্য সমস্যায় আছে জেলা প্রশাসন তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। 


হট লাইনে প্রাপ্ত ফোন কলের ভিত্তিতে জরুরীভাবে কর্মহীন অসহায় পরিবারের বাড়ি গিয়ে সরকারি খাদ্য সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে। অনুগ্রহ পূর্বক সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরনের স্বার্থে সঠিক তথ্য হট লাইন নম্বরে জানানোর জন্য সকলকে অনুরোধ করা হলো। 


আইইডিসিআর কর্তৃক নারায়ণগঞ্জ জেলাকে করোনা সংক্রমন প্রবণ ও ঝুঁকিপূর্ন এলাকা বিবেচিত হওয়ায় আইইডিসিআর প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। করোনা সংক্রমন রোধে প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে। 


অদ্য হতে উক্ত অভিযান আরও জোরদার করে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় জেলা প্রশাসন মানুষকে ঘরে রাখার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণের নেতৃত্বে সার্বক্ষনিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। 


সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারী কাউকে নূন্যতম ছাড় দেয়া হবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা কার্যক্রমকে বেগবান রাখার উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলায় জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটগণের নের্তৃত্বে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতায়  জেলার  বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সামাজিক দূরত্ব নিয়ন্ত্রণে, বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা মূলক ২৭ টি অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং ১৭ টি মামলায় ৫৬,২০০/- টাকা জরিমানা করা হয়। 


বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের আইন ভঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে অবহিত করা হচ্ছে, বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া এ কার্যালয়ে স্থাপিত জেলা মনিটরিং সেল ও কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘন্টা চালু রাখা আছে। উক্ত কন্ট্রোল রুমে প্রাপ্ত অভিযোগ ও পরামর্শের বিষয়ে তাৎক্ষনিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।


নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা পূর্ব লামাপাড়া এলাকায় স্বপ্ননীড় নামক একটি ভবনে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হওয়ায় ঐ ভবনের ৮ টি ফ্লাটের সদস্যসহ আশেপাশের ২০৮ টি পরিবারকে হোমকোয়ারেন্টাইন নিয়ে উক্ত এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। 


আক্রান্ত ব্যক্তি বিএসএসএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এ পর্যন্ত এ জেলায় সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ১১, তার মধ্যে আরোগ্য লাভকারি মোট ০৩ জন, ০২ জন মৃত্যুবরণ করছেন, ০৭ জন করোনা রোগী হিসেবে আইসোলেসনে রাখা হয়েছে। বাড়িতে মোট কোয়ারেন্টাইন ৬০৭ তার মধ্যে অদ্য ৩৬ জন। কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়প্রাপ্ত মোট ৪৫০ জন, অদ্য ০৪ জন। ১ মার্চ থেকে অদ্য পর্যন্ত বিদেশ থেকে মোট প্রত্যাগত ৬,০২১ জন। ঠিকানা ও অবস্থান চিহ্নিত বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তি মোট ১২৫৯ জন।


সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র ০৬ টি, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্রস্তুতকৃত বেড ৩০ টি, ডাক্তারের সংখ্যা ৯০ জন, নার্সের সংখ্যা ১৭৩ জন। এম্বুল্যান্সের সংখ্যা ০৬ টি। বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র ৭২ টি, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্রস্তুতকৃত বেড ৭২ টি, ডাক্তারের সংখ্যা ১০০ জন, নার্সের সংখ্যা ১৮০ জন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রি (পিপিই) বিতরণ করা হয়েছে ৬৮০ টি, অদ্য মজুদ রয়েছে ১০২৮ টি।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ সহায়তার অংশ হিসেবে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে বিভিন্ন প্যাকেট ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। উপজেলাসমূহে উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ তাদের স্ব-স্ব এলাকায় সরকারি ভাবে প্রাপ্ত এবং স্থানীয় উদ্যোগে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। 


দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ০৫.০৪.২০২০ তারিখ পর্যন্ত মোট ২৭,০০,০০০/- (সাতাশ লক্ষ) টাকা ও ৬০০ মেট্রিক টন চাল ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনসহ উপজেলা পর্যায়ে বিতরনের জন্য উপ বরাদ্দ প্রেরণ করা হয়েছে এবং প্রায় ৬০,০০০ পরিবার সমূহকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। 


বেসরকারী উদ্যোগে প্রাপ্ত মানবিক সহায়তার মধ্যে ৩৩৭৭ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা এবং ২১,০০,০০০/- (একুশ লক্ষ) টাকা চেকের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা পাওয়া গিয়েছে।


যার মধ্যে ১৫৭৩ প্যাকেট খাবার ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। কোন উপকারভোগী যেন বাদ না পরে এবং দ্বৈততা পরিহারের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলার মানবিক কাজে উদ্যোগী বিত্তশালী ব্যক্তি/সংগঠন/এনজিও কোন খাদ্য সহায়তা প্রদান করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ২০ নং নির্দেশনা অনুযায়ী আবশ্যিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে নেয়ার জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হলো। 


ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সবধরনের জনসমাগম, জটলা বা ভিড় পরিহার করার জন্য এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, যথেষ্ঠ সচেতনতা, প্রতিরোধ প্রস্তুতী ও প্রশাসন মাঠে কাজ করার পরও পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকেই এগোচ্ছে। করোনা সংক্রান্ত হটলাইনে ফোন করেও রেসপন্স মিলছেনা বলে উত্তর চাষাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিত্তবান মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ বিতরণ করলেও সেখানে একটা ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। সমাজের নিম্নবিত্তরা একাধিকবার ত্রাণ পেয়ে যাচ্ছেন। 


অথচ তার পাশে থাকা মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে কেহ জিজ্ঞাসাও করছেন না ঘরে কিছু লাগবে কিনা। চুলা ধরানোর জন্য একটি দিয়াশলাই পর্যন্ত কেহ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপদে পড়া মানুষকে দিতে যাচ্ছেন না। ত্রাণ বিতরণে একটা ঘাপলা হয়ে যাচ্ছে। 


নিম্নশ্রেণীর মানুষের ঘরের ৫ জন সদস্যই ত্রাণের প্যাকেট পাচ্ছে। তারা ত্রাণের পেছনেই ছুটছে। মধ্যবিত্তের ঘরে কেহ চুপিও দিচ্ছেন না। ওয়ার্ড মেম্বার বা ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নিচ্ছেন না আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে।  
 

এই বিভাগের আরো খবর