শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘রাজাকারের’ পৃষ্ঠপোষক মুক্ত নাঃগঞ্জ চাই

প্রকাশিত: ১২ জানুয়ারি ২০২০  

যুগের চিন্তা রিপোর্ট : রাজাকারপুত্র বিতর্কে সরগরম নারায়ণগঞ্জ শহর। একাত্তরে যার পিতা শান্তিকমিটি প্রধান হিসেবে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে, পচাত্তরে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে ব্যাক্তি এ শহরে মিষ্টি বিতরণ করেছে, তার পুত্র খালেদ হায়দার খান কাজলের বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) ডিসি এসপির সঙ্গে মঞ্চে অবস্থানকে কেন্দ্র্র করে শহরে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।


সমাজের বিবেকবান মানুষ এ অসামঞ্জস্যতা মেনে নিতে পারছেন না। তারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং এ মহতি অনুষ্ঠানে পিতার কলঙ্কে কলঙ্কিত এ হেন বিতর্কিত ব্যক্তিকে উপস্থাপনের নেপথ্য কুশীলবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।


এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রাজাকারের ছেলের উপস্থিতি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। আর সেই অনুষ্ঠান যদি হয়ে থাকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান তাহলে কোনভাবে আপোষ করারও প্রশ্ন ওঠেনা।


যে মহান নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো সেই মহান নেতাকে ঘিরে অনুষ্ঠিত কাউন্ট ডাউন অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত রাজাকারের সন্তান খালেদ হায়দার খান কাজলের উপস্থিতি, তাকে দিয়ে বক্তব্য দেয়া, তাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা কোনটিই নারায়ণগঞ্জবাসী মেনে নিবেনা।


বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে শপথ  হোক রাজাকারের পৃষ্ঠপোষক মুক্ত নারায়ণগঞ্জ চাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন নারায়ণগঞ্জ শহরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতা বিরোধীদের এড়িয়ে চলা উচিৎ।  যেখানে বিতর্ক হবে সেখানে তাদের না আসাই উচিৎ।’


মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনেয়ার হোসেন বলেন, ‘কাজল কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে থাকে তা আমার বোধগম্য নয়। আমরা বারবারই এই ব্যাপারে বিবৃতি দিয়ে আসছি, তারপরেও কেন তাকে দাওয়াত দেয়া হয়। এসব নিয়ে আমরা সবসময় বিব্রত হই।’  


নাগরিক কমিটি নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. এবি সিদ্দিক বলেন, ‘কাজল যে রাজাকারের ছেলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করছিলাম তখন তার বাবা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কাজলকে ডাকা মোটেও উচিৎ হয়নি। এটা খুব দুঃখজনক।  ডিসি সাহেবের এসব বিষয়ে একটু বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ ছিলো।’


জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘আসলে গোলাম রাব্বানী তো রাজাকার ছিলেন না, তিনি তার চেয়ে বড় শান্তি কমিটি নারায়ণগঞ্জের প্রধান ছিলেন। তবে কাজল মুক্তিযোদ্ধা বান্ধব।’


জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘যেখানে সরকার এদেরকে বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত করেছে সেখানে এমন একটি অনুষ্ঠাতে এদের উপস্থিতি দেখতে পাওয়াটা খুব দুঃখজনক।’


মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ‘আসলে এটা জেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠান ছিলো। জেলা প্রশাসক সাহেব কাকে, কাকে দাওয়াত দেবেন সেটা আমাদের জানা ছিলো না। আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তাই আমি সেখানে উপস্থিত হয়েছি। তাছাড়া এ বিষয়ে আমার কাছে প্রশ্ন না করে জেলা প্রশাসক এবং আনোয়ার সাহেবের কাছে প্রশ্ন করুন।’


জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি, জেলা যুুবলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদির বলেন, ‘আমি তো মনে করি যারা এই সমাজে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তারাই এই কাজলদের সাথে সাথে রাখে এবং বিভিন্ন জায়গাতে পাঠায়।


তবে বঙ্গবন্ধুর একটি অনুষ্ঠানে এটা করা ঠিক হয়নি। যদিও ডিসি সাহেবের অনুষ্ঠান ছিলো কিন্তু আমার মনে হয় ডিসি সাহের এই বিষয়ে সতর্ক ছিলেন না। তবে সামনে যাতে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক থাকেন, তাই কাম্য।’


নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ভবানী শংকর রায় বলেন, ‘আমরা যেখানে একটি রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এমন লোকের উপস্থিতির বিষয়টাকে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই নিন্দা জানাই।’


জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. নুরুল হুদা বলেন, ‘আসলে এটা এলাকার প্রভাবশালীদের ইন্ধনেই হয়েছে। এছাড়া অন্য কিছু নয়। আর এক কথায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এটাকে ঘৃণা করেছি।’


নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের (এনইউজে) সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, ‘আসলে বঙ্গবন্ধু আমাদের গর্ব আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কোন রাজাকারের সন্তানকে আমন্ত্রণ জানানোটা একদম ঠিক হয়নি। তাই প্রশাসনের কাছে আমার আহবান এরপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করলে এসব বিষয়গুলো একটু বিবেচনা করেই যাতে সিদ্ধান্ত  নেয়া হয়।’


সদর উপজেলা মুুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভূঁইয়া জুলহাস বলেন, ‘এটা সরকারি অনুষ্ঠান। তিনিই ভালো জানেন কাজলকে এখানে আনা ঠিক হয়েছে, না হয়নি। আমরা তো এগুলো কিছুই জানিনা। আমাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো, আমরা অনুষ্ঠান দেখে চলে এসেছি। কাজলের বাবা গোলাম রাব্বানী বাবা রাজাকার কিনা, তা চাষাঢ়ার মানুষই ভালো বলতে পারবেন।’


দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ডা.শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি অফিসে যারা দাওয়াত দেন পদ পদবির ভিত্তিতে দাওয়াত দেন। কাজলকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। হয়তো সরকারের উচ্চপর্যায়েও কথাবার্তা হচ্ছে। তবে সহজ সমাধানও করা যায়। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে নিয়ে কাজ করতে। বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকেই একটা নির্দেশনা আসলে ভালো হয়।’

   
মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদা মালা বলেন, ‘আসলে এটা একটা অবাক করার মতো ব্যপার। কারণ এমন একটা অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদকসহ এত বড় বড় লোকের মাঝে নারায়ণগঞ্জের এক নম্বর রাজাকারের ছেলে কিভাবে উপস্থিত থাকেন? আমি জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ জানাই সামনে যেন এই বিষয়গুলোতে একটু ভালো ভাবে নজর দেয়।’


জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি মনে করি সরকারি একটি অনুষ্ঠানে এমন লোকজনকে আমন্ত্রণ করাটা বোধগাম্যহীনতা ছাড়া আর কিছুই না। জেলা প্রশাসক সাহেবের কাছে অনুরোধ যাতে পরবর্তীতে আর কখনোই সরকারি কোন অনুষ্ঠানে এই কাজলকে আমন্ত্রণ না করা হয়।  যেখানে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ভাই, পরিবারের সদস্যরা সুযোগ-সুবিধা পায়না সেখানে কাজল একজন রাজাকারের সন্তান হয়েও সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যপার।’


তবে, কাজলের ব্যাপারে ব্যাতিক্রমি বক্তব্য দিয়েছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আলী। তার বক্তব্যে গোলাম রাব্বানী সম্পর্কে সাফাই গাওয়া হয়েছে এবং তাও সাবেক আওয়ামী লীগ এমপি একেএম শামসুজ্জোহাকে জড়িয়ে। তিনি বলেছেন, জ্জোহা ভাই সহ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমরা তো দেখিনি যে গোলাম রাব্বানী রাজাকার ছিলো। এখন এগুলো কাজলকে ফাঁসানের জন্য বলা হচ্ছে। এছাড়া এটা একটি রাজনৈতিক চক্রান্তও হতে পারে।’


উল্লেখ্য, গবেষক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের বইতে কাজলের পিতা গোলাম রাব্বানী খানকে শান্তিকমিটি সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

এই বিভাগের আরো খবর