মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

যে আলো ছড়িয়ে গেল সবখানে

প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০১৯  

৫অক্টোবর।আজ ত্বকীর জন্মদিন।২৪তম জন্মদিন।জন্মদিন হয় আনন্দের; ফুল, কেক, আনন্দ-কোলাহল বিভিন্ন বিষয় এর সাথে জড়িয়ে থাকে, কিন্তু না ত্বকীর জন্মদিন আমাদের জন্যে এখন আর কোনও আনন্দের বার্তা বয়ে আনেনা; একরাশ বেদনায় আমাদের নিমজ্জিত করে।

 

একজন সচেতন মা সন্তানের মঙ্গল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না।সচেতন ভাবে ‘মা’ তার সন্তানকে আগলে রেখে এক সময় বিশ্ব-দরবারে পৌঁছে দিতে চায়।কিন্তু মায়ের অক্ষমতা ও অপারগতা যে তার জন্য কত কষ্টের আজকে তা আমি প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করি।আমার পক্ষে তো আমার সন্তানকে কোন নিরাপদ রাষ্ট্র, নিরাপদ জনপদ দেয়া সম্ভব হল না, সন্ত্রাসমুক্ত শহর, জন্মস্থান দেয়া সম্ভব হলই না- এটা আমার, আমাদের মায়েদের জন্য নিদারুণ বেদনার। 

 

সন্তানকে যে জন্মভূমিকে আমি ভালোবাসতে শিখিয়েছি, ভালোবেসেছে দেশকে, দেশের মানুষকে। ওতো দেশের জন্য মানুষের জন্য এ সবের মঙ্গলের জন্য বেঁচে থাকতে চেয়েছিল, বিদেশ যেতে চায়নি, দেশে থেকে দেশের জন্য ভাবতে, করতে, বাড়তে, চেয়েছিল।আমরা আমাদের সন্তানদের নিরাপদ পথচলা কামনা করি মনে প্রাণে। 

 

যখন ত্বকী’র জীবনের এক পর্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে বৃহৎ জগতে ঘুরে বেড়াবার সময় এসেছিল, আমি ওকে আমার মাতৃছায়ার বন্ধন থেকে আস্তে আস্তে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর উন্নয়নের বড় রাস্তায় হাঁটার জন্য এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করতে চাইছিলাম। আমার ত্বকী জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে এই আশায়।এ সময় হতভাগ্য দেশের কিছু শত্রু আমাদের বুক খালি করে ত্বকী'কে নির্মমভাবে হত্যা করল। 

 


ত্বকী বেঁচে থাকতে একটা ছড়া ও প্রায়ই শুনতে চাইতো, ‘মন্দরা ছিল মন্দরা আছে থাকবেও চিরকাল, তবুও ভালোর ছোঁয়া লেগে শুভ হোক আগামীকাল।’ এখন আমার কণ্ঠ থেকে কোনো ছড়া, কবিতা বা গান বেরোতে চায় না, কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আমার চোখের জলে কোনো স্মৃতি মুছে যায়নি, ত্বকীর সাথের প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি মুহূর্ত থেকে আমি ফিরে পেতে চাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ত্বকীর সাথে আমার জীবনযাপনের আকাক্সক্ষায়, অথচ যা আর কোনোদিন হবার নয়। 

 

মহাভারতে সন্তান হারা দৌপদী বলেন, ‘ধর্ম তার সন্তানকে যতই সুরক্ষা প্রদান করুক মানুষের নিজের পাপ তার দুর্বলতা হয়েই পড়ে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ অবশ্যই মানুষের দুর্বলতা’। কোন শিশুই খুনি বা কারো শত্রু হয়ে জন্মায়না। সন্তানকে সত্য-অসত্য, শুভ-অশুভ, ভালো-মন্দের শিক্ষার মধ্যদিয়েই তাকে সমাজের, দেশের ও মানুষের করে তুলতে হয়। আর তা না হলে সমাজ ও দেশ মানুষের হয়ে ওঠেনা, পশুতে ছেয়ে থাকে। 

 

বিচারহীনতা ও অপরাধীদের রাষ্ট্র দ্বারা পুরস্কৃত হওয়ার নজিরের অভাব নেই আমাদের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরাও রাষ্ট্র দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছিল। আজ ত্বকীর হত্যাকারীরাও পুরস্কৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন এ অন্যায় অসঙ্গতি তাঁদের চোখে ধরা পড়ে না। ক্ষমতাহীন হলে উপলব্ধিতে আসে। রাষ্ট্রের চরিত্র যেখানে মানবিক হয় না সেখানে এমনি অন্যায় থামানো যায় না। 

 

কিন্তু আমরা বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে মানবিকতা আশা করেছিলাম। একটা বিচারহীনতা অসংখ্য অপরাধের দরজা খুলে দেয়। আমরা যেমনি আমাদের এ দেশটিকে জঙ্গিদের দখলে যেতে দিতে চাই না তেমনি মাফিয়া-গডফাদারদের অভয়ারণ্য হোক এটাও চাই না। প্রলম্বিত অথবা বিলম্বিত-কোনটাই বিচারের জন্য শেষ বিচারে মঙ্গল বয়ে আনে না। 

 

‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ অকালপ্রয়াত কিশোর কবি সুকান্তর মতো ত্বকীর ভূমিষ্ঠ হবার দিন এ অঙ্গীকার আমিও করেছিলাম। সুকান্তের মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মা রোগে আর ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। ত্বকী ‘ডেইলি স্টার’ পুরস্কার নিতে গিয়ে পরিচিতি প্রকাশে জীবনের লক্ষ্য জানাতে গিয়ে লিখেছিল, ‘সততাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন করব।’ যে জীবনের পরিসীমা এতই ছোট যে আঠারোর আগেই পথ ছেড়ে চলেযেতে হয়, সেখানে লক্ষ্য  মুখ থুবরে পড়ে।   

 


ত্বকী অর্থ আলো। আমার আলো একদিন ছড়িয়ে যেত সবখানে। কিন্তু দুর্বৃত্তের দল তা হতে দিল না। আমাদের সব সন্তানই আমাদের জন্য আলো বয়ে আনবে, এইতো আমাদের আকাঙ্খা। আজকে ওরা একটি আলো নিভিয়ে দিয়ে অসংখ্য আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। ত্বকীর আলো আজ সবখানে ছড়িয়ে গেছে। ঘাতকদের ভয়টা আজ এখানেই। 

 

আমি যখনই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করতাম ‘মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’- তখন প্রতিবারই আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিশুসন্তান আপন মনেই বলে চলত ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমাকে দাঁড়াতেই হবে’। দাঁড়াবার মূল্য আমি আজ পেয়েছি। আমাদের এইসব সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্ষার দায়িত্ব-তো রাষ্ট্রের, সমাজের। 

 

কিন্তু বিবেকহীন পশুরা যদি সমাজে আধিপত্য করে তবে মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে বাঁচবে কী করে। আমরাতো ত্বকী, সাগর, রুনি, বিশ্বজিৎ আর তনুদের সংখ্যা কেবল বারতেই থাকুক তা দেখতে চাই না। আর তাই প্রশাসন ও রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছে আবেদন জানাই লোভ আর জিঘাংসা থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে স্বাধীন দেশে মানুষের স্বাধীন পথচলাকে নিশ্চিত করুন। 

 

রওনক রেহানা 

লেখক : তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা

এই বিভাগের আরো খবর