বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

যান্ত্রিক নগরীর ফুসফুস এক টুকরো শেখ রাসেল পার্ক

প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০১৯  

শামীমা রীতা (যুগের চিন্তা ২৪) : বিনোদন আর নিশ্বাঃস ফেলার জায়গা না থাকায় নারায়ণগঞ্জ শহর এসময় অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো নগরবাসীর কাছে। তীব্র যানজট, কালো ধোঁয়া আর উত্তপ্ত রোদে নগরীবাসীর যেন প্রাণ যাওয়ার উপক্রম।


বাতাসে যেখানে নিশ্বাস নেওয়ার অবস্থা নেই, সেখানে বিশুদ্ধ বাতাস আশা করা যেন বিলাসিতা। মানুষের অসহনীয় ভীড় ঠেলে পথ চলে কোথাও দাঁড়ানো ছিলো বেশ কষ্টের। শান্তিতে হাঁটা তো দূরের কথা, এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ানোও বেশ কষ্টের। তবে দেওভোগ ও  জিমখানায় ঢোকার পথেই হঠাৎ যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেলো মনে হয় যে কোন পথিকের।


এক পশলা ঠা-া হাওয়া এসে শরীরটাকে কোন এক যাদুর বলে সতেজ করে দিয়ে যায়। রাজধানীর হাতিরঝিলের আদলে নারায়ণগঞ্জ নগরীতেও যে অমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যায় শেখ রাসেল নগর পার্কে না গেলে সেই অনুভূতিটা কেউই উপলদ্ধি করতে পারবেনা।


যদিও পার্কটির শেষভাগের কাজ বর্তমানে চলমান কিন্তু ইতিমধ্যেই দূষিত নারায়ণগঞ্জের বুকের ঠিক মাঝখানে বিশুদ্ধ বাতাস আর প্রশান্তির আয়োজন করে বসে আছে সবুজ-শ্যামল এই শেখ রাসেল নগর পার্ক। তাই তো শহুরে মানুষগুলো একটু সজিবতা পাবার লোভে, বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসকে উপহার দেবে বলে ছুটে আসে শেখ রাসেল পার্কে।


সাত সকালে, অলস বিকেলে কখনো বা গোধূলি বেলাতেও। নগরবাসীকে এমনই এক স্বস্তির জায়গা উপহার দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) মেয়র ডা.সেলিনা হায়াৎ আইভী। নানা জটিলতা, বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত নগরবাসীকে এই সুন্দর পার্কটি উপহার দিতে চাচ্ছেন তিনি। চলছিলো শেষভাগের কাজ।


সবকিছু ঠিকঠিক থাকলে সামনের বছরই যে কোন সময় হওয়ার কথা উদ্বোধন। তারপরই সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে করে দেয়ার কথা। তবে গেলো সপ্তাহে হঠাৎ এই পার্ক নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃৃপক্ষের দুই অভিযোগের প্রেক্ষিতে নগরবাসী এটিকে দেখছে ফুসফুসের উপর আঘাত হিসেবে।  


সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে ৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ৭ কোটি ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যয়ে শেখ রাসেল নগর পার্কের প্রকল্পের কার্যাদেশ দেয়া হয় রতœা এন্টারপ্রাইজকে। পরবর্তীতে প্রকল্পের কার্যাদেশের ৪ মাস পর গত ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।  


ইতিমধ্যেই ১৯ কোটি  ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৬৮১ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায় পৌঁছেছে। পার্কটি ভেতরে লেকেটির চারপাশে  হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে, পরিবেশ বান্ধব গাছপালা, পশ্চিম পার্শ্বে  ¯্রটি লাইট, পূর্বপাশে ওয়াকিং লাইট নির্মাণ করা হয়েছে।


পার্কটির ভেতরে আগত দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে মিটিং প্যাভিলিয়ন, ভিউয়িং ডেস্ক, ৪১০ মিটার দৈর্ঘ্য, ১৫০ মিটার প্রস্থ লেকটির পাশে দর্শনার্থীদের জন্য তিনটি ঘাটলা এবং লেকটি পারাপারের জন্য একটি নয়নাভিরাম ব্রিজ  তৈরী করে দেয়া হয়েছে। লেকটির সৌন্দর্য্যেবন্ধনের জন্য শেখ রাসেলের একটি ম্যূরাল নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া পার্কটির উন্মুক্তস্থানে যেকোনো ধরণের অনুষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত থিয়েটার তৈরী করে দেয়া হয়েছে।


তবে এখনও পার্কটির ভেতরের কাজ বাকি রয়েছে। পার্কটির ভেতরে রাখা হবে উন্মুক্ত খেলার মাঠ, নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা টয়লেট, সুইমিংপুল, সৌন্দয্যেবর্ধণের জন্য ঝর্ণা (ড্রাই ফাউন্ডেশন) ও সাইকেল লেনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রাখা হবে। প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমের জন্য ইতিমধ্যেই ১৬ কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৬৭ টাকা ব্যয়ের একটি কার্যবিধি জমা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে পার্কের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।


তবে আদৌ  এ পার্কটি পূর্নাঙ্গ রূপ পাবে কিনা তা নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর মাঝে তৈরী হয়েছে সংশয়। গত ৭ অক্টোবর ১৬ একর জমি দখল ও ৪ কোটি টাকা ক্ষতির কথা উলে¬খ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২টি অভিযোগ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।


রেল কর্তৃপক্ষের দায়ের করা অভিযোগে নাসিকের সার্ভেয়ার কালাম মোল্লা, আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার, পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আলমগীর হিরণসহ অজ্ঞাত ৫০/৬০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৭০ বছরের পুরানো স্টাফ কোয়ার্টার ভেঙ্গে গুড়িয়ে প্রায় ১৬ একর জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (এনসিসি)। এমনকি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দখলে বাধা দিতে গেলে তাদের উপরেও এক্সাভেটর (ভেকু) তুলে দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।


জানা যায়, পার্কটি নির্মাণের শুরু থেকেই একাধিকবার বাঁধা প্রদান করে আসছিলো রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১৬ সালে ২৭ মার্চ  অবৈধভাবে রেলওয়ের ৯ দশমিক ৯ একর জমিতে পার্ক নির্মাণের অভিযোগে  রেলওয়ের এস্টেট অফিসের কানুনগো ইকবাল মাহমুদ বাদি হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দুজনকে আসামি (এ কে এম আবু সুফিয়ান ও ঠিকাদার জাকির হোসেন) এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।


সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্রে জানা যায়, পার্ক ও জলাশয়টা সংরক্ষণ করার সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রেলওয়েকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয় । জায়গাটি সিটি করপোরেশনকে দেয়ার পরিকল্পনা হলেও পরবর্তীতে আর হস্তান্তর করা হয়নি। তারা দেই, দিচ্ছি, দিবে করে আজকে দীর্ঘ ১২ বছর কালক্ষেপণ করে। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক ২০১০ সালে ডিটেল এরিয়া প্লান গেজেট ও ২০০০ সালে পৌরসভার জলাশয় আইন সংরক্ষণের আইনানুসারে  জিমখানা এলাকায় পার্ক ও জলাশয় সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।


একটি সূত্র জানিয়েছে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জে ২৩৩ শতাংশ কিছু জায়গা বিক্রি করে দিয়েছে। জিমখানার এ জায়গটিকেও প্লট করে বিক্রি করার জন্য রেলওয়ে ১২ থেকে ১৫ বার টেন্ডার করেছে এবং বিভিন্ন কারণে এ টেন্ডার গুলোর পরে আর হয়নি। এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালে একটি টেন্ডারের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা মামলা করে স্থগিত করে।


নগরবাসীর দাবি, সিটি করপোরেশনের মহতি উদ্যেগে মানুষ নিঃশ্বাস ছেড়ে নির্মল বাতাস নেবার একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছে। এখানে যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক তারচেয়ে বরং জনসাধারণের স্বার্থই বেশি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এখনই যদি কোন থাবা হানা দিয়ে নগরীর ফুসফুস হয়ে ওঠা এই পার্কের কাজ আটকে দিয়ে উদ্বোধনের পথ রুদ্ধ করা হয় তবে হয়ত অচিরেই মানুষ এই সবুজ শ্যামলিমা শেখ রাসেল পার্ককে ইট-পাথরের সুউচ্চ ভবনে ঠাসা এলাকা হিসেবে চিনবে।

 

শেখ রাসেল পার্ক থাকবে সবুজ-শ্যামল আর পাখির কলকাকলিতে মুখর। কোনো ব্যবসায় কেন্দ্র বা উদ্বাস্তুদের থাকার জায়গা হিসেবে নগরবাসী শেখ রাসেল পার্ককে দেখতে চান না। তারা চান নির্মল, সুন্দর সবুজাভ শেখ রাসেল পার্ক।

 

এই বিভাগের আরো খবর