বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মেয়র আইভীর উপর হামলার জন্য দায়ী এমপি শামীম ওসমান !

প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি হকার ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়র ডা.সেলিনা হায়াৎ আইভীর উপর হামলার জন্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানকে দায়ী করা হয়েছে। হামলার ঘটনার দীর্ঘ ২২ মাস ১৮ দিন পর আদালতে মামলা হয়েছে। 

 

নারায়ণগঞ্জ আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ফাহমিদা খাতুনের আদালতে মেয়র আইভীকে মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ এনে বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা জি এম এ সাত্তার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে সদর মডেল থানাকে এজহার হিসেবে গণ্য করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 


শামীম ওসমানের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে মামলায় উল্লেখ : 

সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাতে হকার বসবে মর্মে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান লাগাতার ঘোষণা, হুমকি, প্রশ্রয়, ইন্ধন এবং সামাজিক যোগাযাগের কারণেই এই মামলার আসামিরা ওইদিন এই ঘটনা ঘটানোর সাহস পায় বলে মামলায় উল্লেখ করেন বাদী। এছাড়া উল্লেখ করা হয় মামলার আসামিরা ১৬ জানুয়ারি ওই ঘটনা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের ইন্ধনে ও প্ররোচনাতেই ঘটিয়েছে। শামীম ওসমান প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ফুটপাতে হকার বসবেই বলে  নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনেক চ্যালেঞ্জ করে উস্কানীমূলক বক্তব্য দেওয়াতেই তার অনুসারি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালায়।  


মামলায় আসামি : মামলায় ঘটনার দিন অস্ত্র প্রদর্শনকারী নিয়াজুল ইসলাম খান (৫২), নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম (৪৯), সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল (৪৮), মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সাজনু (৪৬), জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন (৩৫), স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব (৪২), জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন (৩২), যুবলীগ কর্মী নাসির উদ্দিন ওরফে টুন্ডা নাসির (৫২), যুবলীগ নেতা চঞ্চল মাহমুদসহ (৫২) ৯ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত প্রায় ৯০০ থেকে ১০০০ জনকে আসামী করা হয়েছে।

মামলায় ঘটনার দিনের বর্ণনা : ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর নেতৃত্বে বিকেল ৪টার সময় সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র, কাউন্সিলর, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরসহ নাসিকের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত উন্মুক্ত রাখা এবং পথচারীদের নির্বিঘেœ চলাচলের স্বার্তে পায়ে হেটে ‘ফুটপাতে হাটা আমার নাগরিক অধিকার’; ‘হকারমুক্ত ফুটপাত চাই, নির্বিঘেœ হাঁটতে চাই’; ‘হকার মার্কেটে হকার বসিবে, ফুটপাতে জনগণ হাটবে’ ইত্যাদি স্লোগন সম্বলিত প্ল্যাকাডয় নিয়ে একটি গণসচেতনা মূলক কার্যক্রম পরিচালনাকালে তার স্বাতে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণকারী পথচারীদের পদযাত্রা বিকেল সাড়ে ৪টায় বঙ্গবন্ধু সড়কের সায়াম প্লাজার সামেন পৌছালে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আগ থেকে ওত পেতে থাকা মেয়র আইভীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে মামলার আসামি ঘটনার দিন অস্ত্র প্রদর্শনকারী নিয়াজুল ইসলাম খান (৫২), নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম (৪৯), সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল (৪৮), মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সাজনু (৪৬), জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন (৩৫), স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব (৪২), জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন (৩২), যুবলীগ কর্মী নাসির উদ্দিন ওরফে টুন্ডা নাসির (৫২), যুবলীগ নেতা চঞ্চল মাহমুদসহ (৫২) অত্যাধুনিক পিস্তল, রিভলবার, শর্টগান ও দেশীয় অস্ত্রসহ অজ্ঞাতনামা তাদের মতো ৯০০ থেকে ১ হাজার সন্ত্রাসী চারদিক থেকে অতর্কিত হামলা চালায় এবং শান্তিপূর্ণ পথযাত্রায় বৃষ্টির মতো ইট, পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। 


এতে মামলার আসামিরাসহ অন্যান্যরা গুলি করে। এত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা/ কর্মচারী, কাউন্সিলর, সাংবাদিক, জেলা পরিষদ সদস্য, মেয়রের নিককাত্মীয়, সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের প্রায় ৪৩জন গুরুতর আহত হন। ছাড়া প্রায় শতাধিক আঘাত প্রাপ্ত হন। 


ঘটনার সময় মেয়রের সামনে থাকা লোকজন মানবঢাল তৈরি করে মেয়রকে রাক্ষা করেন। সাধারণ মানুষের সহায়তায় মেয়রসহ নাসিক কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু সন্ত্রাসীদের এমন কর্মকান্ডে নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী অসুস্থ্য হয়ে ঢাকায় ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়। এবং সেখানে তরা হার্ট ও ব্রেইনের নানা প্রকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্রেইনে রক্তজমাট বাধায় বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়। 


ল্যাবএইডের ডাক্তারগণের বোর্ড সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুচিকিৎসায় মেয়র প্রাণে রক্ষা পান।  নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, মামলা স্বাক্ষীসহ স্থানীয় লোকজনের উপর হামলা করে রক্তাক্ত জখমসহ প্রাণনাশের চেষ্টা করায় আসামিদের বিরদ্ধে বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ১৪৩/১৪৪/১৪৯/৩২৩/৩২৬/৩০৭/৩৪ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়। 


মামলা দায়েরের দেরীর কারণ :  ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি এই হামলার ঘটনার ৫দিন পর ২২ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ একটি এজহার দায়েক করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা জি এম এ সাত্তার। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই এজহারটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ না করে জিডি হিসেব অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এবং মৌখিকভাবে বলেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 


পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন প্রকার আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এবং জিডি হিসেবে লিপিবদ্ধ করায় চলতিবছরের ১৭ এপ্রিল পুলিশ সুপার বরাবর সুস্পষ্ট প্রমাণসহ দরখাস্ত দাখিল করেন। তাতেও কোন ফল না হওয়ায় উচ্চ আদালতে রীট পিটিশন দায়ের করেন।
উচ্চ আদালতের আদালতের বিচারক এম এনায়েতুর রহিম ও মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান এর গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ ১ ডিসেম্বর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নারায়ণগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের নিদের্শ মতে বুধবার নারায়ণগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত শুনানী শেষে বিকেলে এই আদেশ দেন।


কেন ফুটপাতে হকার বসার ব্যাপারে নাসিকের এতো আপত্তি : মামলায় উল্লেখ করা হয়, নারায়ণগঞ্জ মূল রাস্তায় ও ফুটপাতে হকার বসে নাগরিকের চলাচলে যেন বিঘœ ঘটাতে না পাওে জনস্বার্থে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে ১৯ এপ্রিল একনেকের সভায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় হতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাছে বক্তব্য চাওয়া হলে নাসিক একান্ত বাধ্য হলে সিটির বঙ্গবন্ধু সড়কের দুই পাশে হকার না বসার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে (যদিও বিষয়টি নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে চলমান ছিল)। এবং ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু সড়ক হকারমুক্ত করা হয়।  


সেই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ সেলিম ওসমান হকারদের পক্ষে শর্তসাপেক্ষে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফুটপাতে হকার বসার দাবি সম্বলিত দরখাস্তের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে ১৪ জানুয়ারি নাসিক প্রধান নির্বাহী জবাব প্রদানসহ শহরের ফুটপাতে সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে সাংসদেও মানবিক উদ্যোগের প্রতিশ্রুতিশীল থেকে ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামের বর্ধিত অংশ, প্রেসক্লাবের পেছনে রাজউকের কারপার্কিয়ের জায়গায় প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত হকার বসার ব্যাপারে নাসিকের সম্মতি প্রদান করেন। নারায়ণগঞ্জ শহরে হকার সমস্যা একটি দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা। নগরবাসী দীর্ঘদিন যাবত হকারমুক্ত ফুটপাত মুক্ত ফুটপাতের দাবি জানিয়ে আসছে।


সেই কারণে সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হকারদেও পুনর্বাসনের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনায় নিয়ে শহরের যানজট নিরসন ও ফুটপাত দিয়ে জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে ২০০৮ সালে চাষাঢ়া এলাকার নবাব সলিমুল্লাহ রোডের রাজউকের ৫০ শতাংশ ভূমিতে (সিএস রেকর্ড মূলে মালিক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন) ৬৭২জন হকারদের দোকান বরাদ্দ দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। 
সেইসময় ৩৩৯ জন হকারকে নবাব সলিমুল্লাহ রোডের মেডিস্টার ক্লিনিক সংলগ্ন রাজউকের জমিতে (সিএস রেকর্ড মূলে মালিক নাসিক) পুনর্বাসন করা হয়। এছাড়াও ২০০৯ সালের সিরাজউদ্দোলা রোডের পাশে ১১১ জন হকারকে এবং ২০১০ সালে ডিআইটি সংলগ্ন নয়ামাটি রোডের পাশে প্রায় ৩০০ জন হকারকে অস্থায়ী ভাবে বসানো হয়। এইভাবে পুনর্বাসিত ১৪২২ জন হকার ছাড়া সেসময় শহরে আর কোন হকার ছিলোনা। কিন্তু রাজউকের ওই জমি আত্মসাত ও চাঁদাবাজির হীন উদ্দেশ্যে ভূমি দস্যু একটি চক্র গভীর চক্রান্তে ও ইন্দনে হকাররা পুনরায় বঙ্গবন্ধু সড়কের উভয়পাশে ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে চারসারিতে রাস্তার অংশ ও ফুটপাত দখল কের মালামালের স্তুপ শুরু করে। 


ফলশ্রুতিতে শহরে যানজট, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এবং ফুটপাতে জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত ও বিঘœতার সৃষ্টি হয়। নাসিক মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমাবায় মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ও জনস্বার্থে বঙ্গবন্ধু রোড উন্মুক্ত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এরধারবাহিকতায় শহরের যানজট নিরসন ও ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করতে নারায়ণগঞ্জ সিটির করপোরেশন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। 


এছাড়া নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাত ও রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত রাখা শিরোনামে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর রাস্তা ও ফুটপাতের জন্য নাগরিকদের দুরবস্থার বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে একটি অনুরোধপত্র পাঠানো হয়। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ সেলিম ওসমানকেও  নাসিকের চিঠির জবাব পাঠায়। 


এছাড়া প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে নাসিকের মেয়রের একাধিকবার ফোনালাপ হয়। কিন্তু সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাতে হকার বসবে মর্মে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান লাগাতার ঘোষণা, হুমকি, প্রশ্রয়, ইন্ধন এবং সামাজিক যোগাযাগের কারণেই এই মামলার আসামিরা ওইদিন এই ঘটনা ঘটানোর সাহস পায় বলে মামলায় উল্লেখ করেন বাদী।
 

এই বিভাগের আরো খবর