শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মন্দা যাচ্ছে চিড়ার ব্যবসা, বাড়ছে মুড়ির কদর

প্রকাশিত: ৪ মার্চ ২০২০  

বাঙ্গালীর সৌখিন খাবার ছিল চিড়া, মুড়ি, দই, খই। বর্তমানে সময় পাল্টাচ্ছে মানুষের রুচিবোধও পাল্টাচ্ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের চলার পথ দৃঢ় থেকে দৃঢ় হয়ে উঠছে। মানুষ আগে পায়ে হেটে গন্তব্যে যেত আর এখন যানবাহন-এর প্রয়োজন হয়। তেমনি মানুষের গন্তব্য ছাড়াও রয়েছে খাবার, রূপ-রঙ ও সাজসজ্জা। 

 

একসময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ত্রান শুকনো খাবার হিসেবে চিড়া দেয়া হতো এমনিতেই চিড়া খাওয়ার প্রচলন আগে থেকেই ছিল বাঙ্গালীর মধ্যে। দিনে দিনে চিড়া খাওয়ার প্রচলন কমে যাচ্ছে বাংলাদেশে। নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় অবস্থিত চিড়া’র মিল থেকে বিভিন্ন জেলায় চিড়া সাপ্লাই করা হতো। ফতুল্লার বিভিন্ন চিড়া’র মিলে খবর নিয়ে জানা যায়, মন্দা যাচ্ছে চিড়া’র ব্যবসা। চিড়া খাওয়ার প্রচলন কমে গেলেও বাড়ছে মুড়ির কদর।

 

ফতুল্লায় চিড়া মিলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-শাহজাহান চিড়ার মিলস, খাজা বাবা চিড়ার মিলস ও দাপা শৈলকূড়ায় রয়েছে বেশ কয়েকটি মুড়ির মিলস। চিড়া কেজি প্রতি ৪০/৪২ টাকা পাইকারী ও মুড়ি কেজি প্রতি ৫০/৪৫ টাকা পাইকারী মূল্যে বিক্রয় করা হয়। এক মণ ধানে ২৮/৩০ কেজি মুড়ি তৈরি হয়। মুড়ির খুচরা মূল্য কেজি প্রতি ৫০/৬০/৭০ টাকা স্থানভেদে বিক্রি করা হচ্ছে। ঝালমুড়ি ও চানাচুর মিনি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মহল্লায়, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ফেরি করে ঝালমুড়ি ও চানাচুর বিক্রি করছে। এ কারণে চিড়ার চেয়ে মুড়ির চাহিদাটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

খাজা বাবা চিড়ার মিল মালিক দিলীপ ঘোষ জানান, চিড়া এখন তেমন বিক্রি হচ্ছেনা। মুদি দোকানীদের এখন আর চিড়ার চাহিদা নেই। একমাত্র চানাচুর মিল মালিকরা দুই ধরনের চিড়া নিচ্ছে। তবে কাঁচা চিড়ার চেয়ে ভাজাঁ চিড়ার বেশি চাহিদা রয়েছে।

 

মুড়ির কদর বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে প্রবীণ মুড়ি ব্যবসায়ী মো. কুটু মিয়ার সাথে কথা হলে তিনি জানান, বর্তমানে বস্তায় বস্তায় মুড়ি ঢাকা, বরিশাল, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন বাজারগুলিতে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিনই ফতুল্লা থেকে লঞ্চ ও ট্রলার এর মাধ্যমে নৌপথে পাঠানো হচ্ছে।  

 

অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ফতুল্লায় চিড়ার জন্য অনেক সুনাম রয়েছে এ অঞ্চলের। তাছাড়াও স্থানভেদে মানুষের মুখে মুখে কিছু অঞ্চলের বিশেষত্ব নিয়ে আসে সমাজের সামনে যেমন-রামপালের কলা, বগুড়ার দই, কেন্দুয়ার ঘোল, পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, নারায়ণগঞ্জ-এর বোস কেবিনের চা, পাগলনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরোটা, সিরাজগঞ্জ-এর উল্লাপাড়ার ঘি, মুক্তাগাছার মোন্ডা, টাঙ্গাইলের নারান্দিয়ার পাড়া গুড়, শেরপুরের লাফা বেগুন, ফরিদপুরের খেঁজুরগুড়, ব্রিটিশ আমলের কালিয়াকৈরের ধনী রানীর চিড়ার পাশাপাশি ফতুল্লা চিড়ারও যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। বর্তমানে ফতুল্লার চিড়ার সুনাম থাকলেও তেমন বিক্রি হচ্ছেনা। মানুষের রুচির সাথে সাথে চাহিদারও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। 

 

একসময় গ্রামগঞ্জে মহিলাদের হাতে ভাজা মুড়ি খুব মুখরোচক ছিল। এখন আর সেই মুখরোচক হাতে ভাজা মুড়ি তেমন এখটা দেখা যায় না। তবে মুড়ি পাওয়া যায় সেটা মিল কারখানার তৈরি যা দইয়ের সাধ ঘোলে মিটানো হচ্ছে। আর এইসব মুড়ি কারখানাগুলোতে একশ্রেণি অসাধু ব্যবসায়ীরা মুড়ি সাদা করার জন্য একধরনের কৃত্রিম মেডিসিন ব্যবহার করছে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

 

ফতুল্লা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো.শাহজাহান ভূইয়ার সাথে আলাপ করলে জানা যায়, ফতুল্লার চিড়ার যে ঐতিহ্য তা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। চিড়ার বর্তমানে চাহিদা না থাকায় চিড়ার চেয়ে মুড়ির উৎপাদন অনেকটা বেশি। তবে বর্ষাকালে চিড়ার চাহিদা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। নৌপথে দূরাগত চলাচলকারী যাত্রীরা ও বন্যাদূর্গত এলাকায় ত্রাণ শুকনো খাবার হিসেবে চিড়া গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এই ব্যবসায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ এর মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ধানের মূল্য বৃদ্ধিতে চিড়া ও মুড়ির উৎপাদনে তেমন আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন চিড়া ও মুড়ি মিল মালিকরা। এভাবে ধান, গ্যাস, ও বিদ্যুৎ-এর মূল্য বৃদ্ধি পেলে মুড়ি ও চিড়ার উৎপাদন ব্যাহত হবে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।

 


রণজিৎ মোদক
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব 

এই বিভাগের আরো খবর