শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় দেড় মাসে ২ নবজাতকসহ ৯ জনের মৃত্যু

প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় নারায়ণগঞ্জে বেড়েই চলেছে মৃত্যুর ঘটনা। গত দেড়মাসে  জেলার বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিক ও  ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ২ নবজাতকসহ তিনজনের।  


সংশ্লিষ্টদের মতে, ভুল  চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহলোয় মৃত্যুর হার বাড়লেও দেশের প্রচলিত আইনে দায়ী চিকিৎসক ও হাসপাতাল মালিকদের যথাযথ শাস্তি দেওয়ার তেমন নজির নেই। জবাবদিহিতা না থাকার ফলে একশ্রেণীর চিকিৎসক ও হাসপাতাল ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম দিন দিন বাড়ছে।


গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, ১৭ অক্টোবর সোনারগাঁ উপজেলার মোগরাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় ‘পুরাতন সেবা জেনারেল হাসপাতাল’ নামে এক ক্লিনিকে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।  জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকালে মোগরাপাড়া চৌরাস্তার রহমত ম্যানসনের সেবা জেনারেল হাসপাতাল নামের ক্লিনিকে ভর্তি হন।  

 

সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র সার্জারি কনসাল্ট্যান্ট রিয়াজ মোর্শেদের তত্ত্ববধানে ভর্তি হওয়ার পর বিকেল তিনটার দিকে ওই রোগীর অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। রোগীর স্বজনরা রোগীর অবস্থা জানতে চাইলে অপসারিত পিত্তথলির পাথর এনে দেখিয়ে রোগী ভাল আছেন বলে জানান। এক পর্যায়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই ডাক্তার রোগীকে আইসিওতে রাখতে হবে।

 

ডাক্তারের কথা শুনে আতংকিত হয়ে ওই রোগীর ফুফু সাবিকা পারভীন জোরপূর্বক অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে রোগীর মুখ দিয়ে ফনা বের হচ্ছে দেখতে পান। পরে রোগীকে ইকরাম নামের এক ডাক্তারের মাধ্যমে সিদ্ধিরগঞ্জ প্রি অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে মৃত ঘোষণা করলে সঙ্গে থাকা সেবা জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার ইকরাম ওই রোগীকে রেখে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর রোগীর স্বজনরা রাতে উত্তেজিত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে ভাংচুরের চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।


এরআগেও সোনারগাঁয়ের দুটি হাসপাতালে দুজন রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরে অভিযান চালিয়ে ৬টি হাসপাতাল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় সিভিল সার্জন ডা.ইমতিয়াজ।


একই দিন সকালে রূপগঞ্জে ভুলতা জেনারেল হাসপাতালে ফাতেমা নামে এক প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। জানা যায়, বুধবার রাতে ফাতেমাকে ডেলিভারী করতে ভুলতা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসলে তাকে সিজার ডেলিভারি করানো হয়। কিন্তু সিজার করানোর সময় ডা.নাসরিন ভুলক্রমে তার রগ কেটে ফেললে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফাতেমার মৃত্যু হয়।

 

এ ঘটনায় উত্তেজিত এলাকাবাসী হাসপাতালে হামলা চালিয়ে ওই হাসপাতাল ভাংচুর করে ও পরে ঢাকা সিলেট মহাসড়কে অবরোধ করে হাসপাতালটি বন্ধের দাবি জানায়।


এর একদিন আগে গত ১৬ অক্টোবর বুধবার বন্দরে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর  অভিযোগ উঠে। জানা যায়, জেলার বন্দর থানাধীন ২০নং ওয়ার্ডের মাহমুদনগর এলাকার কামরুল হাসানের প্রসূতি স্ত্রী মুন্নী বেগমকে মঙ্গলবার বেলা ২টায় বন্দর শাহী মসজিদ এলাকার কথিত নার্স জেসমীন আক্তার মুক্তির নামধারী ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।

 

রাতে গৃহবধূর প্রসব বেদনা দেখা দিলে নার্স জেসমীন তাকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আনার পরামর্শ দেন। জেসমিনের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর স্বজনরা হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার পর রোগীর অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে ওঠে।


এ সময় ক্লিনিক প্রধান জেসমীন ও তার সহযোগীরা প্রসূতিকে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের চেষ্টায় কাপড় দিয়ে শিশুটির মাথায় টানাটানি করলে এক পর্যায়ে  শিশুটি গর্ভেই মারা যায়।  এ ঘটনার পর ক্লিনিকটিকে  নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সিলিগালা করে দেয়া হয় ।


অন্যদিকে ১১ অক্টোবর ফতুল্লার মুসলিম নগর নয়াবাজারে ‘জনপ্রিয় ফার্মেসি’ নামক ঔষধের দোকানে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, ১০ অক্টোবর ‘জনপ্রিয় ফার্মেসি’র মালিক ফার্মাসিস্ট রহিম তার স্ত্রী ও একজন ভাড়া করা নার্সকে দিয়ে এক প্রসূতির সিজার করানো হলে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।

 

শিশুটির অবস্থা বেগতিক দেখে ফার্মেসির মালিক রহিম  শিশুটি বাবা ইউনুসকে ফোন করে জানায় শিশু ও তার মায়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেই রাতেই মা ও শিশুকে ফতুল্লা মোস্তাফিজ সেন্টারে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়। শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে চিকিৎসকরা তাকে মাতুয়াইল হাসপাতালে রেফার্ড করে। মাতুয়াইল হাসপাতালে নেয়ার পর, সেখান থেকে মা ও শিশুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান কর্তব্যরত চিকিৎসক।


পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে বাধা দেয় ফার্মসিস্ট আব্দুর রহিম। এরপর তাদেরকে মাতুয়াইল শিশু হাসাপাতালের পাশে ফ্রেন্ডশিপ স্পেশালিস্ট হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে গত ১১ অক্টোবর রাতে শিশুটি মৃত্যুবরণ করে। ফ্রেন্ডশিপ স্পেশালিস্ট হসপিটাল ডায়াগনস্টি সেন্টারের মৃত্যু সনদে, প্রসবকালীন সময়ে শিশুটির ঘাড়ে আঘাতের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। 


সেপ্টেম্বরও ভুল চিকিৎসা আর ডাক্তারের অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।  নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তারে ভুল চিকিৎসা ও ক্লিনিকের অবহেলায় মিলি বেগম (২৮) নামে গৃহবধূর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। নিহত মিলি বেগম ফতুল্লা থানাধীন শিবুমার্কেট পশ্চিম লামাপাড়া এলাকার মো. শাহ আলমের স্ত্রী।


শাহ আলম জানান, মিলির কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রচন্ড মাথা ব্যথার জন্য মেডিসিন ও ¯œায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাহের আলীকে দেখাই। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী রাত পৌনে ১১টায় কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ব্যাথা না কমায় সোমবার ৩টার দিকে আবারও ডাক্তার ডাকতে গেলে হাসপাতালের লোকজন আবারও ওষুধ আনতে পাঠায়।

 

ওষুধ নিয়ে আসার আগেই আমার স্ত্রীকে হাসপাতালের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে  দ্রুত  হাসপাতালের বিল পরিশোধ করার জন্য বলে। হাসপাতালের স্টাফরা জানায় ‘আপনার স্ত্রীর অবস্থা খারাপ ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে বলে জানান। পরে বিল পরিশোধ করার পর হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলে আমার স্ত্রী মারা গেছে।


শাহ আলম অভিযোগ করেন, ওই ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা ও টাকার জন্য হাসপাতালের লোকজন আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে। হাসপাতাল থেকে সকালে ঢাকা নিতে দিলে আমার স্ত্রী মরে না। ওরা টাকার জন্য আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলছে। আমি এর বিচার চাই।
গত ২১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) নারায়ণগঞ্জ শহরের ডনচেম্বারস্থ সেলিনা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ উঠে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের গাইনী কনসালটেন্ট ডা. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে।

 

 নিহত ওই প্রসূতির নাম খাদিজা (২০)। স্বজনদের অভিযোগ, রাত সাড়ে ১১টায় সিজারিয়ানে ওই রোগীর ডেলিভারির পর ইনজেকশন  দিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক  রোগীর খিচুনী উঠলেও তাকে অন্য কোথাও রেফার করেননি ডাক্তার। রাতের কোন একসময় রোগীর মৃত্যু হলে ভোর রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণের নির্দেশ দেন ওই গাইনী ডাক্তার।


এদিকে রোগী মৃত্যুর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে রোগীর স্বজনদের ভয় দেখিয়ে একটি সাদা কাগজে জোর করে সই করিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলীনূর শরিফের বিরুদ্ধে।


এর আগে বন্দর উপজেলার আলীনগর এলাকার খোকন মিয়ার মেয়ে গৃহবধূর পান্না আক্তার (২০) এর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। ২০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সোনারগাঁয়ে মোগড়াপাড়া রয়েল হাসপাতালে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় সুলতানা প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। মৃত সুলতানা  উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের ভবনাথপুর এলাকার মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী।

 

এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর  নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ভুল চিকিৎসায় আমান্তিকা (২০) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ক্লিনিক ভাংচুর করে রোগীর বিক্ষুব্ধ স্বজনরা।  পরে এ ঘটনায় ১০ সেপ্টেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় নিহতের স্বামী মো পিন্টু মিয়া বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।


এদিকে ভুল  চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহলোয় মৃত্যুর হার বাড়লেও দেশের প্রচলিত আইনে দায়ী চিকিৎসক ও হাসপাতাল মালিকদের যথাযথ শাস্তি দেওয়ার তেমন নজির নেই। জবাবদিহিতা না থাকার ফলে একশ্রেণীর চিকিৎসক ও হাসপাতাল ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম দিন দিন বাড়ছে। শহরের যত্রতত্র অনুমোদনহীন অসংখ্য ক্লিনিক,ডায়গনস্টিক সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে।

 

এমনকি এইচএসসি পাশ, কখনও কাঠের ব্যবসা কিংবা পানি সাপ্লাইয়ের কাজে নিয়োজিত ওয়ার্ডবয়ও এমবিবিএস ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দিনের পর দিন রোগী দেখার নজিরও রয়েছে । আবার কখনও ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে কর্মীরাই রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছেন। 


এমনকি নিজেদের দোষ ঢাকতে অভিভাবক, স্বজনদের হুমকি দেওয়াসহ নানা ধরনের কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছেন। এর ফলে প্রায়ই হাসপাতালে ভাঙচুর, হাতাহাতিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। 

 

নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ইমতিয়াজ আহমেদ যুগের চিন্তা ২৪ কে জানান,এ ঘটনাগুলো সম্পর্কে ইতিমধ্যেই আমি অবগত হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।  আসলে কি কারণে এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
 

এই বিভাগের আরো খবর