বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

বৃটিশ ঔপনিবেশ শাসন থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাক্কালে অবিভক্ত ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিদ স্বাধীন ভারত এবং স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন। ১৯৪৪ সনে কোলকাতাস্থ রেনেসাঁ সোসাইটি ঘোষণা দেয় পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। ১৯৪৭ সনের জুন মাসে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদ হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার অভিমত ব্যক্ত করেন।

 

এর প্রতিবাদে বিখ্যাত পন্ডিত ও ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কোলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ব্যবহার সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়ে প্রবন্ধ লিখেন।  সেই সময় তৎকালীন প্রগতিশীল লেখক জামাল জাহেদী, আবদুল হক, কবি ফররুখ আহমেদ, আবুল মনসুর আহাম্মদ প্রমুখ কোলকাতায় দৈনিক ইত্তেহাদÑএ বাংলা ভাষার স্বপক্ষে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেন। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নেতা মোঃ শামছুল হক বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা করার রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশ করেন।

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছু দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় তমুদ্দন মজলিশ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। তমুদ্দন মজলিশ বাংলাকে প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রকাশনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এ সময় গঠিত হয় যুবলীগ, শেখ মুজিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম ছাত্রলীগ এবং অধ্যাপক নূরুল হক ভূইয়াকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

 

১৯৪৭ সনের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন মোঃ সামছুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, মোঃ তোহা, রনেশ দাস গুপ্ত ও অজিত গুহসহ অনেকে। এতে সভাপতিত্ব করেন তমুদ্দন মজলিশের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেম। 

 

স্মরণযোগ্য যে, এটাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের প্রথম সাধারণ সভা। ১৯২৮ সনের দিকে নাইট-নবাব, খান বাহাদুর, সরকার ও সরকারের কর্ম কর্তাদের মতামত উপেক্ষা করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তৎকালীন ধনবাড়ীর জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিবৃতি দিয়েছিলেন আমাদের মাতৃভাষা উর্দু নয় বাংলা হবে (রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)।


         
১৯৪৮ সনের ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত গণ পরিষদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা গ্রহণের প্রস্তাব নাকচ করা হয়। প্রস্তাবের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অথচ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৫৬%) নাগরিকের ভাষা ছিল বাংলা ভাষা। আর প্রায় ৪% নাগরিকের ভাষা ছিল উর্দু। অন্যরা পাঞ্জাবি, সিন্দি ও বেলুচসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতো।

 

পাকিস্তান গণপরিষদে শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাভাষার প্রস্তাব নাকচ হওয়ার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট হয়। ভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত ভাষা দিবসে ১১ মার্চ ঢাকায় বিক্ষোভ এবং ১৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। ১৯৪৮ সনে আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি’ গঠন করা হয়। শেখ মুজিবসহ অনেককে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

 

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোঃ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসার পূর্বে পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য কৌশলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে।


 
১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্ট বৃটিশ ঔপনিবেশ শাসন থেকে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শাসন ও শোষণের লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে। এই উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশ শাসন ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়গুলো একে একে বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা চাপিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

 

এ লক্ষ্যে প্রথমেই তারা বাঙালির মাতৃভাষার উপর আঘাত করে। ১৯৪৮ সনে ২১ মার্চ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) সংবর্ধনা সভায় ও ২৪ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন উৎসবে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোঃ আলী জিন্নাহ অবিবেচকের মত ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। উপস্থিত বাঙালি বীর সন্তানদের মধ্য থেকে জিন্নাহর অযৌক্তিক ঘোষণার প্রতিবাদ করে বলা হলো, ‘না, না’। তাঁদের মধ্যে আব্দুল মতিন ও আঃ হকের নাম উল্লেখযোগ্য।

 

১৯৫০ সনের ৪ ও ৫ নভেম্বর ঢাকায় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়। আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর ১৯৫২ সনের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ছাত্রদের সাথে চুক্তির বিশ্বাস ও শর্ত ভঙ্গ করে পল্টন ময়দানে জনসভায় ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহর বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করেন।

 

৩০ জানুয়ারি এর প্রতিবাদে ধর্মঘট হয় এবং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে। ৩১ জানুয়ারি কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে পতাকা দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতা ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। উক্ত সমাবেশে মাওলানা ভাসানী ও মুসলিম লীগের আবুল হাসেম ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে আমরণ অনশনরত অবস্থায় কারাবন্দি শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমেদকে ফরিদপুর জেলখানায় স্থানান্তর করা হয়।

 

নূরুল আমিনের সরকার ভয়ে সমগ্র ঢাকা জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট সফল করার বিষয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে সম্মত হলেন না। সর্বপ্রথম এস.এম. হলের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেয়। বৈঠকে ১৫ জন বিশিষ্ট ছাত্রনেতার মধ্যে মাত্র  ০৪ (চার) জন দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব’। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অলি আহাদ, আব্দুল মতিন ও গাজিউল হক।


 
২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২টায় গাজিউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। মো. সামছুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার মতামত দিলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে উঠে। সামছুল হক সাথীদের নিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে ছাত্ররা দশজনী মিছিলের মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।

 

বেলা প্রায় ৩টার সময় সরকারের মন্ত্রী, এমএলএ গণ পার্লামেন্টে যাওয়ার সময় ছাত্ররা চরম উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পুলিশ ছাত্রদের উপর আক্রমণ শুরু করে এক পর্যায়ে গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হয় রফিক, জব্বার, বরকত,  আহত হয় অনেকে। আহত অবস্থায় পরে অনেকে মারা যান। ঢাকা শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে অফিস আদালত বন্ধ হয়ে বিভিন্ন মহল্লা থেকে সংগ্রামী জনতা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে করতে মেডিকেল কলেজের দিকে আসতে থাকে। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবীতে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেনÑ রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার ও শ্রমিক আব্দুল আউয়ালসহ অনেকে।

 

২২ ফেব্রুয়ারি জানাজা শেষে অলি আহাদের বক্তৃতার পর লক্ষ জনতার মিছিল বের হয়। মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠিচার্জ করে ব্যর্থ হয়। পরে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে মিছিলে গুলি চালালে মারা যায় হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। ভাষার জন্য এই মহৎ আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঙালি সন্তানেরা সমগ্র পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন একমাত্র বাঙালি জাতিই মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে। এই ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালি সাহসী হয়ে উঠে এবং জাতি তার স্বাধিকার ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।


 
নারায়ণগঞ্জে ১১ মার্চ ভাষা দিবসে বিক্ষোভের দিন সকালে রাজনীতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র খান সাহেব ওসমান আলীর বাসভবন চাষাঢ়া বায়তুল আমান থেকে মিছিল বের হয়ে চাষাঢ়াস্থ সরকারি খাদ্য অফিসের (বর্তমান সোনালী ব্যাংকের স্থানে) সামনে মিছিলকারীরা পিকেটিং শুরু করে। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্ররা এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে মিছিলকারীরা খাদ্য বিভাগের কর্মচারিদের অফিস থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাতে থাকেন।

 

পুলিশ এসে এ সময় মিছিলকারীদের হটিয়ে দিতে চেষ্টা করে। মিছিলকারী ছাত্ররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে ও অনেকে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। এই সময় পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। খান সাহেব ওসমান আলী ও আলমাছ আলী সংবাদ পেয়ে ছুটে এসে পুলিশ বাহিনীকে ছাত্রদের প্রতি তাদের আক্রমণ থেকে বিরত করেন এবং ছাত্রদের সাথে খান সাহেব ও আলমাছ আলী একাত্মতা ঘোষণা করেন।


 
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ভাষার দাবিতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিরাট মিছিল শেষে রহমত উল্লাহ্ ক্লাব চত্বরে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এ.কে.এম. শামসুজ্জোহা (৭০ সনে এম.এন.এ নির্বাচিত) বক্তৃতা করেন, মোঃ বজলুর রহমান, মোস্তফা সারোয়ার, শামসুল হুদা, সুলতান মাহমুদ মল্লিকসহ অনেকে।


এইভাবে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে মিছিল, সভা, সমাবেশ ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান চলতে থাকে। ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে মফিজ উদ্দিন আহমেদ  (দেওভোগ পাক্কা রোড) ও আজগর হোসেন ভূইয়া (খানপুর) কে যুগ্ম আহ্বায়ক করে নারায়ণগঞ্জে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন এ.কে.এম. শামসুজ্জোহা। পাশাপাশি গঠিত হয় ভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় কর্মী শিবির। যার আহ্বায়ক ছিলেন আব্দুল গফুর চৌধুরী, এর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন আলমাছ আলী।


 
২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটকে সফল করার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতাকে উৎসাহ ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য খান সাহেব ওসমান আলীর বায়তুল আমান বাসভবনে গভীর রাত পর্যন্ত বসে কতিপয় সাথীকে নিয়ে সুন্দর ও চমৎকার পোস্টার লিখতেন মোস্তফা মনোয়ার (বিটিভি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কবি গোলাম মোস্তফার ছেলে)। ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সমগ্র নারায়ণগঞ্জ শহর পোস্টারে ছেয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বিরাট মিছিল শহর প্রদক্ষিণ শেষে ঢাকা থেকে আগত আবুল হাশিম (বদরুদ্দিন ওমরের পিতা) সাহেবের সভাপতিত্বে রহমত উল্লাহ্  ক্লাবের সামনে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

 

সভায় বক্তৃতা করেন আলমাছ আলী, মোস্তফা সারোয়ার, বজলুর রহমান, কাজী মজিবুর রহমান এবং আরও অনেকে। নারায়ণগঞ্জের সভায় ঢাকায় পুলিশের গুলি বর্ষণের খবরটি প্রচারিত হবার সাথে সাথে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র-জনতা প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাৎক্ষণিক এক বিরাট মিছিল শীতলক্ষ্যা বিধৌত নারায়ণগঞ্জ শহরকে প্রকম্পিত করে তোলে। সারা শহরে উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।


 
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে  ২২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল সফল করার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জে নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে একেএম শামসুজ্জোহা ও শফি হোসেন খানের অনমনীয় দৃঢ়তায় তা সফল হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালের দিন বাবুরাইলের মশগুল মাহফিল (সামাজিক সংগঠন) এর উদ্যোগে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ শেষে রহমত উল্লাহ ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, আফজাল হোসেন (৭০ নির্বাচনে এম,পি,এ নির্বাচিত) ও মোঃ হাসান (সোনাকান্দা)সহ অনেকে।


 
ঐ মিছিলে ছবি তুলতে গিয়ে মোস্তফা মনোয়ার তার ক্যামেরাসহ গ্রেফতার হন। ঐ দিন বিকেলে বর্তমান মহিলা কলেজের জায়গায় শ্রমিক নেতা ফয়েজ আহম্মদ এর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় একেএম সামসুজ্জোহা, শফি হোসেন খান, এএসএম সোলায়মান, নাজির মোক্তার, সুলতান মাহমুদ মল্লিক, মো. জানে আলম প্রমুখ বক্তৃতা করেন। 


বিভিন্ন কর্মসূচিতে উল্লেখিত ব্যক্তিগণ ছাড়াও ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অবদান রেখেছেন তারা হলেন, এমএনএ আবদুল আউয়াল, জামিল আহমেদ, খাজা জহির, বশির উদ্দিন সরদার, দাইমুদ্দিন আহম্মেদ, আক্কাস আলী, মশিউর রহমান, টি হোসেন, খাজা মহিউদ্দিন, অহিদুল হোসেন, জালাল আহাম্মদ, বাদশা মিঞা, গোলাম রব্বানি খান, মহিউদ্দিন আহম্মেদ খোকা,  নূর ইসলাম মল্লিক, আব্দুল জব্বার, মূলকুদ হোসেন, গোলাম মোর্শেদ ফারুকী, আইয়ুুব আলী, মো.সালাউদ্দিন (জল্লারপাড়), মো.মোসলে উদ্দিন, মো. সালাউদ্দিন (আমলাপাড়া), আশেক আলী মৃধা ও এম.এ. আসগর (বন্দর), আফেন্দি দুলু, শাহাবউদ্দিন, কবি হাফিজউদ্দিন, লুৎফর রহমান, বজলুর রহমান, আবদুল লতিফ, গোলাম মোর্শেদ ফারুকী, পিয়ার মাহমুদ, আ. মান্নান, ক্বারী আমির, সরাফত আলী, সম্বল মিঞা, গোলাম আলী, খন্দকার নোয়াব আলী, রুহুল আমিন, জয়নাল আবেদীন খান, মো. জাকির, বদরুজ্জামান, আবুল খায়ের, আবু নাসের ওয়াহিদ, সাংবাদিক হানিফ খান, হাজী মুজাফফর আলী, কালু ভূঞা, হাবিবুর রহমান টুক্কু, আমির আলী মিঞা, আলা বক্স, রমিজউদ্দিন, নিখিল সাহা, শেখ মিজানুর রহমান।


 
মহিলাদের মধ্যে যাদের অবদান উল্লেখযোগ্য তারা হলেনÑ বেগম নাগিনা জোহা, লায়লা সারোয়ার, ইলাবক্সী, মণিমালা, বেনু বেগম, আয়শা বেগম, আনোয়ারা খাতুন, ডা. হালিমা খাতুন, ডা. শরীফা খাতুনসহ অনেকে।

 

মর্গ্যান গার্লস স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগম নারায়ণগঞ্জ ভাষা আন্দোলনরত মহিলাদের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ইতিহাস সৃ্িট করেছেন। বিভিন্ন সমাবেশে ছাত্রীদের নিয়ে তিনি যোগ দিতেন। ফলে অচিরেই তিনি সরকারের কালো দৃষ্টির শিকার হন। ২৯ ফেব্রুয়ারি খান সাহেব ওসমান আলীর বায়তুল আমান বাসভবনে যাবার পথে মমতাজ বেগম গ্রেফতার হন। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র নারায়ণগঞ্জ শহর তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

 

অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার স্কুলের তহবিল তছরুপের দায়ে গ্রেফতারের মিথ্যা প্রচারণা চালায়। বিক্ষুব্ধ জনতা মিথ্যা প্রচারণাকে অগ্রাহ্য করে নারায়ণগঞ্জ আদালত ভবন ঘেরাও করে রাখে। পুলিশ ও ইপিআর মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাবার চেষ্টা চালায়। চাষাঢ়া খানসাহেব ওসমান আলীর বায়তুল আমান বাড়ির সামনে জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় পুলিশ এবং ইপিআর বায়তুল আমানে প্রবেশ করে প্রাসাদতুল্য এই বাড়িটিতে ভাংচুর, তছনছ ও লুটপাট করে অনেক ক্ষতিসাধন করে।

 

পুলিশ বাড়ির মালিক খান সাহেব ওসমান আলী ১৯৪৬ সনের নির্বাচনে কৃষক প্রজাপাটির প্রার্থী হয়ে জিন্নাহর মুসলিম লীগ প্রার্থী নবাব হাবিব উল্লাহকে পরাজিত করে এম,এন,এ নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন, মোস্তফা সারোয়ারসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে চাষাঢ়া পুলিশ ফাঁড়িতে আটক করে নির্মম প্রহার করে। পরে এ.কে.এম. সামসুজ্জোহা, সফি হোসেন খান, মোসলেহ উদ্দিনসহ অনেকে গ্রেফতার হন।

 

বায়তুল আমানে ইপিআর ও পুলিশের আক্রমণের প্রতিবাদে মহিলারা নাগিনা জোহার নেতৃত্বে এর প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের সাথে অনেক বাক বিতন্ডা হয়। অবশেষে  মমতাজ বেগমকে ইপিআর ও পুলিশ ঢাকায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে মমতাজ বেগম মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে মুক্তি গ্রহণের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় তার স্বামী তাকে তালাক দেয়। এই দেশপ্রেমিক ও মহিয়সী নারী মমতাজ বেগম মাতৃভাষার জন্য জীবনের মহামূল্যবান (স্বামীÑস্ত্রী) সম্পর্ক বিসর্জন দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। মমতাজ বেগম দীর্ঘদিন কারাগার থেকে মুক্তির পর নিঃস্ব অবস্থায় নিজের শেষ একটু সম্বল একমাত্র গলার চেইন দিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যয়ে অংশগ্রহণে অবদান রাখেন।


 
অতীতে নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীতে কুমারী মেয়েরা চরকা দিয়ে ভোরের হাওয়ায় তৎকালীন ঐতিহাসিক মসলিন কাপড়ের সূতা তৈরি করত। শীতলক্ষ্যা নদীর প্রবাহ মানুষের অনেক জটিল রোগের উপশমের ভরসা ছিল। শীতলক্ষ্যার পানি ও শীতলক্ষ্যা পাড়ের পাটশিল্প পৃথিবীর বহু দেশের নিকট ছিল মোহনীয় ও লোভনীয় । বর্তমানেও বাংলাদেশ পৃথিবীতে পোশাক শিল্পে দ্বিতীয়। যার অধিকাংশ কৃতিত্ব নারায়ণগঞ্জের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক কর্মচারীদের।

 

নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলনে ভাষা সৈনিকগণ ও ওসমান পরিবারসহ মহিয়সী নারী মমতাজ বেগমের অবদান, ত্যাগ ও অর্জন অতীত ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জকে করেছে আরো গৌরবান্বিত ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী। ১৯৫৬ সনের ২৩ মার্চ (যুক্তফ্রন্ট) সরকার বাংলাকে সরকারিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়।

 

সগৌরবে ও আত্মমর্যাদায় বাংলাদেশের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় সমগ্র পৃথিবীব্যাপী। উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ভারতের আসামে ১৯ মে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শহীদ হন। আমি তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

 

মোহর আলী চৌধুরী

এই বিভাগের আরো খবর