বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ভালো থেকো প্রিয় সবুজ পরপারে..

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল ২০২০  

সাইফুদ্দিন সবুজ একটি নাম। একটি ইতিহাস। আমার প্রিয় বন্ধু। সাংবাদিক সমাজের নক্ষত্র। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তাকে ঘিরে অনেক স্মৃতি।

 

সৃষ্টিশীল মানুষ। নতুন কিছু করার নেশা বিভোর থাকতেন সারাটা সময়। তার ছিল চমৎকার লেখনি শক্তি। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের অফিসে গত ২০টি বছর কত আড্ডায় মেতেছি আমরা। 

 

স্বপরিবারে আমার বাসায় আসা, তাঁর বাসায় বেড়ানো, কত স্মৃতিই না তাকে ঘিরে আছে। লক্ষিবাজারের মিশনারীজে গিয়ে ফাদারদের সাথে নিরামিষ দিয়ে দুপুরে ভোজন, আড্ড, কতকিছু। এর সবই এখন অতিত স্মৃতি।

 

তিনি জানতেন আমি নিরামিষ খাবার খুব পছন্দ করি। মাঝে মাঝেই বলতেন ‘আজ নিরামিষ ভালো রান্না হয়েছে চলে আসেন’। তাঁর সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগতো আমার। 

 

এদেশে যখন মোবাইল এলো তখন কথা বলার লোক পেতামনা সিটিসেলের সেই মোবাইল অনেকের কাছেই ছিলো না। একদিন অজানা নাম্বার থেকে কল এলো। সবুজ ভাইয়ে কন্ঠ। বললেন নাম্বারটা সেভ করে রাখেন। 

 

সেই থেকে মোবাইলেও আড্ডা চলতো আমাদের। মোবাইলে দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ পেতাম। ছুটে যেতাম পুরান ঢাকার বক্সিবাজারের সেই অফিসে।

 

সবুজ ভাই লিখার চেয়ে পড়তেন বেশি। বই পাগল মানুষ। বিভিন্ন পত্রিকায় সাবজেক্টওয়াজ যৌথভাবে লিখেছি আমরা। তখন দৈনিক জনকন্ঠের স্বর্ণযুগ।

 

শুক্রবারের সাহিত্য পাতা বেশ সমৃদ্ধশালী। সে পাতায় আমার আর সবুজ ভাইয়ের পাট নিয়ে দেড় পাতার একটি কভার ষ্টরি ছাপা হলো। এটি তৈরি করতে আমাদের বেশ সময় লেগেছিলে। 

 

তখন তিনি আমার রাজধানী ঢাকার দিলকুশার অফিসে আসতেন। আমিও ছুটে যেতাম তার পুরান ঢাকার অফিসে। কাজ শেষে যথানিয়মে জনকন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব ভাইয়ের কাছে সে প্রতিবেদনটা জমা দিলাম আমরা। ছাপাও হলো।


ঐ লেখাটি এখনো অনেক অফিসে যারা পাট নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের সংরক্ষনে আছে বলে জেনেছি।  শুক্রবারের আয়োজনের সাহিত্যপাতার প্রথম পাতাটা ছিলো বেশ গুরুত্ব পূর্ণ। আমি তখন জনকন্ঠে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কারনে সব পাতাতেই লিখতাম। 

 

বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ফিচার লিখতাম। এভাবে বহু লেখা সবুজ ভাই আর আমি যৌথভাবে লিখেছি। বিশেষ করে গবেষণাধর্মী লেখা যৌথভাবে লিখতাম আমরা। 


লেখা লিখতে গিয়ে অনেক বই পড়তে হতো। সেসময় আমরা লাইব্রেরী ওয়ার্কও করেছি একসাথে। কোন ইস্যু থাকলে পাবলিক লাইব্রেরিতে ছুটে যেতাম। বিষয় ভিত্তিক নোট নিতাম, কখনো আবার ফটো কপি করে আনতাম। একটা লিখার পেছনে বহু শ্রম দিতে হতো আমাদের।

 

সবুজ ভাই বেশ ভালো সংগঠক ছিলেন। এক সাথে সাংবাদিকতা এবং সামাজীক সংগঠন করেছি। সংগঠন নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি সবুজ ভাইকে ঘিরে। 


২৫/২৬ বছর আগের কথা, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের রেবতিমোহন কলেজে সাংবাদিকদের একটি ট্রেনিং কর্মসূচী। সেই সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ প্রেসক্লাবের অভিষেক অনুষ্ঠান। 


শ্রদ্ধেয় মনজুরুল আহসান বুলবুল ভাই প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন। ম্যাগাজিনটার সম্পাদনার দ্বায়িত্বে ছিলাম আমি।  আগের দিন রাতে সবুজ ভাই আর আমি বাংলাবাজারে সারা রাত জেগে ছাপানো, বান্ডিং তার পর সকালে তাড়াহুড়ো করে অনুষ্ঠান স্থলে আসা। 

 

এর সবই মনে পরছে আমার। এমন অনেক স্মৃতি ঘিরে আছে সবুজ ভাইকে নিয়ে। সময় গড়িয়েছে। দু’জনেরই ব্যস্ততাও বাড়ে। যোগাযোগ কমতে থাকে। তবে ফোনে খোঁজখবর নিতে ভুলতাম না কেউ। 

 

তিনি মোবাইল করে প্রায়ই টান মেরে বলতেন-"মীর..র.র.র. ভাই কেমন আছেন? লিখেতো একেবারে ফাঁটিয়ে দিচ্ছেন"। ভাবি পরম মমতায় চিরচেনা হাঁসিতে দারাজ কন্ঠে কে আর আমায় বলবে-“মীর ভাই কেমন আছেন?”

 

সর্বশেষ মাসখানেক আগে কথা হয়েছে আমাদের। দৈনিক ইত্তেফাকের একটি কলামের দ্বিমত প্রকাশ করলেন। আমি যথাযথ ব্যখ্যাও দিলাম। বললেন- ‘দেটস্ ওকে’।

 

একটি প্রজেক্ট’র ব্যাপারে হাওর এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। হাওড় এলাকার মানুষদেও নিয়ে কাজ করবেন। একটি রেডিও স্টেশন করবেন সেখানে। 

 

এর আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন প্রিয় সবুজ। কাল (১৩ এপ্রিল) রাতে যখন ফেসবুকে খবর পেলাম মুহুর্তের মধ্যে প্রেসারটা বেড়ে গেল। কন্ট্রোল করতে বিছানায় গেলাম। যেন কোনোভাবেই ভাবনায় নিতে পারছিলাম না প্রিয় মানুষটি আর নেই আমাদের মাঝে। 

 

এও ভাবছিলাম ক’দিন আগেতো নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভি রহমানকেও ফেসবুকওয়ালারা মারা গেছেন বলে খবর দিয়েছিলো। এমনটাই হবে হয়তো।

 

সবুজ ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করে পেলাম না। নারায়ণগঞ্জের একজন টিভি সাংবাদিককে ফোন করতেই তিনি সবুজ ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করলেন।

 

আশার আর অবশিষ্ট রইলো না। আমারা হারিয়েই ফেলেছি সবুজ ভাইকে। কাজ পাগল মানুষটা কেবল কাজের পিছু ছুচেছেন সারাটা জীবন। 

 

নিজের শরীরের প্রতি বেশ উদাসীন ছিলেন। তাই অল্প বয়সেই তার শরীরে ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ বাসা বাঁধে ছিলো। করোনা ভাইরাস আতংকে লকডাউন এর মাঝেও ঘরে বসে নেই, অফিসে ছুটে গেছেন। 

 

কাজ করতে গিয়ে কখন যে ডায়াবেটিস নীল হয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি। তারপর হাসপাতলে। সবুজ ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না আমি। সবুজ ভাইয়ের হাসিমাখা মুখটা আর কখনই দেখতে পাবো না ভাবতেই ভীষন কষ্ট হচ্ছে।

 

ফোনে আর কখনো দারাজ কন্ঠে কেউ বলবে না আমায় 'আলীম ভাই কেমন আছেন?' ভালো থেকো প্রিয় সবুজ, ভালো থেকো ভাই আমার। পরপারে ভালো থেকো। হে আল্লাহ তুমি আমার সবুজ ভাইকে পরপারে ভালো রেখো।

 

সোহরাওয়ার্দী কলেজের উল্টো দিকের ভেরিতাসের অফিসে প্রায়ই যেতাম। সব উদ্দ্যেশের মধ্যে অন্যতম ছিলো বই আনা। তখন বইয়ের বেশ কদর। 

 

কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ক্লিক করলেই সব চলে আসতো না। বই পড়ে শিখতে হতো। একসময় সবুজ ভাই  ‘প্রকৃতি' নামে একটি ম্যাগাজিন বের করলেন। খুব মানসম্মত ম্যাগাজিন।

 

আমি নিজেও লিখতাম সেখানে। কাজের সুবিধার্থে মতিঝিলের দৈনিক বাংলার বিপরীতে আজিজ কো-অপারেটিভ ভবনে অফিস নেন। পরে পল্টনের স্টুডিও। এর এসব কিছুই এখন কেবল মনে পড়ে।

 

সবুজ ভাই তিনি ছিলেন আমাদের কিংবদন্তি। নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক সমাজের জ্যেষ্ঠতম সদস্য ও অভিভাবক। ৩ যুগেরও বেশী সময় ধরে যার কলম সানিত ছিল।

 

যিনি ছিলেন অকুতভয় সাংবাদিক। তিনি সাংবাদিক পরিচয় ছাপিয়ে পরিণত হয়েছিলেন বিবেকের কণ্ঠস্বরে। জনঅধিকারের প্রশ্নে তার কণ্ঠ ছিল নির্ভীক, অবিচল। কপটতা ও সংকীর্ণতার দেয়াল ছাপিয়ে তিনি বরাবরই উচ্চারণ করতেন যা সত্য তা।

 

অসংকোচে, সত্য প্রকাশে দুরন্ত সাহস ছিলো মানুষটির ভেতর। তাঁর ভেতর আর বাহিরটা ছিলো অভিন্ন। নিরহংকারী। তিনি আমাদের গর্ভ। তিনি আমাদের অনুপ্রেরনা।

 

তাঁর সাথে পরিচয় ছিলো, তিনি আমার পরম বন্ধু ছিলেন, এটাতেই আমার গর্ভ। তাঁর সান্নিদ্ধ লাভ করেছি, তাঁরা পরামর্শ পেয়েছি, এটাই আমার সাংবাদিকতা জীবনে পাথেয়। 

 

তিনি আমাকে ‘মীর ভাই’ বলেও ডাকতেন। এ সংক্ষিপ্তপ্ত নামে আরকেজন কিংবদন্তি মানুষ আমাকে ডাকতেন। তিনি হলেন প্রায়ত এবিএম মুসা।  তিনি ‘মীর’ বলে সম্মোধন করতেন। এ দুজন মহান মানুষের ডাকার মধ্যেও কি মিল ছিলো।

 

কেউ আমাকে এখন আর এ নামে ডাকবে না। মুসা ভাই দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সবুজ ভাই আমাকে এ নামে ডাকতেন। তিনিও চলে গেলেন। কে আমায় ডাকবে এ নামে।

 

সাংবাদিক সমাজের বাতিঘর ছিলেন সাংবাদিক সবুজ ভাই। তিনি আজ জীবন ও মৃত্যুও সীমানা ছাড়ায়ে। এই বহুমাত্রিক সাংবাদিকের অল্প বয়সে এই মহাপ্রয়াণ দেশের সাংবাদিকতা জগতে এর ফলে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হল। 

 

আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি পরম করুণাময়ের কাছে। তার শোকসনত্মপ্ত পরিবারকে জানাই সমবেদনা। সাইফুদ্দিন সবুজের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এই বিভাগের আরো খবর