শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘বিআরটিএ অফিস’ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে ৬ দালালের দৌরাত্ম্য

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০১৯  

 স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : নতুন সড়ক আইন। নতুন দালাল। পদে পদে ভোগান্তি। বিআরটিএ অফিস থেকে ব্যাংক পর্যন্ত দালালচক্রের হয়রানির ফাঁদ। তবুও মানুষ কষ্ট সহ্য করে গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করছেন। নতুন আইন কার্যকর হওয়ায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নারায়ণগঞ্জ সার্কেল অফিসে বেড়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের চাপ।

 

গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে দালালদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দালালদের দৌরাত্ম্য এই সার্কেল অফিস ছাড়াও ব্যাংকেও একটি সিন্ডিকেট কাজ করেন। এনআরবিসি নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে লাইসেন্সের টাকা জমা দেয়ার সময় ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়।

 

টোকেনের নামে শুধু পরিচিতদেরই টোকেন দেয়া হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে থাকলেও টোকেন দেয়া হয়না। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, এসব অভিযোগের জন্য নাকি ব্যাংকে টাকা জমা নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পূণরায়  সেবাটি চালু করা হয়েছে।

 

বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানালেন, কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া ও জনবলের স্বল্পতায় সেবা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগ পেয়ে তা বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানান জেলা প্রশাসক ও রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির সভাপতি। গত পহেলা নভেম্বর থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর কারণে টনক নড়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের।

 

কাগজ পত্র ঠিক করতে ভিড় করছেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির বিআরটিএ’র নারায়ণগঞ্জ সার্কেল অফিসে। বেড়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের চাপ। সরেজমিন বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি।

 

সেবা প্রত্যাশীরা জানান, যে কয়জন ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে এসেছেন, তারা আসলে এই কার্যালয়ে দালালীর কাজ করে থাকেন। এ সময় তাদের নানা অভিযোগ বলতে থাকেন। তারা অভিযোগ করেন, বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে ৬ জন দালালের মাধ্যমেই মূলত সেবা প্রত্যাশীরা ভোগান্তির শিকার হন।


সেবা প্রত্যাশীরা বলেন, বিআরটিএ কার্যালয়েই কর্মকর্তাদের মতোই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মনির, নেকবর, জহির, মামুন, মামুন-২ সহ আরো দুই জন। এ সময় সেবা প্রত্যাশীরা সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েকজনকে (দালাল) দেখিয়ে কিভাবে তারা হেনস্থার শিকার হয়েছেন সেগুলো তুলে ধরেন। এ সময় কয়েকজন (দালাল) সেখান থেকে সটকে পরে। তবে  অফিসে দালালদের ছবি তোলার  সময় একজন দালাল (নেকবর) ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে ভাল করে ছবি তুলেন।


লাইসেন্স করতে এসে ভোগান্তির শিকার এক সেবা প্রত্যাশী জানান,  হাল্কা লাইসেন্স করতে ২৫৪২ টাকা লাগলেও এ অফিসে দালালদের মাধ্যমে দিতে হয় সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। নিজে নিজে কাগজ পত্র জমা দিয়ে অফিসে অনেক দিন ঘুরে কোন কুলকিনারা না পেয়ে ৩ হাজার টাকা দালাল ধরে তিন মাসে লাইসেন্স পেয়ে দেখেন জাতীয় পরিচয় পত্রের সাথে লাইসেন্সের বয়স ১০ বছর বেশী। বয়স সংশোধনের জন্য ৫ হাজার টাকা দাবী করে জানায় তিন মাসে ঠিক করে দেয়া হবে।


সেবা প্রত্যাশীদের কয়েকজন জানান, দালালদের দৌরাত্ম্য এই সার্কেল অফিস ছাড়াও ব্যাংকেও একটি সিন্ডিকেট কাজ করেন। এনআরবিসি নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে লাইসেন্সের টাকা জমা দেয়ার সময় ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। টোকেনের নামে শুধু পরিচিতদেরই টোকেন দেয়া হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে থাকলেও টোকেন দেয়া হয়না। যদিও তর্কাতর্কি করে টোকেন মিলে তবে দেখা যাবে সামনের ১০জন শেষ না হতেই আরো কয়েকজন এসে লাইনে ঢুকবে।

তারা বলবে, টাকা জমা দেয়ার জন্য তারাও এসেছেন, লাইন ধরেছেন, লাইন দেখে সিরিয়াল নম্বরটি আরেকজনকে দিয়ে বাসায় খেতে গিয়েছিলেন, অথবা টয়লেটে গিয়েছিলেন, অথবা কাগজ ভুলে ফেলে এসেছেন ইত্যাদি। আসলে এরসাথে ওই ব্যাংক শাখার দারোয়ানরা জড়িত। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে যে দারোয়ানদের কেমন সখ্যতা তা ব্যাংকে গেলেই বোঝা যায়। দেখা যায় দারোয়ানই ব্যাংকের ক্যাশকাউন্টারে অনায়াসে ঢুকছেন, কম্পিউটারেও হাত রাখছেন, অফিসারদের মতো চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন।

 

সেবাপ্রত্যাশীরা প্রতিবাদ করেও কোন পাত্তা পাচ্ছেননা। কিন্তু দালালদেরই একটি চক্র ২০ থেকে ২৫টি লাইসেন্সের টাকা জমা দিতে কোন বেগ পেতে হচ্ছেনা। লাইসেন্সের টাকা দেয়া ছাড়াও পরীক্ষার জন্য এক্সট্রা টাকা দালালদের কাছে জমা দিতে হয় বলে জানান সেবা প্রত্যাশীরা।


তবে এনআরবিসি নারায়ণগঞ্জ শাখার ডেপুটি ম্যানেজার বলেন, আসলে এসব অভিযোগের কারণে আমরা ব্যাংকে লাইসেন্সের টাকা জমা নেয়া বন্ধই করে দিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রাহক সেবার কথা চিন্তা করে আবার চালু করেছি। যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।


বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ সার্কেল সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী বলেন, শিক্ষানবিশ লাইসেন্স আগে সপ্তাহে ১৫০ হলেও এখন প্রায় তিনশ’ হচ্ছে। আর ফিটনেস বেড়েছে আগের চেয়ে দ্বিগুন। জনবলের স্বল্পতায় বেশী সেবা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

 

দালালদের মাধ্যমে কাজ করা ও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে বিআরটিএ’র নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরিচালক বলেন, জানুয়ারি থেকে কোন লাইসেন্স ছাপা হচ্ছে না। লাইসেন্স করতে ৫-৮ মাস সময় লাগে। বিশেষ ক্ষেত্রে জরুরি ভাবে কিছু করা হয়। দালালরা অনেক সময় অফিস স্টাফদের টেবিলে বসে কাজ করার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।


বিআরটিএ অফিসে দালালদের সেবা গ্রহীতাদের হয়রানীর অভিযোগ পেয়ে তা বন্ধে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে নিদের্শসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির সভাপতি মো.জসিম উদ্দিন বলেন, ইমেইলে কিংবা অন্যান্য জায়গায় অভিযোগ নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

 

বিআরটিএর কোন সেবা কত টাকায় পাওয়া যাবে সেটিও দেখানোর ব্যবস্থা করেছি, যাতে হয়রানি কমে। ভুক্তভোগীদের প্রতিবাদ করতে হবে। এরপরেও কোন সমস্যা হলে এটি আমাদেরকে জানানো উচিৎ সেবা প্রত্যাশীদের।
 

এই বিভাগের আরো খবর