বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বালু নদের ভয়ংকর পঁচা পানি ৫০ গ্রামের লাখো মানুষের দুঃখ

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০১৯  

রূপগঞ্জ (যুগের চিন্তা ২৪) : রূপগঞ্জের কোলঘেঁষে প্রবহমান এক সময়ের খরস্রোতা বালু নদ এখন দূষণ-দখলে মৃতপ্রায়। নয়ন জুড়ানো রূপ তার ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল দুই যুগ আগে। নদে এখন মাছ নেই। বেড়েছে মশার উপদ্রব। কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। বেড়েছে রোগবালাই। 


দূষিত পানির দুর্গন্ধে তীরবর্তী এলাকার মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রাণ-পরিবেশ। বিপর্যস্ত মানুষের জীবন। রাজধানী ঢাকার পয়োবর্জ্য ও শিল্পকারখানার বর্জ্য পড়ে এ নদের পানি এখন আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে। তাই স্থানীয়রা একে ‘পঁচা’ পানি বলে। রাজধানী ঢাকার খিঁলগাও, ডেমরা, বেড়াইদ, গুলশান ও রূপগঞ্জের ৫০ গ্রামের লাখো মানুষের কাছে বালু নদের পঁচা পানি এখন অভিশাপ। 


যেভাবে দূষণ : শীতলক্ষ্যার মোহনা ডেমরা থেকে বালু নদ শুরু। ডেমরা এলাকা থেকে বালু নদ টঙ্গীতে গিয়ে তুরাগ নদে মিলেছে। বালু নদ থেকে দুটো ছোট নদ নড়াই ও দেবধোলাই ঢুকেছে ঢাকার রামপুরায়। এ ছোট নদ দুটো দিয়ে ঢাকার মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেঁজগাও, সবুজবাগ, মতিঝিলসহ বিশাল এলাকার শিল্প ও পয়োনালার বর্জ্য এসে রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বালু নদে পড়ছে। বছরের পর বছর আবর্জনা পড়তে পড়তে এর পানি এখন বর্জ্য হয়ে পড়ছে। 


ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, বালু নদের মোট দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে দৈনিক ১০ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য, ৫৬ কোটি ঘনমিটার বর্জ্য মেশানো পানি, বিভিন্ন কলকারখানার ৪৫০ ঘনফুট বর্জ্য প্রতিদিন এ নদে পড়ছে। এছাড়া বালু, নড়াই ও দেবধোলাইয়ের উপড় রয়েছে সহস্রাধিক খোলা পায়খানা। এসব থেকে আরো ৫৬০ ঘনফুট পয়োবর্জ্য নদের পানিতে মিশছে। সবমিলিয়ে বালু নদের পানি এখন আলকাতরার মতো কালো। 

 

পঁচা পানিতে চলে জীবন-জীবীকা : সরেজমিনে বালু নদের তীরবর্তী বালুরপাড়, দাসেরকান্দি, কামশাইর, চানখালী, ধীৎপুর, পশ্চিমগাঁও, চনপাড়া, দক্ষিণপাড়া, নয়ামাটিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বালু নদের পঁচা পানি অভিশাপ হলেও এসব গ্রামের বৌ-ঝিয়েরা পঁচা পানিতেই থালা-বাসন পরিষ্কার করছে। পুরুষরা এ পানিতে গরু গোসল করাচ্ছে। এমনকি লোকজন এ পঁচা পানিতেই গোসল করছে। 


 
পঁচায় বিপর্যস্ত কৃষি : এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, নদের পূর্বপাড়ে রূপগঞ্জ। আর পশ্চিমপাড়ে ঢাকার খিলগাও, ডেমরা, বেরাইদ, ডুমনী ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন। নদের উভয় তীরজুড়ে ফসলের ক্ষেত। এক সময় এসব জমিতে অধিক ফসল ফলতো। পঁচা পানির কারণে এখন এর অর্ধেকও হয়না বলে জানালেন অনেক কৃষক। 

 

কথা হয় বর্গাচাষি আক্কাস আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে বিঘায় ধান পাইতাম ৪০ মণ। অহন ১৭ কি ১৮ মণ। কৃষকরা জানায়, বিকল্প উৎস না থাকায় জমিতে তারা বালু নদের পঁচা পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। 


এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, পানিতে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড থাকার ফলে চারাগাছের গোড়া পচে যায়। ফলে ফসল উৎপাদন কম হয়। পঁচা পানি রোধ করা না গেলে একসময় এসব এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। 

 

মশা-মাছির যন্ত্রণা : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবেশ বিপর্যয় ও কৃষি বিপর্যয়ের পাশাপাশি মশা-মাছির যন্ত্রণাও রয়েছে। পঁচা পানির কারণে মশার উপদ্রব এসব এলাকায় অনেক বেশি। দিনের বেলায়ও মশারী খাটিয়ে নিস্তার নেই তাদের। মশা নিধনে নেই সরকারি কোন উদ্যোগ। 

 

বালুরপাড় এলাকার ডেকোরেটর ব্যবসায়ী সামসুউদ্দিন মিয়া বলেন, পঁচা পানি মানুষের জীবনটা শেষ কইরা ফালাইতাছে। গত ১৯ বছর ধইরা মানুষ ভোগান্তির শিকার অইতাছে। অন্তত মশা থেকে যদি আমাগো বাঁচাইতো তাহলেও শান্তি পাইতাম। 

 

জেলে পল্লির দুর্দিন : সরেজমিনে বালু নদের তীরবর্তী দাসেরকান্দি, চরচনপাড়া ও ফকিরখালির জেলে পল্লি ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঁচা পানির কারণে নদে মাছ না থাকায় দেড় শতাধিক জেলে পরিবার এখন নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। বছরের ছয় মাস তাদের কাটাতে হয় অর্ধহারে-অনাহারে। তাই তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পেশা বদলাচ্ছে। পঁচা পানি তাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। 

 

দাসেরকান্দি জেলে পল্লীর ষাটোর্ধ্ব নরেশ চন্দ্র রাজবংশী বলেন, পঁচা পানি আমগো শেষ কইরা দিছে বাজান। গাঙো মাছ কইত্তে থাকবো কন? পানি তো বিষ অইয়া গেছেগা। মেছের (ম্যাচ) কাঠি ধরাইয়া পানিত ফালাইলে আগুন ধইরা যায়গা। 

 

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার বসাক বলেন, নদের পানিতে কার্বন-ডাই অক্সসাইড ও মনো অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেশি। কোনো জীব বা প্রাণি এ অবস্থায় বাঁচতে পারে না। 

 

আন্দোলন-সংগ্রামও ফিকে : খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বালু নদের দূষণ রোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাক্সে বন্দি রয়ে আছে। পঁচা পানি রোধের দাবি জানিয়ে ২০০১ সালের ১১ মার্চ ও ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ত্রিমোহনীতে দুই বার মহাসমাবেশ হয়েছিল। 

 

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, পঁচা পানি রোধে বালু, নড়াই ও দেবধোলাই নদের দুই তীরের ৫০ গ্রাম বাঁচাতে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল শোধনাগার নির্মাণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির আঙ্গুলির ইশারায় এ প্রকল্পও লাল ফিতায় বন্দী রয়েছে। 

 

বালু-শীতলক্ষ্যা বাঁচাও আন্দোলনের নেতা, কলামিস্ট ও গবেষক লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, ঢাকাকে যেমন বাঁচানো জরুরি, ঠিক তেমনি ৫০ গ্রামের লাখো মানুষকে বাঁচানোটা জরুরি। পঁচা পানির কারণে শুধু মানুষই নয়, পরিবেশ, কৃষি এমনকি জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটছে। জরুরি ভিত্তিতে পঁচা পানি রোধ করা প্রয়োজন। নয়তো আন্দোলন চলবে।

এই বিভাগের আরো খবর