শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

বর্তমান যুগের দ্রোনাচার্য্য, অভিভাবকদের পকেট কেটে নেওয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

“জ্ঞানের আলো দিকে দিকে জ্বালো।” গত ১ জানুয়ারি সারাদেশে বই উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। কোমলমতি শিশু কিশোররা নতুন বই হাতে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত। সরকার চায় দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আলোকিত জীবন গড়ে উঠুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।


জ্ঞান অর্জনের শেষ নেই। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার সীমানা। নতুন বছর নতুন বই পেয়ে রুটিন মাফিক শুরু হোক অনুশীলন আজকের পড়া আজই শিখে নাও। আগামী দিনের জন্য ফেলে রেখো না। আগামী দিনের সূর্য তোমার জন্য নাও উঠতে পারে। কথায় আছে, “সময়ে এক ফোঁড়, অসময়ে দশ ফোঁড়”। সবার মেধা-মনন এক নয়। দৌড় প্রতিযোগিতায় সবাই প্রথম হবে না। অংশগ্রহণ করা কম কথা নয়। 

 

জ্ঞান অর্জনের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত। এক সময় এমন ছিলনা। বর্ণবাদ আর শ্রেণি বৈষম্যের জাতাকলে অনেকেই নির্যাতিত হয়েছে। মহাভারতের যুগে একলব্য দ্রোনাচার্য্যরে কাছ থেকে বর্ণ শুদ্র বলে অস্ত্র শিক্ষা লাভে বঞ্চিত হয়েছিলেন। রাজ পরিবারের অস্ত্র গুরু দ্রোনাচার্য্য। তার কাছে একলব্য নামে এক কিশোর বালক অস্ত্র শিক্ষার লক্ষ্যে যান। কিন্তু শুদ্র বলে তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়। সে অস্ত্র শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে একলব্য বনের ভেতর মাটি দিয়ে গুরু মূর্তি (দ্রোনাচার্য্য) তৈরি করে সেখানে ধ্যানযোগে অস্ত্র সাধনা করতে থাকেন। এক বছর, দুই বছর, বহু বছর সাধনায় মগ্ন একলব্য। গভীর অরণ্যে ধ্যানস্ত একলব্য। 

 

একদিন গুরু দ্রোনাচার্য্য তার প্রিয় শিষ্য অর্জুুনেেক নিয়ে বনের মধ্যে শিকারে আসেন। তাদের সাথে এক প্রভুভক্ত কুকুর। বনের মধ্যে প্রভুকে ফেলে একাকী সেই কুকুর বনের গভীরে গিয়ে পথ অঙ্কন করছে। এ সময় ধ্যানস্ত জটাধারী একলব্যকে দেখে ভীষণ শব্দ করতে থাকে সেই কুকুর। ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় একলব্য তার শব্দরোহিত বান মেরে কুকুরের কন্ঠরোধ করে দেয়।

 

বানাঘাতে শব্দরোহিত কুকুর দ্রোনাচার্য্যরে সম্মুখে যায়। অস্ত্র্রগুরু আশ্চার্য্য হয়ে যান। শব্দরোহিত বান কে নিক্ষেপ করলো? দ্রোনাচার্য্য কুকুরের পিছু পিছু গিয়ে দেখেন এক জটাধারী যুবক। কে তুমি? উত্তর এলো আমি একলব্য গুরুদেব! কে তোমার গুরু? আপনি আমার গুরু। আপনার মুর্র্তি নির্মাণ করে ধ্যানোযোগে আমি অস্ত্র শিক্ষা করেছি। আপনিই আমার গুরু। 


দ্রোনাচার্য্য বললেন, ঠিক আছে তুমি গুরু দক্ষিণা দাও। আমার কাছে তো কোন অর্থ সম্পদ নেই। আমি কী দক্ষিণা দিবো? ঠিক আছে তোমার ডান হাতের তর্জনী আপন হাতে কেটে আমার চরণে দক্ষিণা দাও। একলব্যের সমস্ত শক্তি হ্রাস করার জন্যই গুরুর এ দাবি। সবকিছু জেনেও একলব্য তার ডান হাতের তর্জনী আপন হাতে কেটে গুরু দক্ষিণা দিলেন। এ হচ্ছে দ্বাপর যুগ মহাভারতের মহাগুরু দক্ষিণার এক করুণ ইতিহাস। 

 

পৌরাণিক গুরুর কথা নয়, আধুনিক যুগের গুরুদের কথা বলছি। আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরের আনাচে-কানাচে নামীদামি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর লাখ লাখ ছাত্র আর হাজার হাজার শিক্ষক দেখা যাচ্ছে। এখন বর্ণ বৈষম্য আর জাতপাতের বিচার করা হয় না। শিক্ষায় সবার সম অধিকার। সরকার বলছে, “শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বালো”। আর এই আলো জ্বালাতে গিয়ে কত প্রদীপের প্রাণ পুড়ে তা কে জানে। এইতো গেল বই উৎসব বিনামূল্যে কোটি কোটি টাকার বই বিতরণ করা হলো।

 

অনেকেই জানেন-বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অর্থ রোজগারের প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে। নামিদামী ব্যানার বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপনার সন্তানকে ভর্তি করবেন। ভর্তি ফি, সেশন ফি, মাসিক বেতন তো দিবেন। বেশ ভাল কথা। গণিতের অংক কিন্তু কম নয়। আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে কোন কিছু ভাববেন না। স্কুল ড্রেস, জুতা, খাতা, ব্যাচ স্কুল থেকেই দেওয়া হবে। 


স্যার সব কিছুর কথা বললেন, শিক্ষার বিষয় টা? আর ওটা ভাববেন না! আমাদের স্কুলের পাশে ভাল ভাল কোচিং সেন্টার রয়েছে। যেকোন ২/১টি কোচিং সেন্টারে জানুয়ারির প্রথম থেকেই ভর্তি করে দিবেন। সাবজেক্ট স্যারদের সাথে যোগাযোগ রাখবেন। বিদ্যালয়ের আশেপাশে এমন কি বাসা-বাড়িতে সার্বক্ষণিক অথবা সকাল-বিকাল সন্ধ্যায় ব্যাচ করে কোচিংয়ে পড়ানো হচ্ছে। কোচিংয়ের শিক্ষকরা অমুক স্কুলের অমুক স্যার, তমুক স্কুলের তমুক স্যার। ম্যাথের স্যার, ইংলিশ স্যার ইত্যাদি ইত্যাদি দেয়াল লিখন ও ব্যানার ফেস্টুনে দেখা যাচ্ছে। 

 

শিক্ষক হচ্ছে দ্বিতীয় জন্মদাতা। আমি শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বর্তমান অর্থলোলুপ শিক্ষকদের কথা বলছি। এ ধরনের শিক্ষিত যুবক শ্রেণি শিক্ষকতা পেশায় না এসেন ব্যবসাকে বেছে নিলে শিক্ষার্থীদের মাতা-পিতার এমন করে পকেট কাটা হতো না। তাই বলছিলাম মহাভারতের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য্যরে ন্যায় শিষ্যের তর্জনী কাটা বড়ই বেদনাদায়ক, বড়ই কষ্টের। 

 

সরকার শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশ্রামাগারে বিনামূল্যে যন্ত্রপাতি দিচ্ছেন। পুরাতন বিদ্যালয়গুলোর নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করে দিচ্ছেন। এমন কি খেলাধুলার জন্য সরকারি অর্থে সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। এতকিছু দেওয়ার পরও চাহিদার অন্ত নেই। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অজুহাতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। 

 

এসব বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা জানেন। শুধু জানেনই না বিভিন্ন স্থানে বলেনও। সেসব কথা শিক্ষামন্ত্রণালয় এমন কি সরকারের শিক্ষা পরিচালনার প্রতিও নানা রূপ ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলছেন। বুঝেই বলুক, আর না বুঝেই বলুক! অন্তরের ব্যাথার তীব্র দহনে তাদের এ শব্দগুলো বেড়িয়ে আসছে।

 

আধুনিক এ বিজ্ঞানের যুগে দ্রোণাচার্য্যরে হাত থেকে কবে গুরুভক্তি পরায়ণ একলব্যরা মুক্তি পাবে তা কেউ জানে না। অজানা এক প্রত্যাশা নিয়েই বলছি, সরকার এ বছরকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। বাঙ্গালি জাতির অহংকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে জানা মানে, জাতিকে জানা দেশকে জানা। এক কথায় নিজে নিজকে জানা। যারা নিজেকে নিজে জানেনা। তারা বড়ই দুর্ভাগা।

 

তুরস্কের জাতির পিতা কামাল পাশা। চীনের মাও সেতুং, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ভারতে গান্ধিজী। প্রত্যেকটা মানুষের একটা আইডল থাকে। একটা মহান ব্যাক্তি আদর্শকে ধারণ করেই মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু আজ সারা বিশ্বের সংগ্রামী আদর্শের নেতা। এই জানা সত্যটুকু জানানোর দায়িত্বটুকু আন্তরিকতার সাথে পালন করলে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর ন্যায় দেশ ও জাতিকে ভালবাসতে শিখবে এবং হৃদয়ে সত্য ন্যায়কে ধারণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। দেশপ্রেমের আলোকে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে পাশাপাশি বাংলা-বাঙ্গালি জাতির শির চির উচ্চে আবহন করবে। আর এ দায়িত্বটুকুই জাতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও মহান শিক্ষকদের কাছে প্রত্যাশা রাখে জাতি।

 

রণজিৎ মোদক
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি- ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ
মুঠোফোন : ০১৭১১ ৯৭৪ ৩৭২

এই বিভাগের আরো খবর