শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বন্দর গণহত্যা ও একটি ইতিহাসের দায়

প্রকাশিত: ৩ এপ্রিল ২০১৯  

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত গণহত্যার প্রকৃত তথ্য ও চিত্র এখনো আমাদের মূল ইতিহাসের সাথে যুক্ত হতে পারেনি। এ সব তথ্য ও সংবাদ এখনো অনুদ্ঘাটিত এবং অবহেলিত। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা ত্রিশলক্ষ বলেছি সত্য; কিন্তু দেশের সকল গণহত্যার প্রকৃত তথ্য তুলে আনলে এ সংখ্য যে তার চেয়েও অনেক বেশি হবে সে বিষয়ে এখন অনেক গবেষকই একমত। কয়েকদিন আগে দেশের বিশটি জেলায় গণহত্যার পরিসংখ্যান সংবলিত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও তারা গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার ব্যপারে মত প্রকাশ করেছেন। 

 

নারায়ণগঞ্জে অনেকগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। ২৭ মার্চ প্রথম প্রতিরোধের গণহত্যা, ৪ এপ্রিল বন্দর গণহত্যা, ২৯ নভেম্বর বক্তাবলি গণহত্যা ইত্যাদি। কিন্তু জেলার প্রকৃত তথ্য এখনো অনুদ্ঘাটিত। নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দু’একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও, তা তথ্যবিকৃতি ও ভুল তথ্যে ত্রুটি যুক্ত। স্বল্পপরিশ্রমে ইতিহাস লিখনে যে বিচ্যূতি হয় এখানে তাই হয়েছে। তার পরেও শুরুটা যে হয়েছে, সেটাও কম কিসে।

 

শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমে নারায়ণগঞ্জ শহর, পূর্ব পাড়ে বন্দর। একসময় বন্দর পাটের কল, জাহাজ নির্মাণের ডকইয়ার্ড ও খাদ্য গুদামের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কদম-রসুল দরগাহ্র কারণে আড়াই’শ বছর ধরে পূর্ব বঙ্গে বন্দর গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। বৃটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে ইংরেজ ও আর্মেনিয়দের মাঝেমধ্যে বিচরণ করতে দেখা গেলেও অবাঙালি বিহারিদের পদচারণা কখনোই ছিল না। কিন্তু সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পরে রেডক্রসের উদ্যোগে বন্দরের বিভিন্ন স্থানে অবাঙালি বিহারিদের রিফিউজি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পরে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন দাঁড়ায় যে কিছু কিছু পাড়া-মহল্লা ও এলাকা তারা দখলে নিয়ে নেয়। 

 

বন্দর শহরতলি হলেও ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন জাতীয় সংগ্রামে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে বন্দরের ছিল সাহসী ভূমিকা। সে সময় সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের মাধ্যমে বন্দরের যুবক ও সংস্কৃতি কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে দেশবাসী রায় ঘোষণা করলে, এর কয়েকদিন পর একুশে ফেব্রুয়ারি সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের সদস্যরা বন্দরে বিভিন্ন বাড়ি-ঘর ও দোকান-পাটে কালো পতাকা উড়িয়ে দেন।

 

বন্দরে বসবাসরত বিহারিদের নেতা আইয়ূব মাষ্টারের আইয়ূব রেস্টুরেন্টেও তখন ক্লাব সদস্যরা কালো পতাকা উড়িয়ে দেন। কিন্তু পতাকা উত্তোলনের কিছুক্ষণ পর আইয়ূব মাষ্টার কালো পতাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে। ক্লাব সদস্যদের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ জনতা আইয়ূব রেস্টুরেন্ট ও কনভেনশন মুসলিম লীগের সে সময়ের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ আলীর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যার ফলে সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের সদস্য ও এলাকার যুবকদের প্রতি বিহারি ও মুসলিম লীগের লোকদের ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই আইয়ূব মাষ্টার ও মোহাম্মদ আলীর বাড়ি দু’টিই হয়ে উঠেছিল বন্দরে পাক সেনাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। 

 

একাত্তরে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মার্চের ১৭-১৮ তারিখ সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের নেতৃত্বে বন্দরে প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। এ প্রতিরোধ কমিটি বিহারিদের কাছ থেকে প্রায় চল্লিশটি রাইফেল-বন্দুক ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একটি অস্ত্রভাণ্ডর গড়ে তোলেন। ২৫ মার্চ টিক্কাখানরা যখন ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইটের নামে হাজার-হাজার নিরীহ বাঙালিকে  হত্যা করে চলেছে; বন্দরে তখন সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের মাঠে মঞ্চস্থ হচ্ছে সাত্তার ভূইয়া রচিত ও এস এম ফারুক পরিচালিত ‘অমর বাঙালি’ নাটক। যে নাটক পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তখন বাঙালির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এসব কারণে তখন বিহারিদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সিরাজদ্দৌলা ক্লাব।

 

একাত্তরের ৪ এপ্রিল ভোররাতে বিহারিদের সহায়তায় নবীগঞ্জঘাট ও দক্ষিণের কেরোসিনঘাট দিয়ে একসঙ্গে বন্দরে প্রবেশ করে পাক হানাদারবাহিনী। নবীগঞ্জ দিয়ে পাড় হওয়া গ্রুপটি ইস্পাহানী ও জেলেপাড়ার বহু বাড়ি-ঘর গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং এ এলাকা থেকে বহু লোককে ধরে বন্দর সিরাজদ্দৌলা ক্লাব মাঠে নিয়ে হাজির করে। ক্লাব মাঠে আসতে পথের দু’পাশের অসংখ্য বাড়ি-ঘর পাক সেনারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। কেরাসিনঘাট দিয়ে পাড় হওয়া গ্রুপটি ডকইয়ার্ডে উঠে সামনে অগ্রসর হয়ে হিন্দু-অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে থাকে। লালজির আখড়া ও বৃন্দাবন আখড়া গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে বহু লোককে ধরে সিরাজদ্দৌলা ক্লাব মাঠে নিয়ে আসে। 

 

পাক সেনাদের উভয় গ্রুপই সকাল ন’টার মধ্যে ক্লাব মাঠে এসে পৌঁছে। সে সময় মাঠের ক্লাব ঘরে আশ্রয় নেয়া সাধারণ মানুষ ও ধরে আনা বন্দিদের মোট ৫৮ জনকে পাক সেনারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রথমে গুলি করে হত্যা করে। পরে আশপাশের বাড়িঘর থেকে কাপড়-চোপড় ও মূলিবাঁশের বেড়া এনে লাশের উপরে ফেলে গানপাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পূর্বে হানাদার বাহিনী শীতলক্ষ্যা পাড় হয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে চলে আসে। বন্দর বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। বাড়ি-ঘর ফেলে জ্ঞানশূন্য সমস্ত মানুষ দিগ্বিদিক পালিয়ে যেতে থাকে। লাশের স্তূপ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসেন মুজিবুর রহমান কচি নামের এক কিশোর।

 

পোড়া বাড়ি-ঘর, মৃত মানুষের গন্ধ আর স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে শীতলক্ষ্যার পূর্বপারের বাতাস। রাতেই বন্দরের বিভিন্ন এলাকা বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। রাত গভীর হলে সে ক্লাব মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এলাকাবাসী ৫৪ জন হিন্দু-মুসলমান শহীদদের একসাথে গণ-কবরে সমাহিত করেন। নির্জন নিস্তব্ধ সে কবরের পাশে সারা রাত জেগে থাকে দল বেঁধে অসংখ্য জোনাকি। ধ্বংসস্তুপ আর অগ্নিদগ্ধ বন্দরের পাড়ে আছরে পড়তে থাকে শীতলক্ষ্যার কালঢেউ সারা রাত ক্ষোভে, দুঃখে, বিদ্রোহে ভোরের সূর্যোদয় পর্যন্ত। 

 

রফিউর রাব্বি
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠক এবং সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক 

এই বিভাগের আরো খবর