শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘প্লানা ফিলিং স্টেশন’ বদলে দিয়েছে ৬ নারীর জীবন

প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

জহিরুল হক (যুগের চিন্তা ২৪): একের পর এক গাড়ি প্রবেশ করছে প্রবেশের সাথে সাথেই  মাথায় ঘোমটা পড়া একজন নারী এসে গাড়িতে তেল ভরে দিচ্ছে। পাশেই আরেকজন নারী দাঁড়িয়ে থেকে তাকে সাহায্যে করছে। দৃশ্যটি বন্দরের কামতাল লাঙ্গলবন্দ এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে অবস্থিত ‘প্লানা ফিলিং স্টেশন’ এর।


সচারচর এ ধরনের দৃশ্য চোখে না পড়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই যে কারোই চোখ আটকে যাবে এখানে। কারণ এ ফিলিং স্টেশনে পুরষ নয় যানবাহনে জ্বালানী তেল ভরে দেয়ার কাজ করে নারীরা। তাই  স্থানীয়দের কাছে এ পাম্পটি পরিচিত ‘মহিলা পাম্প’ হিসেবে।


একদিকে যখন নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা,গুম, ধর্ষণের মত হাজারো চিত্র সমাজের নারী সমাজের গতিবেধ রোধ করছে  ঠিক তখনই সামনে এসে দাড়াচ্ছে একদল সাফল্যেময়ী নারীদের উদাহরণ। শুধু পড়াশুনা জানা নারী নয় পড়াশুনা না জেনেও যে আর্থিকভাবে সাবলম্বী হওয়া সম্ভব তারই এক অনবদ্য উদাহরণ এ প্লানা ফিলিং স্টেশন।


২০০৩ সাল থেকে নারীদের দিয়েই চলছে প্লানা ফিলিং স্টেশন। বর্তমানে এখানে কর্মরত রয়েছেন  ৬ জন নারী। দুই শিফটে সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনজন আর দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে বাকি তিনজন। এমনটাই জানালেন এ ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বাবুল।


রোববার দুপুর ২টা থেকে শুরু হয়েছে হ্যাপী, মালা ও জেসমিন আক্তারের শিফট। তাদের কেউ ৩ বছর যাবৎ কেউ সাড়ে ৪ বছর যাবৎ কেউ বা আগে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এখানে কর্মরত রয়েছে। প্রত্যেকেই বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে এখানে আসা।


‘জীবিকার তাগিদে ৫ বছর আগে সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে স্বামীর সাথে নারায়ণগঞ্জে পাড়ি জমিয়েছিলো হ্যাপী আক্তার। আর্থিক টানাপোড়েনে সংসারের হাল ধরতে স্বামীর সাথে সাথে নিজেও কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অতিরিক্ত  মোটা হওয়ায় কাজ দিতে চাইতো না কেউই। পরে এক প্রতিবেশীর পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জের ‘প্লানা ফিলিং স্টেশন’ এ কাজ নেয় হ্যাপী। মোটা হওয়ার বন্দনাটা এখানে আর পোহাতে হয়নি তার।


হ্যাপী আক্তার জানান, একদিকে যেমন পড়াশুনা জানতাম না অন্যদিকে ছিলো মোটা হওয়ার সমস্যা। এ কারণে কোথাও ভালো চাকরী পাচ্ছিলাম না। তারপর এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে এখানকার খোঁজ পাই। গত সাড়ে চার বছর যাবৎ এখানেই কাজ করছি। স্বামী-স্ত্রী দুজনের টাকায় সংসার সুন্দরভাবে চালাতে পারছি।


এ ফিলিং স্টেশনে ৮ বছর যাবৎ কাজ করছে খুলনা বাগেরহাট এলাকার মালা। জীবিকার তাগিদেই এখানেই আসা। দুই ছেলেমেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে ফিলিং স্টেশনের কোয়ার্টারেই থাকে।


মালা জানান, খুব ছোট থাকতেই বিয়ে হয়ে যায়। কষ্টকরে এসএসসি পর্যন্তই পড়াশুনা শেষ করি। তারপর স্বামীর সাথে এখানে চলে আসি। অন্য পেশায় কাজ করার মত সুযোগ পাইনি। পরে স্বামীর সাথেই এ ফিলিং স্টেশনে কাজ শুরু করি। এখানে কাজ করেই দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করছি।


অন্যজন জেসমিন এখানে কাজ করছে ৩ বছর যাবৎ। বিয়ের পর পরই ঢাকায় চলে আসা। তারপর এখানে কাজ শুরু করা। কেমন লাগে এখানে কাজ করতে জানতে চাইলে জেসমিন জানান, ভালো লাগে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ডিউটি করতে পারি। গার্মেন্টেসে চাকরি করলে তো বাচ্চা নিয়ে যাওয়া যায় না যেটা এখানে পারি। তাছাড়া এখানে মালিক অনেক সাহায্য করেন, সবাই মিলে কাজ করি নিজের বাড়ির মতো।


এ ফিলিং স্টেশনের  সবচেয়ে পুরোনো কর্মী রিক্তা আক্তার। গত ১৫ বছর যাবৎ এখানে সে কাজ করছে। ফিলিং স্টেশনের পেছনেই ফিলিং স্টেশনের কর্মীদের জন্য রাখা কোয়াটারেই পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। ইতিমধ্যেই তার ডিউটি শেষ হওয়ায়  সেখানেই কথা হয় তার সাথে।


ঠিক কবে এ স্টেশনে কাজ শুরু করেছিলো ঠিক করে মনে নেই তার। শুধু মনে আছে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য এক আত্মীয়র মাধ্যমে কিশোরী বয়সে এখানে আসেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এখানেই আছে।


রিক্তা আক্তার জানান, খুব ছোট থাকতে এখানে আসছি। তখন আনুমানিক বয়স হবে ১৪ বা ১৫। কাজটা দ্রুত শিখে যাওয়ায় ম্যানেজার স্যার বেতনভুক্ত করে আমাকে। তারপর থেকেই এখানেই আছি। প্লানা আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এ ফিলিং স্টেশনেই কাজ করি। পরিবার নিয়ে পাম্পের কোয়ার্টারেই থাকি। অনেকটা নিজের বাড়ির মতই সবাই মিলেমিশে পরিবারের মত থাকি। কারো কাছে হাত পাততে হয় না।


তবে নারী হিসেবে ফিলিং স্টেশনে কাজ করতে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তাদের। রিক্তা আক্তার জানান, এখানে কাজ করাটা সবাই ভালোভাবে মেনে নেয় না। সেটা সামাজিক হোক বা পারিবারিক। অনেকেই আছে এখানে যে তার পরিবার জানেই না যে তারা এখানে কাজ করে।  আগে তো আরও মেয়ে ছিলো। কারো বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকের পরিবার জানার পর এখান থেকে নিয়ে গেছে।  


কোনো কাজই ছোট না। তাছাড়া পড়াশুনা না জেনেও বা গার্মেন্টেস পেশার বাইরেও যে কাজ করা যায় এটাই আমরা প্রমাণ করতে চাই।

 

তাদের মতে, মৌখিকভাবে সমাজ পরিবর্তনের কথা বললেও মানুষের চিন্তা-ভাবনা এখনও পরিবর্তন হয়নি। ফলে এ সকল চিন্তাধারাই তাদের বিভিন্ন সময় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে।


একই স্টেশনে কাজ করে ২২ বছর বয়সী  তরুণ খলিল খান। এইচএসসি পাশ করার পর আড়াই বছর আগে এ ফিলিং স্টেশনে কাজ শুরু করে। খলিল খান জানান, আমরা এখানে নারী-পুরুষ বিষয়টি কখনওই মাথায় আনি না। আমরা একটা পরিবারের মত এখানে কাজ করি। কিন্তু অনেক সময় তিরস্কারের শিকার হতে হয় আমরা পুরুষ কর্মীদের।


অনেকেই তিরস্কার করে বলে যে ‘মেয়ে মানুষের সাথে কাজ করি। এটা সেটা। কিন্তু এসব আমলে নেই না। তবে এ সকল চিন্তা ধারার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাহলেই কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যেতে পারবো।


প্লানা ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বাবুল জানান, এ ফিলিং স্টেশনের শুরু থেকেই এখানে আছি। ২০০৩ সালে এ  স্টেশনটি নির্মাণের শুরু থেকেই এ স্টেশনটি নারীরা কাজ করে আসছে। তার উদ্দেশ্যে ছিলো সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করার। আর সে চিন্তা ধারা থেকেই নারীদের নিয়ে এ ফিলিং স্টেশনের যাত্রা শুরু হয়।


প্লানা ফিলিং স্টেশনের বর্তমান মালিক সাইফুল ইসলামের ছেলে ওয়াসিম জাবেদি (প্লানা) জানান, এ ফিলিং স্টেশনের যাত্রাটা মূলত আমার দাদা শুরু করে। তবে তখন থেকে আমার বাবা এর দেখাশুনা করত।  সেই থেকেই বাবা নারীদের দিয়ে প্লানা স্টেশনের কার্যক্রম শুরু করে। বাবার মতে নারীরা যদি গার্মেন্টে কাজ করতে পারে তাহলে ফিলিং স্টেশনে কিসের সমস্যা? তাছাড়া নারীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থিকভাবে সাবলম্বী করার জন্যই এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই চলছে।


তার দাবি ‘প্লানা ফিলিং স্টেশন’ বাংলাদেশের প্রথম ফিলিং স্টেশন যেটা নারীদের নিয়ে কাজ করছে।

এই বিভাগের আরো খবর