শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক বিক্রি

প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারি ২০২০  

বিশেষ প্রতিনিধি (যুগের চিন্তা ২৪) : নারায়ণগঞ্জে ফার্মেসীগুলোতে  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই মিলছে এন্টিবায়োটিক ঔষধ। ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া এক রোগের ঔষধ  সেবন করতে গিয়ে অন্য আরেকটি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এমন অবাধ ঔষধ বিক্রি অব্যাহত থাকলে খুব শীঘ্রই জেলার জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন ঔষধ ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। 


এদিকে,  প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওভার দ্য কাউন্টার ঔষধ (ওটিসি) ব্যতীত অন্যান্য  প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি না করার প্রসঙ্গে ২০১৯ সালের ১৬ মে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয় ‘একই সঙ্গে এন্টিবায়োটিক এর ফুল কোর্স যাতে সেবন করে সে বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করার জন্য এবং ফুল কোর্স এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করা হয়। এই নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 


এদিকে, জেলাজুড়ে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রি হয়। এমনকী অনেক অবৈধ দোকানদার সরকারি ঔষধও বিক্রি করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলার ড্রাগ সুপার মোঃ ইকবাল হোসেন জানান, গতবছর এসকল অভিযোগে  জেলায় ১১৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। 


এ সময় জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। নানা মেয়াদে সাজা পেয়েছে ১৫ জন। সাজা প্রাপ্তদের মধ্যে আড়াইহাজার উপজেলায় ২ জন, বন্দর উপজেলায় ৪ জন, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজিতে ৪জন, শহরের ডিআইটি মার্কেট থেকে ২ জন হকার, ২ জন কেমিস্ট ও মাদ্রাজ হারবালের মালিক  মোস্তফা কামাল অন্যতম। 


খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় বিসমিল্লাহ হারবালে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে সাজা প্রদান করে ভ্রাম্যমান আদালত। দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা খুঁজছিলেন নকল মুভসহ বিভিন্ন দামি ব্রান্ডের কসমেটিক সামগ্রী ও দামি ঔষধ নকল করে বাজারজাতকারী ২ প্রতারককে। 

বন্দরের মদনপুর ইস্ট টাউন এলাকার খাদিজাতুল  কোবরা মাদ্রাসার নীচতলা থেকে মুভ এর ফ্যাক্টরী মালিকসহ ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হয় মাদ্রাজ হারবালের মালিক মোস্তফা কামাল। 


মালিক গ্রেফতারের পর পরই মাদ্রাজ হারবালের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে আধুনিক ইউনানী  মেডিক্যাল। বন্দরে মোসারফসহ ২ জনকে গ্রেফতার করা হয় লাইসেন্সবিহীন দোকান, সরকারি ঔষধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রির দায়ে। 

সরেজমিন চিত্র :

গতকাল নগরীর কয়েকটি ফার্মেসী দোকানে গিয়ে দেখাগেছে,  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির দৃশ্য। সর্দি-কাশি জ্বরে আক্রান্ত নগরীর গলাচিপা এলাকার ফাতেমা বেগম (২৮)।  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই তিনি মহল্লার ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনতে গেলেন। ফার্মেসীর ওষুধ বিক্রেতা দেরি করেননি, ফাতেমার হাতে তিনিও তুলে দিলেন এন্টিবেয়োটিক ওষুধ। শুধু তাই নয়, আরও  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ ও কিছু ডাক্তারি পরামর্শ। 


পশ্চিম দেওভোগ নাগবাড়ি এলাকায় এক রিক্সাচালক জ্বর নিয়ে এসেছেন নাগবাড়ি মোড়ের একটি ফার্মেসীতে। তিন ধরে জ্বরের কথা বলতেই দোকানী (এলাকাবাসী ডাক্তার বলে সম্বোধন করে) রিক্সা চালককে নাপা এক্সটেন্ড, কতগুলি এন্টিবায়োটিক ধরিয়ে দিলেন। 


এ সময় রিক্সাচালক শরীর ব্যথার কথা বলাতে দোকানী তাকে ইনজেকশন ও দিলেন। সবমিলিয়ে বিল ধরা হল ২৫০ টাকা। রিক্সাচালক অসহায়ের মত একশত টাকার একটি পুরনো নোট বের করলেন লুঙ্গির কাছা থেকে। তথাকথিত ডাক্তার রেগে গেলেন। বললেন মিয়া ইনজেকশনের দাম ৬০ টাকা ঔষধের দাম দিবানা ? ফয়সালা হল সব ঔষধ দুই পিস করে একশ টাকার মধ্যেই বিল মিটিয়ে নিলেন দোকানী। 


তবে রিক্সাচালককে বলে দিলেন এন্টিবাইটিক দিছি। এই ঔষধ পুরা কোর্স না খাইলে কাজ হবেনা। উল্টো বিপদ বাড়বে। রিক্সাচালকটি বিড় বিড় করতে করতে দোকান থেকে কয়েক কদম সামনে এসে বললেন, ওষুধ বিক্রির ধান্দা আর কি ! রিক্সাচালক ওই কোয়াক ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করেনি। মনে করেছে  বেশি ঔষধ বিক্রি করার জন্য ডাক্তার তাকে একটু ভয় দেখালো। 


আসলে এই দুই চারটা ট্যাবলেট সেবন করলেই রোগ সেরে যাবে।  শহরের ১নং বাবুরাইলের সুমাইয়া বেগম (৩২)। তার শিশু পুত্রের জন্য জ্বরের জন্য এন্টিবায়োটিক সেফ-থ্রি চাইলে ফার্মেসী বিক্রেতা তাকে দিয়ে দিলেন।  কোন ধরনের  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই শিশুদের এন্টিবায়োটিক ওষুধটি বিক্রি করলেন।


এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস সমিতি নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি মো: শাহজাহান খান জানান, নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ফার্মেসীগুলোতে চিকিৎসকের  প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সতর্কবার্তাতেও কাজ হয়নি। কিন্তু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে অনেক রোগী।


নগরীর বিভিন্ন স্থানে আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে ঔষধের দোকান (ফার্মেসী)। ওই সব দোকানে ঔষধ বিক্রির কাজে জড়িত শতকরা ৯০ ভাগেরই ঔষধ সম্পর্কে ভাল ধারণা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে জানতে পারে না রোগীরা। আর বড় দুঃখের বিষয় হচ্ছে ডাক্তারি  প্রেসক্রিপশন চাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না ঔষধ বিক্রেতারা। 


দোকানে সামনে দাড়িয়ে ওষুধের নাম উল্লেখ করলেই তা ক্রেতার হাতে তুলে দেয়া হয়। আবার অনেক দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ পুরনো  প্রেসক্রিপশন নিয়ে অনেক রোগী ফার্মেসীতে যায়।  প্রেসক্রিপশনের তারিখ ও ওষুধ খাওয়ার সময়সীমা দেখার প্রয়োজনবোধ ও করেন না বিক্রেতারা।


ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলার ড্রাগ সুপার মোঃ ইকবাল হোসেন  দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ২০১৯ সালের ২৭ জুন থেকে নকল ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিষয়ে মতবিনিময় সভা শুরু হয়। এ পর্যন্ত পথসভাসহ ৫০ টি সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা হয়েছে। আমরা ঔষধ দোকানদারদের মাঝে ৮০০ খাতা বিতরণ করেছি। নিয়ম হচ্ছে দোকানী এন্টিবায়োটিক ঔষধ বিক্রির সময় তা লিপিবদ্ধ করে রাখবে। এই অনেকে মানছেন। অনেকে মানছেন না। 


জেলায় বৈধ ঔষধের দোকান ৫ হাজার। অবৈধ দোকান ও ৫ হাজার। এ বিষয়গুলো নিয়মিত দেখভাল করার মত লোকবলের অভাব রয়েছে। তবুও আমরা সচেতনতা তৈরীর চেষ্টা করছি। তবে এন্টিবায়োটিক বিক্রির বিষয়ে শক্ত আইন নেই। তবুও আমরা তঃপর। ঔষধ কোন খাদ্যদ্রব্য নয়, নিয়মমাফিক ব্যবহার না করলে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। 


তিনি বলেন, ওটিসি ব্যতীত অন্যান্য  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি না করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কেউ এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ড্রাগ অ্যাক্ট এর ১৯৪০ ধারায় অপরাধ এ গণ্য হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে মোটা অংকের জরিমানার বিধানও রয়েছে। তবে নতুন আইনে সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকা জরিমানা বিধান রেখে নুতন আইন পাশ করার সুপারিশ করা হয়েছে। 

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সূত্র মতে, ওটিসি ওষুধ মানে ওভার দ্য কাউন্টার ঔষধ, যেগুলো আমরা কোন  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ দোকন বা ফার্মেসী  থেকে কিনে থাকি। সাধারণভাবে বলতে গেলে এই ধরনের ওষুধ কিনতে  গেলে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের কোন  প্রেসক্রিপশন লাগে না। 


সচারাচর স্থানীয় যে  কোন দোকানে পাওয়া যেতে পারে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ৩৯টি ওষুধ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। অন্য ঔষধের অনুমোদন না দিলেও নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে এন্টিবায়োটিকসহ সব ধরনের ওষুধ।


জাতীয় ওষুধ নীতি : 

জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬-এর ধারা ৩ (১৫)-তে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রিযোগ্য ওষুধের তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে বলা হয়েছে ‘উন্নত দেশগুলোর আদলে সাধারণভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে’ এই তালিকা প্রণয়ন করা হবে। ধারা ৪ (১৮) -এ ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রিযোগ্য ওষুধ সম্পর্কে বলা হয়েছে নিবন্ধিত অ্যালোপেথিক, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধের মধ্য থেকে সাধারণভাবে ব্যবহৃত এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধ তালিকাভুক্ত করা হলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সময় সময় এ তালিকা হালনাগাদ করবে বলে ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে।


বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এই নীতিমালা অনুযায়ী ৩৯টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই দিতে পারেন ফার্মেসির বিক্রেতা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃমির ট্যাবলেট (এলবেনডাজল চিউয়্যাবল ট্যাবলেট), গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট বা সিরাপ বা সাসপেনশন (এন্টাসিড চিউয়্যাবল ট্যাবলেট বা সাসপেনশন), ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট, বেনজিল বেনজোয়েট লোশন, চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের লোশন, চোখ ও কানের ড্রপ, ব্যথার জন্য জেল, কনডম ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল, গ্লিসারিন সাপোজিটরি, মেট্রোনিডাজল ট্যাবলেট (এন্টিবায়োটিক) বা সাসপেনশন, গ্যাস্ট্রিকের সিরাপ (মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া), মাউথ ওয়াশ, মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল বা ড্রপ, ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল, ওরস্যালাইন, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট/সিরাপ/সাসপেনশন/ সাপোজিটরি, পারমেথ্রিন ক্রিম, রেনিটিডিন ট্যাবলেট, পোভিডন আয়োডিন, ভিটামিন এ ক্যাপসুল, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (একক বা যৌথ) ট্যাবলেট/সিরাপ/ড্রপ, জাইলোমেটাজোলিন জিরো পয়েন্ট ওয়ান নাসাল ড্রপ)।
 

এই বিভাগের আরো খবর