শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সরকারের পাশাপাশি আপনিও আসুন

প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

বেশ কিছুদিন হয় আমার এক ভাই তার ফেসবুকে খাদ্যে ভেজাল নিয়ে লেখালেখি করে যাচ্ছে। লেখালেখির মাঝে খাদ্যে ভেজাল বিরোধীর পক্ষে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। হঠাৎ ফেসবুক খুলে দেখি নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে খাদ্যে ভেজাল বিরোধী সমাবেশ করে ১৫/২০ জনের ছবি পোস্ট করেছে। মূলতঃ আমরা কেউ ভেজালের পক্ষে নই। সবাই ভেজালমুক্ত পরিবেশ চাই।

 

সময়ের বিবর্তনে মানুষের মানবিকতা, ধর্মবোধ, সংযম ইত্যাদি অনেকটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে বেসামাল অর্থলোলুপতা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মঅহংকার ইত্যাদি দানা বেঁধেছে। স্বাধীনতা উত্তর বিশেষ করে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর কারণগুলো অনেকেরই জানা। ঘাট যদি অঘাট হয় আর অঘাট যদি ঘাট হয় তবে শ্রেণি বৈষম্য থাকে না। মানির মান বিশেষ করে তেল ঘিয়ের মূল্য এক হলে যা হয় আর কি?

 

ভেজাল খাদ্য খেয়ে নানা রকম অসুখ-বিসুখ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অকালে অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এক সময় আত্মীয়-স্বজন অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে, স্বজনরা ফল নিয়ে হাসপাতালে রোগী দেখতে যেতেন। বর্তমানে তার উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ভেজাল ফল খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ফল-দুধ হচ্ছে আদর্শ স্বর্গীয় খাদ্য। সেই সব খাদ্যে যদি ভেজাল দেয়া হয় তাহলে কি বলার আছে? আর এরা কোন শে্িরণর মানুষ। তাদের চিহ্নিত করার দরকার। তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ শাস্তি বিধান করার দাবি রাখে। 

 

২০১৮ সালে ঢাকার রাজপথে কয়েকশত টন আম প্রকাশ্যে নষ্ট করা হয়। এ ঘটনার পরবর্তী ফরমালিনমুক্ত ফল বাজারজাত করা হয়। ক্রেতা সাধারণ ফরমালিনমুক্ত ফলের সাধ গ্রহণ করেছিল। সরকার তথা, র‌্যাবের এ কর্মকা- প্রশংসিত হয়। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে ভেজাল বিরোধী তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তীতে তা অনেকটা ভাটা পরে। মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যদি না হয়, দেশের মানুষের প্রতি যদি ভালবাসা না থাকে, তবে আইন করেও তা প্রতিহত করা কষ্টকর। তবে সরকার ইচ্ছা করলেই অনেক কিছু করতে পারে এ কথা সত্য।

 

ভেজালের কথা বলছি কেন? সিজনাল ফল আম। আমের প্রতি আমরা সবাই দুর্বল। বিশেষ করে আম-কাঁঠাল। আম কিনে অনেক সময় বাসায় তিক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফরমালিন আম খেতে জিহ্বা-গলা তিক্ত হয়ে যায়। চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। আমকে বলা হয় অমৃত ফল। কিন্তু এই অমৃত ফলে ফরমালিন দিয়ে গরল (বিষ) ফলে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু একটি আপেল না খেয়ে ৫ মাস তার ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। হায় আপেল তোমায় কোন কারিগর বানাইয়াছে নষ্ট হয়ে শক্ত হয়ে রয়েছো যে? আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, আনারস, নাসপাতি কার কথা বলবো সর্বত্রই চলছে ফরমালিনের রাজত্ব।

 

নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। এই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। খাদ্য সমস্যা সমাধানে এমন কি খাদ্য উৎপাদনে সরকার অঢেল টাকা খরচ করলেও নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে প্রশাসন কতটুকু মনোযোগী তা সংশয়ের উর্ধ্বে নয়। সরকার নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ নামে একটি আইনের অধীনে আনে। আইন প্রণয়ন করেই বগল বাজাচ্ছে খাদ্য কর্তৃপক্ষ। নিরাপদ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ যাদের কাজ তাদের শুধু দালান কোটা সাজিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। ভেজালমুক্ত খাদ্য আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া যেন সমর্থক শব্দ।

 

দুর্ভিক্ষ, মন্দা ছিল যে দেশের নিত্যসহচর তা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। দুর্ভিক্ষ অভাব খাদ্য ঘাটতির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য সরবরাহ করে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ বনে যায়। সেই ধারাবাহিকতার পথ ধরে অনেক ব্যবসায়ী ওঁৎ পেতে থাকে বিশেষ করে বিভিন্ন পালা পার্বণ সামনে রেখে এ কাজগুলো করে থাকে। বাঁধা নিষেধ বা প্রতিবন্ধকতার তোয়াক্কা করে না। খাদ্য উৎপাদনে বর্তমান সরকার সাফল্য অর্জন করেছে। চার দশক আগের চেয়ে মানুষ প্রায় দ্বিগুণ খাদ্য গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। 

 

খাদ্য নিরাপত্তাকে পাশ কাটিয়ে খাবারে ভেজালের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। খাদ্য রফতানি ব্যবসায় হোঁচট খেতে হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় খাদ্য চালান ফেরত আসছে নিরাপত্তার অজুহাতে। খাবারে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। ফল দ্রুত পাকাতে দেওয়া হচ্ছে কার্বরাইড। সবজিতেও ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। সোনালী আশে পানি আর বালি মেশানোর ফলে চীন থেকে জাহাজ ফেরৎ আসে। রূপালী ইলিশ ও চিংড়ি মাছে স্টিলের টুকরো ও জেলি দিয়ে ওজন বৃদ্ধির কারণে রফতানিতে বদনাম সৃষ্টি হয়। সরকার বৈদেশিক আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এ ঘটনাগুলো অতীত দিনের। 

 

অপূর্ব আজাদের ভাষায়- বাংলাদেশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে সারাবিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষস্থান। রপ্তানিতে শিল্পখাত দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশে শিল্পায়নের ধারাকে উৎসাহ জোগাতে ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু তাই নয় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১টি ইকোনমিক জোন। মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব শাইখ সিরাজ দেশের কৃষি খাতকে জাগ্রত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশপ্রেমকে সামনে রেখে অন্তর নিংড়ানো ভালবাসায় গ্রামের সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে নির্ভেজাল ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করে যাচ্ছেন।

 

মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে জীবনী শক্তি অর্জন ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু ভেজাল ও ক্ষতিকর খাদ্য মানুষের জীবনী শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। সুস্থতার বদলে অসুস্থতা বরণ করছে। অনিরাপদ খাদ্যে ক্যান্সারসহ নানান জটিল রোগের বিস্তার ঘটছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য তা হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের রোগীর অভাব নেই। ভেজাল খাদ্যের বদগুণে অপুষ্টিজনিত কারণে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এসব দৃশ্য দেখে আমার সেই খাদ্যে ভেজালমুক্ত পরিবেশের দাবিদার বন্ধুর কথাই ভাবছি। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার উদ্যোগী হতে হবে। জনস্বার্থে এটি সরকারের কঠোর কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

 

রণজিৎ মোদক
লেখক-শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি-ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ
মুঠোফোন : ০১৭১১ ৯৭৪ ৩৭২

এই বিভাগের আরো খবর