শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নাসিকের পর বর্জ্য অপসারণ নিয়ে বিপাকে ফতুল্লার ৫ ইউনিয়ন

প্রকাশিত: ২১ জুলাই ২০১৮  

মাহফুজ সিহান (যুগের চিন্তা ২৪) : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) পর  নারায়ণগঞ্জ-৪(ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের পুরো ফতুল্লা এলাকার ইউনিয়নগুলোর গৃহাস্থলীর ময়লা আবর্জনা অপসারণ (বর্জ্য) নিয়ে বিপাকে পড়েছে জনপ্রতিনিধিরা। টানা ৫ দিন আবর্জনা অপসারণ করে ডাম্পিংয়ের কোন স্থান না পাওয়ায় বসত বাড়ি থেকে বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভবপর হচ্ছে না।  

ফলে নরকীয় অবস্থা তৈরী হয়েছে ফতুল্লা, কুতুবপুর, এনায়েতনগর, কাশিপুর, বক্তাবলীর একাংশের এলাকায়। ময়লার দূর্গন্ধে এসব এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। জনপ্রতিনিধিরাও সমস্যা সমাধানে দ্রুত পথ খুঁজছে। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় ময়লার দূগর্ন্ধে জনজীবন অতীষ্ট হয়ে উঠেছে।

এতোদিন এসব এলাকার বর্জ্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে জালকুড়িতে ডাম্পিং করা হতো। সোমবার (১৬ জুলাই) দুপুর আড়াইটার দিকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্জ্য ডাম্পিংয়ের সময় জালকুড়ি লিংক রোডে বর্জ্য ফেলার অপরাধে দুজন কর্মী আনোয়ারুল (৩০) এবং নুরুজ্জামান  (৩২) কে ভ্রাম্যমাণ আদালতে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কারাগারে প্রেরণকৃত দুই পরিচ্ছন কর্মী ইউনিয়নের বর্জ্য অপসারনের কাজে নিয়োজিত ছিলো। দীর্ঘ ৫ দিন বর্জ্য অপসারন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এরপর থেকেই ইউনিয়নগুলোর বসত বাড়ি থেকে বর্জ্য অপসারন করতে পারছিলো না পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। দীর্ঘ ৫ দিন যাবত বর্জ্য অপসারন না হওয়ায় ময়লা-আবর্জনার পাহাড় জমেছে ফতুল্লা এলাকায়।

এদিকে ময়লা সংগ্রাহকরা বর্জ্য অপসারণ না করায় বেশ ভোগান্তিতে আছেন বলে জানান লালপুর পঞ্চায়েত সভাপতি ও  জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর সোহেলের পিতা মীর মোজাম্মেল হক।  তিনি বলেন, গত ৫-৬ দিন যাবত ময়লা বাসা থেকে নিচ্ছে না বর্জ্য সংগ্রাহকরা। পুরো এলাকা ময়লার দূর্গন্ধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থান নেই। অতিদ্রুত এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দরকার।

তুল্লা রেলস্টেশন এলাকার পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আব্দুল আজিজ বলেন, বিগত ৪-৫ দিন যাবত বাসাবাড়ির ময়লা নিয়ে যাচ্ছে না বর্জ্য অপসারনকারীরা। তারা বলে, ময়লা ফেলার না কি কোন জায়গা নেই। ময়লার দূর্গন্ধে পুরো এলাকায় একটি অসুস্থ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। খুবই কষ্টে আমরা দিনাতিপাত করছি। জরুরী ভিত্তিতে এর সমাধান দরকার।

ফতুল্লা আফাজনগর পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি টিটু বলেন, গৃহস্থলির ময়লা ঠিকমত নিচ্ছে না বর্জ্য সংগ্রাহকরা। আমরা এলাকাবাসী খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছি। ময়লার দূর্গন্ধ সর্বত্র। এ সমস্যা থেকে খুব শীঘ্রই মুক্ত না হতে পারায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

ইউনিয়নের বর্জ্য অপসারনের কাজে সম্পৃক্ত সুপাইভাইজার মো. তপন জানান, কোথাও বর্জ্য ডাম্পিংয়ের জায়গা না থাকায় বর্তমানে বর্জ্য অপসারন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কর্তৃপক্ষ জায়গার ব্যবস্থা না করতে না পারায় আমরা ময়লা ডাম্পিং করতে পারছি না। বিগত ৪- ৫ বছর ধরে এসব ইউনিয়নের ময়লা লিংক রোডের পাশেই ডাম্পিং করা হতো। কিন্তু তখন কোন বাধার সম্মুখীন হতে হতো না। কিন্তু সিটি করপোরেশন যখনই লিংক রোডে কয়েকদিন সিটির ময়লা ডাম্পিং করা শুরু করলো তখন থেকেই ময়লা ফেলায় বাধা প্রদান করা হয়।

সমস্যা সমাধানের জন্য ১৭ জুলাই ফতুল্লা চেয়ারম্যান ও কুতুবপুর চেয়ারম্যান সাথে ইউএনও এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যক্তিদের সাথে মিটিং হয়। তখন ইউএনও সাফ জানিয়ে দেন কোনক্রমেই লিংকরোডে বর্জ্য ডাম্পিং করা যাবে না। তাই আমরা গৃহস্থলির বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারছি না।যেখানে ময়লা ফেলার বিকল্প ডাম্পিং করতে বলা হয়েছে সেখানকার রাস্তায় কোমড় পর্যন্ত পানি।  কিভাবে ওখানে বর্জ্য ডাম্পিং করা সম্ভব। তাই উপায়ন্তর না দেখে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।  

ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের  চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপন জানান,  আসলে কি বলবো, আমি নিজেও ভুক্তভোগী। ময়লা ফেলার জায়গা না থাকায় বর্জ্য সংগ্রাহকরা ময়লা নিচ্ছে না। জায়গায় জায়গায় ময়লার স্তুপ পড়ে আছে। পুরো এলাকার মানুষ বেশ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। আমরা একটি জায়গা দেখেছি কিন্তু সেটি চূড়ান্ত হয় নি।

কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম সাইফুল্লা বাদল জানান, বসতবাড়ির গৃহস্থলির বর্জ্য ডাম্পিং করা এখন রাস্তা-ঘাট তৈরী করার চেয়েও বড় সমস্যা। কোথাও ময়লা ফেলার জায়গা নেই। আমি আমার ইউনিয়নের মানুষের ময়লা ফেলার জন্য একটি জায়গা ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সেখানে এনায়েতনগরেরও কিছু ময়লা ফেলছে। তবে সবাইকে এখানে ময়লা ফেলতে দেয়া সম্ভবপর নয়। ময়লা ডাম্পিংয়ের একটি সুরাহা করা অতীব জরুরী। মানুষ অনেক কষ্ট পোহাচ্ছে।

কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু জানান,  ফতুল্লার রেলস্টেশনের পাশে জাবেদুল্লা ফ্যাক্টেরীর পেছনে ময়লা ডাম্পিং করার জন্য জায়গা দেখে এসেছিলাম। সমস্ত বর্জ্য সংগ্রাহকদের সেখানে ময়লা ডাম্পিং করতে বলেছে। তবে সেখানে রাস্তা-ঘাটে কাজ চলছে বিধায় সেটি করতে বিলম্ব হচ্ছে। ময়লার গাড়ি যাতে যেতে পারে সেকারণে রাস্তায় বালি ফেলার কাজ করছে।

ক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জানান, মানুষ যতদিন থাকবে, ময়লা আবর্জনা ততোদিন তৈরী হবেই। এখন এগুলো যত্রতত্রভাবে না ফেলে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমি আমার ইউনিয়নে ময়লা ফেলার একটি জায়গার ব্যবস্থা করবো। এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে বসে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাবো। গৃহস্থলির বর্জ্য অপসারণ না হওয়ায় মানুষ বেশ ভোগান্তি পোহাচ্ছে।

এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.আসাদুজ্জামান জানান, এলাকার মানুষ ময়লা নিয়ে বেশ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। ময়লার দূগন্ধে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সমস্যা সমাধানে আমরা এমপি সাহেবের (সাংসদ শামীম ওসমান) সাথে বসার কথা ভাবছি। আশা করছি অতি দ্রুত বিষয়টির একটি সুরাহা হবে।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বেগম  বলেন, বর্জ্য সংগ্রহ না করার কোন কারণ নেই। কেননা ময়লা ফেলার জন্য ইতিমধ্যে আমরা একটি জায়গা বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। জায়গা ব্যবস্থা করে দেয়ার পরও যদি বর্জ্য সংগ্রহ বন্ধ রাখে সেটির জন্য আমরা দায়িত্ব নিতে পারবো না। ময়লা ফেলার জন্য আমরা ৭ একর সরকারি খাস  জায়গা বন্দোবস্ত করে দিয়েছি।

ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে জায়গাটি দেখিয়ে দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে ইউনিয়নের ময়লাগুলো ওখানে ফেলা হবে। ময়লা ফেলার জায়গায় পৌছানোর রাস্তাটি ভাঙ্গা থাকার কারণে এর বিকল্প হিসেবে আরেকটি  জায়গা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।

রাস্তাটি মেরামত করতে বা ওখানে একটি নতুন রাস্তা তৈরী করতে ১৫ দিন বা ১ মাস সময় লাগবে ততোদিন পর্যন্ত বিকল্পস্থানে ময়লা ফেলতে বলা হয়েছে। এরপরও যদি ময়লা কেউ না ফেলে  তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই।

উল্লেখ্য, এর আগে নারায়ণগঞ্জ শহরের গৃহাস্থলীর ময়লা আবর্জনা অপসারণ নিয়ে আবারও বিপাকে পড়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। অস্থায়ীভাবে জালকুড়িতে ময়লা ফেলে আসছিল পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। কিন্তু সদর উপজেলা ইউএনও বাধা দেয়ায় কয়েকদিন ধরে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা বাসা বাড়ির ময়লা অপসারণ বন্ধ রাখা হয়।

গত ২৭ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা চারদিন আবর্জনা অপসারণ বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার আবারও আবর্জনা বসত বাড়ি থেকে অপসারণ হলেও এগুলে ফেলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করে সিটি করপোরেশন। নাসিক তখন জানায়, ইসদাইরে ওসমানী স্টেডিয়ামের পাশে নিজস্ব জায়গাতে আবর্জনা ফেলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।

একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কাশীপুরের একটি জায়গাতেও। ময়লা আবর্জনার জায়গা না পাওয়ার পর ১ জুন সন্ধ্যায় সিটি করপোরেশনের চারটি গাড়ি নিয়ে রাখা হয় শহরের খানপুরে জেলা প্রশাসকের বাংলোর সামনের সড়কে। কোথাও ময়লা ফেলতে না পেরে সিটি করপোরেশনের নির্দেশেই প্রতিবাদ স্বরূপ এখানে গাড়ি রাখা হয়েছিলো বলে দাবি করে নাসিক।

পরে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ১৮ নং ওয়ার্ডের সৈয়দপুরে ৬ একর সরকারি খাস জমিতে সিটি করপোরেশনের ময়লা ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এখন ওখানেই নাসিক গৃহস্থলির বর্জ্য ডাম্পিং করছে।

এ মাসের ১৮ জুলাই নাসিকের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে ডিসি বাংলোর সামনের নাসিকের ময়লার ট্রাক রাখা প্রসঙ্গে মেয়র আইভী বলেন, নাসিকের ময়লা ফেলা নিয়ে একটি কাজ করতে বাধ্য হয়েছি, জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে প্রতীকীমূলক কয়েকটি ময়লার ভ্যান রাখতে।

আমরা কাশিপুর ইউনিয়নে সরকারের খাস জমিতে ময়লা ফেলতে গেলাম তখন সাইফুল্লাহ বাদল তাঁর সমস্ত গুন্ডাপান্ডা দিয়ে আমাদের বাঁধা দিয়েছে। লিংক রোডে ময়লা ফেলতেও বাঁধা পেয়েছি। যার কারণে জেলা প্রশাসকের বাসার সামনে ওভাবে প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। কাউকে ছোট বা হেন করবার জন্য নয়।

আমরা এর পরদিনই দীর্ঘদিন যাবত দাবি করা ১৮ নং ওয়ার্ডে জায়গাতেই ময়লা-আবর্জনা  ফেলার অনুমতি পাই। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার জন্য সরকার জমি কেনার জন্য ১৯২ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছে। আমরা সে টাকা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করবো। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে বছর দেড়েক সময় লাগবে।

 

এই বিভাগের আরো খবর