শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জে রাজউক ব্যর্থ !

প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯  

বিশেষ প্রতিনিধি (যুগের চিন্তা ২৪) : রাজউক পুরোপুরি ব্যর্থ! রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি নারায়ণগঞ্জে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেনা। বিল্ডিং এর প্ল্যান পাশ করাটাই যেন তাদের মূল কাজ। সেই প্ল্যান অনুযায়ী বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে কি না এ বিষয়ে আর দেখভাল করা হয়না। 

ফলে রাজউক থেকে পাশ করিয়ে আনা প্ল্যান কখনো কখনো আমূল বদলে যায়। যার দরুন দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন  বোদ্ধামহল ও নগরবিদগণ। 

শহর ও শহরতলীতে ‘বিল্ডিং কোড’ মানা দূরের কথা-অধিকাংশ ভবন মালিক বিল্ডিং কোড কি তাই জানেন না। অথচ যুগের পর যুগ ধরে নারায়ণগঞ্জ জেলায় নির্মিত হয়ে আসছে সুরম্য অট্টালিকা। এই শহরে ভবন ধ্বসের ঘটনা শুরু হয়েছিল চাষাড়ায় মরহুম তারু সর্দারের মেয়ে জামাতা নুর হোসেন চেয়ারম্যানের বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার মধ্যে দিয়ে। 

আশির দশকের এই বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার ঘটনার স্মৃতি হাতড়ে গল্প করেন অনেক প্রবীণ। সেই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছিল ৪ জনের।  সেই থেকে শুরু শহরে কিম্বা শহরতলীতে বিল্ডিং ধ্বসে পড়া ও একদিকে কাত হয়ে দেবে যাওয়ার ঘটনা কয়েক বছর অন্তর ঘটেই চলছে। তবুও বিল্ডিং কোড নিয়ে কেহ মাথা ঘামাতে চাননা। রাজউক থেকে প্ল্যান পাস করিয়ে আনতে পারলেই  কেল্লাফতে।  হোক ডোবা কিম্বা নালার পাড়। 

একতলা ভবনের উপর দিনে দিনে উঠানো হয় চারতলা। ধ্বসে না পড়া পর্যন্ত ভবন মালিক বিষয়টি থোরাই  কেয়ার করেন। কারো কোন নিষেধ বা সতর্ক বাণী  কানে তোলেন না। দুর্ঘটনা ঘটলে পালিয়ে যান বাড়ির মালিক। 

খাঁনপুরে একটি ভবনের উপর হেলে পড়ে আরেকটি ভবন। দু’টি ঘটনায় তদন্ত হয়েছে।  সেই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে  বিল্ডিং কোড না মানার বিষয়টি। ১নং বাবুরাইলে ভবন হেলে পড়ার পরপরই ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং টীম। 

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনটি সিটি কর্পোরেশনের এলাকাভূক্ত নয়। কিন্তু “রাজউক” কর্তৃপক্ষের আওতাভূক্ত। “রাজউক” তার পরিধিভূক্ত এলাকাসমূহের নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি জোরদারভাবে চালাতে সমর্থ হলে এ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো এবং এরূপ দূর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেতো।

যেহেতু “রাজউক” এর বর্তমান কাঠামোর আওতায় ভবনের নকসা অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করা সম্ভব হচ্ছে না এবং নির্মাণ তদারকি প্রক্রিয়াও অত্যন্ত দূর্বল; সেহেতু নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের এলাকার নতুন ভবন তৈরীর নকসা অনুমোদন ক্ষমতা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নিকট এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে জেলা পরিষদে ক্ষমতা অর্পন করা হলে এ সকল অনিয়ম অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হবে। 

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতার বাহিরে ১নং বাবুরাইল, বড় বাড়ি, ইউনিয়ন-কাশিপুর, থান-ফতুল্লা, উপজেলা-নারায়ণগঞ্জ সদর, জেলা-নারায়ণগঞ্জ, ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। 

পরিদর্শনকালে ভবন মালিককে পাওয়া না যাওয়ায় স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে ইঞ্জিনিয়াররা জানতে যে, ভবনটি পার্শ্ববর্তী বাবুরাইল খালের ভিতরে ভরাট মাটির উপর যথোপযুক্ত ফাইন্ডেশন ব্যতীত ও ডিজাইন প্রকৌশলীর অনুমোদন ব্যতিরেকে নির্মাণ করা হয়ে ছিল এবং উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজও চলমান ছিল। দূর্বল ভিত্তির উপর অতিরিক্ত ভার চাপিয়ে দেয়ার কারণে ভবনটি ধ্বসে গেছে মর্মে ধারণা করা হয়। 

খাঁনপুরের ঘটনা :
খাঁনপুরের ঘটনা সম্পর্কে নাসিক এর ইঞ্জিনিয়ারিং টীমের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনদ্বয় নির্মণে কোন  সেটবেক মানা হয়নি। এক্ষেত্রে ভবন নির্মাণে বাংলাশেদ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রাজউকের কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।

যেহেতু রাজউক বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত সেহেতু অনুমোদনবিহীন ভবনসমূহের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য রাজউককে পত্র দেয়া যেতে পারে।  

“রাজউক” তার পরিধিভূক্ত এলাকাসমূহের নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি জোরদারভাবে চালাতে সমর্থ হলে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো এবং এরূপ দূর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেতো। 

যেহেতু “রাজউক” এর বর্তমান কাঠামোর আওতায় ভবনের নকসা অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করা সম্ভব হচ্ছে না এবং নির্মাণ তদারকি প্রক্রিয়াও অত্যন্ত দূর্বল; সেহেতু নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় নতুন ভবন তৈরীর নকসা অনুমোদন ক্ষমতা  নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নিকট এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের নিকট ক্ষমতা অর্পন করা হলে এ সকল অনিয়ম অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হবে।   

পরিমর্শন প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, সিটি কর্পোরেশনের ১২ ওয়ার্ডেও খানপুর ব্রাঞ্চ রোডের ৪৪/১ নং হোল্ডিং এর মালিক মো. হারুন-অর-রশিদ ভূইয়া ও ৫২/১ নং হোল্ডিং এর মালিক কাজী মো. সিরজিুল ইসলাম এর ভবন ২টি সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে ইঞ্জিনিয়ারিং টীমের সদস্যরা ভবন ২টির দরজা বন্ধ পান। 

ভবনের বাইরের দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ৪৪/১ নং ভবনটির নকশা ২০০৭ সালে রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে (সংযুক্তি-১)। কিন্তু ভবনটি ৪ বছর পূর্ব থেকে নির্মাণ শুরু হয়ে বর্তমানে আংশিক কাজ চলমান রয়েছে। ৫২/১ নং ভবনটি ১৯৯৭ সালে নির্মণ করা হয়েছে। এ ভবনের অনুমোদিত কোন ড্রয়িং, ডিজাইন নেই। 

পর্যবেক্ষনকালে ২ টি ভবনের ৩য় তলায় কিছু অংশে স্পর্শ অবস্থায় দেখা যায়। কিন্তু ২য়, ৪র্থ ও ৫ম তলায় স্পর্শ অবস্থায় দেখা যায়নি। ৪৪/১ ভবনের ৩য় তলার দেয়ালে ১টি ফাটল দেখা যায়। কিন্তু বীমা কিংবা কলামে ফাটল পরিলক্ষিত হয়নি। 

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, রাজউক নারায়ণগঞ্জে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ। এ বিষয়টি আরো পরিস্কার হয়েছে নাসিক এর পরিদর্শন প্রতিবেদনে। কাজেই রাজউক এর উচিৎ  ওয়াসার মতো তাদের কার্যক্রম বিশেষ করে বিল্ডিং এর নকশা প্রণয়ন ও দেখভালের দায়িত্বটি নাসিক এর কাছে হস্তান্তর করা। নইলে এমন দুর্ঘটনা বন্ধ হবার নয়। 

শিল্প শহর নারায়ণগঞ্জকে এখন অট্টালিকার শহর বললে অত্যুক্তি হবেনা। কিন্তু ক’টি ভবন বিল্ডিং  কোড মেনে তৈরী ? এ প্রশ্নের উত্তর মেলানো ভার। নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত অধিদফতর, সিটি কর্পোরেশন  থেকে এ বিষয়ে তেমন কোন তথ্য মিলেনি। দু’টি সংস্থা থেকেই বলা হয়েছে রাজউক এর কথা। 

তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এর পক্ষ থেকে ১০ টি ভবনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মানেনি। ৩ নভেম্বর শহরতলীর বাবুরাইল তাঁতীপাড়া হামিদ মুন্সীর বাড়ি এলাকায় একটি চারতলা ভবন ধ্বসে পড়ে। এতেকরে ২ জন স্কুল ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। আহত হয় ৫/৭ জন। সেই ভবনটি তৈরী করা হয়েছিল  জোড়াতালি দিয়ে। খালের পাড়ে একতলার ফাউন্ডেশন দিয়ে তার উপর একেএকে চারতলা ভবন তৈরী করা হয়েছিল। 

ইট-সিমেন্টের গাঁথুনিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে রং-বেরংয়ের সুউচ্চ ভবন। নারায়ণগঞ্জ জেলায় দ্রুত বাড়ছে এ ধরনের বহুতল ভবনের সংখ্যা। গত ১০ বছরে জেলায় এমন ভবনের সংখ্যা বেড়েছে আশাতীত। শহুরে জীবনে কিছুটা সচ্ছলতার পরিচয় মিললেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আতঙ্ক ও আশঙ্কা। গড়ে ওঠা এসব ভবনের কোনটিতেই মানা হচ্ছে না বিল্ডিংকোড। বিন্দুমাত্র নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল ভবন। খাল-বিল ও ডোবা-নালা এমনকি জলাশয় ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে ভবন। 

বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি নিদের্শনাতো মানা হচ্ছেই না, এমনকি অগ্নি নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও মানছেন না প্রভাবশালী এসব ভবন মালিকেরা। আর এভাবেই প্রতিদিনই অনিরাপদ হয়ে উঠছে নগর জীবন।
 

এই বিভাগের আরো খবর