নারায়ণগঞ্জে নজরুল
প্রকাশিত: ১২ জুলাই ২০১৮
রফিউর রাব্বি : অনেক নজরুল গবেষক মনে করেন, নজরুল যতবারই পূর্ববঙ্গে এসেছেন নারায়ণগঞ্জের উপর দিয়েই গিয়েছেন। তখন নারায়ণগঞ্জ ছিল এই বঙ্গের প্রবেশ-দাঁড়। ভারত থেকে প্রধান যাত্রাপথটি ছিল কলকাতা-গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ।
নৌপথে গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ এর দূরত্ব ছিল ১০৪ মাইল। তখন ডাক যোগাযোগের জন্য প্রতিদিন নৌপথে গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ ষ্টিমার যাতায়াত করতো। ১৮৮১ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় তখন দেশের যে কোন স্থানে যাওয়ার জন্যেই নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পদার্পন করতে হতো।
সোনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯ – ১৪০৯) পারস্যের কবি হাফিজকে সোনারগাঁয়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি আসতে পারেন নি; কিন্তু তিনি তখন একটি কবিতা লিখে সুলতানকে পাঠিয়েছিলেন। হাফিজের সে কবিতাটি অনেকেই অনুবাদ করেছেন তবে নজরুলের ভাবানুবাদটিই পাঠকের কাছে সবচেয়ে সমাদৃত হয়েছেঃ
আজকে পাঠাই বাংলায় যে ইরানের এই ইক্ষু শাখা/এতেই হবে ভারতের সব তোতার চঞ্চু মিষ্টি মাখা।দেখগো আজ কল্পলোকের কাব্যদূতীর অসম সাহস/এক বছরের পথ যাবে যে একটি নিশি যাহার বয়স।
১৯১৪ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম নারায়ণগঞ্জ আসেন। বলা চলে সে বছরই নজরুলের প্রথম বাংলাদেশে আসা। তাঁর বয়স তখন পনের। সে বার মূলত তাঁর যাত্রার গন্তব্যটি ছিল ময়মনসিংহ। তিনি নারায়ণগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহ যান। নজরুল ইসলাম ১৯২৬ সালের ২ জুলাই নারায়ণগঞ্জে বসে ‘অভিযান’ কবিতাটি লিখেন।
কবিতাটি মোহাম্মদ কাসেম (১৯০৫ – ১৯৭০) সম্পাদিত ‘মাসিক অভিযান’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। মাসিক অভিযান নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হতো। এর প্রথম দু’টি সংখ্যা নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ভাদ্র ১৩৩৩ সালে। পরে কলকাতা থেকে নতুন রূপে অভিযান এর প্রকাশিত হয়। নজরুল তাঁর পান্ডুলিপিতে অভিযান কবিতার শেষে স্বাক্ষর করে লিখেছেন, নারায়ণগঞ্জ, ২-৭-২৬।
অভিযান,নতুন পথের যাত্রা পথিক/চালাও অভিযান উচ্চকন্ঠে উচ্চার আজ-“মানুষ মহীয়ান”চারিদিকে আজ ভীরুর মেলা/খেলবি কে আয় নতুন খেলা?জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা,বাইবি কে উজান?/পাতাল ফেড়ে চল্বি মাতাল/ স্বর্গে দিবি টান!!সমর-সাজের নাইরে সময়/বেরিয়ে তোরা আয়/আজ বিপদের পরশ নেব নাঙ্গা আদুল গায়। আসবে রণ-সজ্জা কবে/সেই আশায়ই রইলি সবে। রাত পোহবে প্রভাত হবে,গাইবে পাখী গান /আয় বেরিয়ে, সেই প্রভাতে ধরবি যারা তান। আঁধার ঘোরে আত্মাঘাতী/যাত্রাপথিক সব এ উহারে হানছে আঘাত করছে কলরব।অভিযানের বীরসেনাদল কুচকাওয়াজে বাজাও মাদল,গাও প্রভাতের গান। উষারদ্বারে পৌঁছে গাবি “জয়নব উত্থান।”
নারায়ণগঞ্জ,২-৭-২৬
‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’ গানটি নজরুল নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা ঘাটে বসে রচনা করেন। এ গানটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণে তিনি যে ঘটনার উলে¬খ করেছেন, গোয়ালন্দ থেকে ষ্টিমারটি এসে শীতলক্ষ্যা পৌঁছে ঘাটে না ভিরে কিছুটা দূরে থামলো। ষ্টিমার থেকে যাত্রীরা ছোট নৌকায় চড়ে ঘাটে গিয়ে নামছে। ষ্টিমার থেকে নৌকায় নামাটা ছিল ঝুকিপূর্ণ। অনেকেই ভয় পাচ্ছিলেন।
সে সময় এক নারী লাফ দিয়ে ষ্টিমার থেকে নৌকায় নামলে নজরুল অবাক হয়ে তাকে দেখছিলেন। নৌকায় নেমে নারী নজরুলের দিকে তাকান। তার নামা ও ঘুরে তাকানো নজরুলকে বিস্মিত করে। তিনি ভাবেন, পূর্বদেশের নারীদের পক্ষেই এমনি সম্ভব। সে ঘাটে তখনি তিনি এ কবিতাটি লিখেন।
১৯২৬ সালে নজরুল পূর্ববঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় আইন সভায় উচ্চ পরিষদের সদস্যপদের জন্য নির্বাচন করেছিলেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছিল ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-ময়মনসিংহ জেলা। তখন নারায়ণগঞ্জ জেলা যেহেতু বৃহত্তর এলাকা ঢাকা জেলার মহকুমা ছিল, সেহেতু নজরুলের নির্বাচনী এলাকায় নারায়ণগঞ্জেরও অন্তর্ভূক্তি ছিলো।
নজরুল নারায়ণগঞ্জের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তিনি জয়ী হতে পারেন নি, তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছিলো। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ থেকে কত ভোট পেয়েছিলেন, সে তথ্য উদ্ধার করা যায় নি। নজরুলের নির্বাচনী এলাকায় মোট ভোটারের সংখ্যা ছিলো প্রায় আঠার হাজার ।
নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ১৯২৭ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ‘খোশ আমদেদ (স্বাগতম) নামে উদ্ধোধন সঙ্গীতটি তিনি (নজরুল) রচনা করেন।’
সে সময় নারায়ণগঞ্জের অন্যতম কবি বে-নজীর আহমদ (১৯০৩-১৯৮৩) ‘নওরোজ’ পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘নওরোজ’ কবিতা উলি¬খিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল ইসলাম, বে-নজীর আহমদের প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘বন্দির বাঁশী’ (১৩৩৯) র মুখবন্ধ লিখেছিলেন।
১৯৩৩ সালে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গীত সংসদের অভ্যর্থনা সমিতির একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে আসার জন্যে কাজী নজরুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কলকাতা থেকে সঙ্গীত সংসদের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিকে নজরুল চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটি নিম্নে তুলে ধরা হলো-
৩৯, সতীনাথ রোড কলিকাতা, ২০-৮-৩৩
সবিনয় নিবেদন, শ্রীমান আজিজুল হাকিমের মারফৎ আপনাদের প্রস্তাব-মত নিম্নলিখিত শর্তে আমরা ছয়জন আর্টিষ্ট নারায়ণগঞ্জ যাইতে রাজি হইয়াছি। প্রথম শর্তঃ- আপনি আমাদিগকে ১২০০ (বার শত টাকা) দিবেন। ঐ টাকায় আমরা নারায়ণগঞ্জে আগামী ১৪ই ও ১৫ই সেপ্টেম্বর দুই রাত্রি গান করিব।
দ্বিতীয় শর্তঃ- আপনারা আগামী ১০ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্ধেক টাকা অর্থাৎ ৬০০ (ছয়শত) টাকা অগ্রিম পাঠাইয়া দিবেন এবং বাকী ৬০০(ছয়শত) টাকা প্রথম রাত্রি হইতে গান হইয়া যাওয়ার পরেই পরিশোধ করিবেন। ঐ বাকী টাকা পাইলে তবে দ্বিতীয় রাত্রি আমরা গান করিবার জন্য বাধ্য থাকিব।
তৃতীয় শর্তঃ- আপনি আমাদের যাওয়া আসা সেকেন্ড ক্লাস ভাড়া দিবেন। পথে ও নারায়ণগঞ্জে খাওয়া-দাওয়ার সমস্ত খরচ আপনাদের বহন করিতে হইবে।
৪র্থ শর্তঃ- নিম্নলিখিত ছয়জন আর্টিষ্টের মধ্যে যদি কেহ অসুস্থ হইয়া যাইতে অসমর্থ হন, আমরা তাঁহার পরিবর্তে অন্য আর্টিষ্ট লইয়া যাইব-অবশ্য আপনাদের মত লইয়া।
৫ম শর্তঃ- আপনি যদি কোন কারণে আমাদের সহিত চুক্তি করিয়া সে চুক্তি ভঙ্গ করেন, তাহা হইলে আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।
আমরা চুক্তি ভঙ্গ করিলে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকিব। ইহাই হইল মোটামুটি শর্ত। আপনার অন্য কোন কিছু জানাইবার থাকিলে পত্র দিয়া জানাইবেন।
আপনার সুবিধামত অন্য তারিখেও- অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে-আমাদের যাইতে আপত্তি নাই। আমরা নিম্নলিখিত ছয়জন আর্টিষ্ট যাইবঃ- ১। অন্ধ গায়ক শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে। ২। শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দাস। ৩। শ্রীনলিনী কান্ত সরকার। ৪। আব্বাস উদ্দিন আহমদ। ৫। শ্রীরাম বিহারী শীল (সঙ্গতিয়া)। ৬। কাজী নজরুল ইসলাম। আপনার পত্র ও সম্মতি পাইলে আপনার লিখিতমত চুক্তি-পত্র সহি করিয়া পাঠাইয়া দিব।
ইতি
বিনীত,
নজরুল ইসলাম
এ চিঠির শর্তানুযায়ী নজরুল তখন নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন কি-না, তা জানা যায় না। কোন কোন নজরুল গবেষক ১৯৩৩ সালে নজরুলের নারায়ণগঞ্জে আগমনকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু উলে¬খিত চিঠি অনুযায়ী নজরুল নারায়ণগঞ্জে আগমন বিষয়ক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। চিঠিতে উলে¬খিত আজিজুল হাকিম (১৯০৮-১৯৬২), নজরুলের অনুরোধে ১৯৩৮ সালে নার্গিস আক্তার খানম (১৩১১-১৩৯২)-কে বিয়ে করেছিলেন।
বিক্রমপুরের মেয়ে প্রতিভা বসু কবি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী। তিনি তাঁর ‘জীবনের জলছবি’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ কলকাতা থেকে ঢাকা খুব যে বেশি দূর নয়। কিন্তু যেতে হতো জলপথে। ঐ জলপথের জন্যই প্রায় দু’দিন লেগে যেতো। শিয়ালদ ষ্টেশন থেকে ট্রেন গিয়ে শেষ রাত্রে ষ্টিমারে উঠতে হতো। সেই ষ্টিমার দুপুরে পৌঁছে দিত নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আবার ট্রেনে উঠে তবে গিয়ে পৌঁছানো যেতো ঢাকার ফুলবাড়ি ষ্টেশনে।
নারায়ণগঞ্জে গিয়ে পৌঁছে ট্রেনে অবশ্য মাত্রই কয়েকটা ষ্টেশন। সেই ট্রেনের কামরায় উঠে বসবার পরেই চোখে পড়ল নজরুল ইসলাম বসে আছেন উল্টো দিকে আসনে। এই ফার্স্ট ক্লাস কামরায় আমরাই সাড়ে তিন জন যাত্রী। আমি, বুদ্ধদেব, আমাদের কন্যা মিমি এবং উল্টোদিকে নজরুল ইসলাম। কতকাল বাদে। উনি জানালা দিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন।
বুঝতে পারলাম ঢাকা রেডিও ষ্টেশন ওই গুণী ব্যক্তিটিকেও আমন্ত্রণ করে এনেছে। আমি দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আপনি!’ উনি মুখ ফেরালেন, অনেক্ষণ আমাকে দেখলেন, তারপর বললেন, ‘রানু?’ কন্ঠে কোনো আবেগ নেই, মুখে কোনো ভাব নেই, ওঁর স্বাভাবিক চরিত্রের কোনোই চিহ্ন নেই সেই অস্তিত্বে। আমি আবার খুশি ভরা গলায় বললাম, ‘কী আশ্চর্য!’ উনি একই ভঙ্গিতে মৃদু হেসে বললেন, ‘এই রকমই হয়।’
তারপর একভাবেই তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি থমকে গেলাম। বুঝতে পারলাম না আমাকে উনি ঠিক চিনতে পারছেন কিনা। ভেবেও পেলাম না এরপর ওঁকে কি বলব। উনি নিজেই বলেন, ‘জান রানু, (প্রতিভা বসুর ডাক নাম) আমি শ্রীঅরবিন্দকে দেখেছি। আমি বললাম, আপনিও কি শেষে দিলীপদার মত পান্ডিচেরি চলে গিয়েছিলেন নাকি?
উনি আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন আমি পান্ডিচেরি যাই নি। আমি তাঁকে ঘরে বসেই দেখেছি। ‘ঘরে বসে!’ আমি অবাক। উনি বললেন, ‘এরই নাম শক্তি সাধনা। সেই সাধনার জোরে আমি কালীদর্শনও করেছি। কথা বলেছি তাঁর সঙ্গে।’ আমি এর উত্তরে কী বলবো বুঝতে পারলাম না।’ এ উদ্ধৃতি থেকে এটি ঠিক স্পষ্ট হয়, নজরুল ঢাকা বেতার কেন্দ্রে প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য নারায়ণগঞ্জ ষ্টেশনে ট্রেনের কামরায় বসেছিলেন। সময়টা ১৯৪০ সালের ১৪ ডিসেম্বরের পূর্বে হবে। কারণ ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন।
১৯৭৪ সালে নজরুল শেষবারের মতো নারায়নগঞ্জ আসেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন শাপলার পক্ষ থেকে নজরুল জয়ন্তীতে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। নজরুলের সাথে তখন এসেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, উমা কাজী, খিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী ও রেণু ভৌমিক। নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সে অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। রাস্তা বন্ধ হয়েগিয়েছিল। জনগণের চাপে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের পূর্বদিকের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের আলোচনায় বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, কুমিল¬া, ঢাকা, চট্টগ্রাম এর নাম উচ্চারিত হলেও নারায়ণগঞ্জের নামটি উচ্চারিত হয় না। অথচ নারায়ণগঞ্জের সাথে বহু ঘটনায় তিনি জড়িয়ে আছেন।