শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

না’গঞ্জে রেলওয়ের ২০০ শতাংশ জমির মালিক ২২ জন

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে নারায়ণগঞ্জ শহরে রেলওয়ের অনেক জায়গা বেহাত হয়েছে। এরপাশাপাশি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রায় ২ একর (২০০ শতাংশ) জমি কিনে নিয়েছে জমির মালিক হয়েছে অন্তঃত ২২ জন। 
আর এসব জায়গা প্লট আকারে তৈরি করে বিক্রি করেছে খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বিক্রি করা এসব প্লটে এখন গড়ে উঠেছে আবাসিকভবন, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। 


অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের ২৭ অক্টোবর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৮.৭২ শতাংশের ১০৮নং প্লট ক্রয় করে ৬৪/৮ বঙ্গবন্ধু সড়কের হাজী আনছার আলীর ছেলে মতিউর রহমান। এর আগে এবং পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২.৩৩ একর অর্থাৎ ২৩৩ শতাংশ জমি ক্রয় করেছে আরো ২১ জন ব্যক্তি। 


অভিযোগ রয়েছে, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় জমি দখল হচ্ছে সরকারি এ সংস্থাটির। বিভিন্ন সময় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চললেও কয়েকদিনের মধ্যে আবারো বেদখল হয়ে যায় রেলওয়ের জায়গা।


রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ের জমির পরিমাণ এক হাজার ৭৪১ একর। সরকারি হিসাবেই এর মধ্যে ৮৯৭ একর বেদখল হয়ে গেছে। বিক্রি হয়ে গেছে দখল হয়ে গেছে খোদ স্টেশন মাস্টারের বাসভবনেরও একাংশ। 


দখল হওয়া জমিতে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ নানা অবকাঠামো। রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনার কারণে ট্রেন চলাচল বিঘিœত হলেও জমি উদ্ধারে তেমন তৎপরতা নেই রেল কর্তৃপক্ষের।


তথ্য সূত্রে জানা যায়,  এই পর্যন্ত ২.৩৩ একর অর্থাৎ ২৩৩ শতাংশ জায়গা ইতিমধ্যেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ ১৩ বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকার হাজি ইজ্জত আলীর ছেলে আব্দুল আলীকে ৩.৫০ শতাংশ জায়গা বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এখানে ৭ তলা ভবন রয়েছে। 


১৩/১ বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকার মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে আল আমিনের কাছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৩.৫০ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে। বর্তমানে এখানে ৫ তলা ভবন রয়েছে। একই এলাকার নূর হোসেন ২.২৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে যেটিতে এখন ৫ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।


এছাড়া ৬ নং বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকার হজরত আলী ব্যাপারীর ছেলে চেয়ারম্যান জাকির হোসেন রেলওয়ের ১১৬নং প্লটের ৯ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। বর্তমানে সেখানে সেমিপাকা দোকান রয়েছে। 


বঙ্গবন্ধু সড়কস্থ আব্দুল জলিলের ছেলে  আবু বকর সিদ্দিকের ক্রয় করা  ৯ শতাংশ জায়গায় সেমিপাকা দোকান রয়েছে। মৃত অনাথ বন্ধু সাহা’র ছেলে পরিতোষ কান্তি সাহার কাছে ২৬ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সেখানে সাবান ফ্যাক্টরী ও গোডাউন রয়েছে।


বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকার মো. রাশেদের ছেলে মো.মজিবুরের কাছে ৭ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখন বর্তমানে জায়গাটি খালি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকার মালেকের কাছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ১৭ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে। বর্তমানে সেখানে গোডাউন রয়েছে। একই এলাকার আছানউল্লাহ্র  কাছে ৬ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে রেল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সেখানে টিনশেড গোডাউন রয়েছে।


বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকার উরফানের ছেলে রহমত রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৭.৩৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। বর্তমানে সেখানে গোডাউন রয়েছে। ১৯৯৩ সালের ২৭অক্টোবর  ৬৪/৮ বঙ্গবন্ধু সড়কের হাজী আনছার আলীর ছেলে মতিউর রহমানের কাছে ১০৮নং প্লটের ৮.৭২ শতাংশ জায়গা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিক্রি করে করে।


একই এলাকার লতিফ মহাজন রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কেনা ৭.৩৫ শতাংশ জায়গায় বর্তমানে সেখানে ৬ তলা ভবন রয়েছে। পাইকপাড়া মৃত নিজামউদ্দীনের ছেলে জসিমউদ্দীন রেলওয়ের কাছ থেকে ১০.৬৫ জায়গা ক্রয় করেন বর্তমানে সেখানে কাঠের দোকান রয়েছে। 


নাগবাড়ি এলাকার জাকির হোসেন খোকা ৬.২৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। বর্তমানে সেখানে একটি কাঠের দোকান রয়েছে। কাশিপুর এলাকার ইকবাল হোসেন জিতু ক্রয় করে ৪.৭৫ শতাংশ জায়গা। বর্তমানে জায়গাটিতে কাঠের মিল রয়েছে।


 ২২৮/২ পশ্চিম দেওভোগ এলাকার মৃত সামছুল আলম মাষ্টারের ছেলে মো.শফি ক্রয় করে ২৫ শতাংশ জায়গা। বর্তমানে জায়গাটিতে ১০ তলা ভবন নির্মিত হয়েছে। ভবনটি শহরের হৃদম প্লাজা নামে পরিচিত।  একই এলাকার মৃত সামছুল আলম মাস্টারের আরেক ছেলে মো. শাহনেওয়াজ মিয়া ১২.৫০ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে । উত্তর কাশিপুর এলাকার মৃত মোচন খানের ছেলে হারুন অর রশীদ ৬নং প্লটের ১২.৫০ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে ।


৬৩৬/২ পশ্চিম দেওভোগ  এলাকার আহাদ আলী মুন্সীর ছেলে আখিল উদ্দীন ১৭নং প্লটের ১৪ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। ১০ নং আল্লমা ইকবাল রোড এলাকার আবু তাহেরের স্ত্রী আনিছা আক্তার বানু ৬১নং প্লটের  ১৮ শতাংশ জায়গায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্রয় করে। 


১৬৮ মোবারক শাহ সড়ক এলাকার মৃত আলহাজ্ব জলিল চৌধুরী’র ছেলে আব্দুল আউয়াল চৌধুরী ২৬নং প্লটের ১৪ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। ৪৫ এস এম মালেহ রোড এলাকার মৃত হাসান উদ্দীন মিয়ার ছেলে আলী আকবর ১৪নং প্লটের ১৪ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। বর্তমানে এ জায়গাগুলোতে সেমিপাকা ঘর রয়েছে।


স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে দিলীপ, জন সরকার, সেলিম ও রেলওয়ের কর্মচারী মনতাজি বেগমও রেলওয়ে কলোনি ভেঙে একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন। তবে এ অভিযোগের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


শহরের দুই নম্বর রেলগেট এলাকা থেকে গলাচিপা রেলগেট এলাকা রেললাইনের দুই পাশে প্রায় ৩০ বিঘা জমি ১৪ জনের নামে কৃষি জমি হিসেবে লিজ দেওয়া হয়। সেখানে বর্তমানে তিন শতাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এখানে লিজপ্রাপ্তদের মধ্যে রেলের একাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন বলেও সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।


কমলাপুরে অবস্থিত রেলওয়ের এস্টেট বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ের মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৭৪১ একর। এর মধ্যে ৮৯৭ একর জমিই এখন অবৈধ দখলদারদের কবলে। 


অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তার সহায়তায় এসব জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। বর্তমানে রেলওয়ের জমি লিজ দেওয়া বন্ধ থাকলেও দখল কমছে না। আর মাঝে মধ্যে বিভিন্ন স্থানে অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হলেও তা কাজে আসছে না। দুই বছর আগে শহরের ফলপট্টি এলাকায় তিন বিঘা জমি উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু ওই জমি আবারও বেদখল হয়ে গেছে।


রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে কমপক্ষে ২০০ ফুট জায়গা খালি থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বাজার, বস্তি ও মার্কেট। এতে স্বাভাবিক গতিতে ট্রেন চলতে পারে না, ঘটে দুর্ঘটনাও। রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, তাদের অর্ধেকের বেশি জমি এখন অবৈধ দখলে রয়েছে। এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নগরীর জিমখানায় নগরবাসীকে স্বস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে যে শেখ রাসেল পার্ক প্রকল্প গড়ে তুলছে রেলওয়ে কর্তপক্ষ সেটিতে আপত্তি জানায়। 


তাদের দাবি এটি অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। আর গত ৭ অক্টোবর ১৬ একর জমি দখল ও ৪ কোটি টাকা ক্ষতির কথা উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দুটি অভিযোগ দেন। 


তবে রেলওয়ের এই অভিযোগের বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি নগরবাসীর। তাদের মতে, যান্ত্রিক কোলাহলের নগরীতে হাঁপিয়ে উঠা মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে নারায়ণগঞ্জে একটি পার্ক বা বিনোদনের স্থান নেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারই যেন বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 


নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী নগরীতে একটি বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক প্রতিষ্ঠার। আর সে সময়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন শেখ রাসেল পার্ক নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়। আর এতে অনেকটাই স্বস্তি পাবে বলে আশান্বিত হয়  নগরবাসী। 
 

এই বিভাগের আরো খবর