বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘নসিব’ পরিবহন দখল করে ‘বন্ধু’ নামে কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ

প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

বিশেষ প্রতিনিধি (যুগের চিন্তা ২৪) : সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নুর হোসেনের তিন সহযোগি দখল করে রেখেছে নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোড রুটে চলাচলকারি নসিব পরিবহন। নসিব পরিবহনের নাম পাল্টে তারা বন্ধু পরিবহন নামে এটি পরিচালনা করছে। 


অবৈধ দখলদাররা নসিব পরিবহন থেকে প্রতি মাসে প্রায় নয় লাখ টাকা করে বছরে কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 


অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে নসিব পরিবহন উদ্ধার করে এটি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়েছে প্রকৃত মালিকরা। নসিব পরিবহন ফিরে পেলে তারা বাস ভাড়া দুইটাকা কমিয়ে দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন।  


নসিব পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ আশরাফুল আওয়াল ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আল আমিন জানান, নসিব পরিবহন একটি লিমিটেড কোম্পানী। এতে ১৭ জন মালিকের ২৪টি বাস রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল-লিংক রোড হয়ে চিটাগাং রোড রুটে আমরা নসিব পরিবহন চালু করি। 


কিন্তু ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর কিছু সন্ত্রাসী প্রথমে আমাদেরকে বের করে দিয়ে জোর করে নসিব পরিবহন দখল করে বাস সার্ভিসটি পরিচালনা করতে থাকে। তারা আমাদের আয়ের সিংহভাগ নিয়ে যেতে থাকে। ২০১৩ সালের ২৩ আগষ্ট আমরা জোর করে আমাদের কাছ থেকে এই চাঁদা আদায়ের বিষয়ে একটি প্রেস কনফারেন্স করি। 


আমাদের প্রেস কনফারেন্সের প্রেক্ষিতে র‌্যাব-১১ এর সেসময়ের সিও লেঃ কর্নেল জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে র‌্যাব সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করলে আমরা চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি পাই। 


কিন্তু প্রায় এক বছর পরে ২০১৪ এর ৫ আগষ্ট সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন ও তার সহযোগি মুরাদ হোসেন, রুবেল হোসেন, তাজুল ইসলাম অস্ত্রের জোরে নসিব পরিবহন আবারো দখল করে নেয়। এবার তারা নসিব পরিবহনের নাম পাল্টে ‘বন্ধু’ পরিবহন রাখে। 


কোনো পরিবহন রাস্তায় নামতে হলে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির (আরটিসি) অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু বন্ধু পরিবহনের আরটিসি’র কোনো অনুমোদন নেই। 


এর প্রতিবাদ করায় নসিব পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ আশরাফ আওয়াল, এমডি মোহাম্মদ আল-আমিন, পরিচালক হাজী মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন ও মোহাম্মদ আসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে হয়রানী করতে থাকে। 


মামলায় অভিযোগ করা হয় সন্ত্রাসী নূর হোসেনের কাছেই এই বাস মালিকরা এক লাখ টাকা চাঁদা দাবী করেছে। না দেয়ায় নূর হোসেনের পরিচালিত এবিএস পরিবহনের কাউন্টারের সুপার ভাইজারকে তারা চাপাটি দিয়ে আঘাত করে।

 

তখনকার প্রশাসন ছিলো নূর হোসেনের হাতের মুঠোয়। ফলে একদিকে পুলিশের হয়রানী অন্যদিকে নূর হোসেনের সহযোগিদের কাছ থেকে বাঁচতে এই বাস মালিকরা পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। 


নূর হোসেনের উল্লেখিত তিন সহযোগি ‘নসিব’ থেকে ‘বন্ধুতে’ পরিণত হওয়া এই পরিবহনের বাকি বাস মালিকদের বাসের আয় হিসেবে যা দেয় তা-ই নিয়ে বাস মালিকদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। 


প্রতিবাদ করার উপায় নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাস মালিকদের যে টাকা দেয়া হচ্ছে তার চেয়ে বেশি টাকা তাদের বাসের পেছনে খরচ করতে হচ্ছে। 


ফলে বাধ্য হয়ে ১৭ জন বাস মালিকের মধ্যে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, জয়নাল, পারভেজ, শাহীন, সবুজ, আলমগীর, দীপু হাওলাদারসহ মোট সাতজন বাস মালিক বাস বিক্রি করে চলে গেছেন। এছাড়া আরো কয়েকজন বাস মালিক এ পরিবহন ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। 


এছাড়া নসিব পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ আশরাফ আওয়াল ও এমডি মোহাম্মদ আল আমিনের বাস পরিবহন কোম্পানী থেকে অবৈধভাবে জোর করে বের করে দেয়া হয়।       


নসিব পরিবহনের পরিচালক হাজী মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন ও পরিচালক আসলাম আরো জানান, আমরা যখন নসিব পরিবহন পরিচালনা করেছি তখন প্রতিদিন একেকজন বাস মালিক সর্বনিন্ম সাড়ে তিন হাজার টাকা পেতো। 


কখনো আরো বেশি পেতো। অথচ তখন ভাড়া ছিলো ১৬ টাকা। বর্তমানে এ রুটের ভাড়া ২০ টাকা। অথচ বাস মালিকরা এখন প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১২০০ টাকা পেয়ে থাকে। 


তারা আরো জানান, নসিব পরিবহনের আরটিএ’র অনুমোদন রয়েছে। রাস্তায় চলাচলের সমস্ত ধরনের কাগজপত্র রয়েছে। অথচ এটি রাস্তায় চলতে পারছেনা। অন্যদিকে ‘বন্ধু’ পরিবহনের কোনো ধরনের অনুমোদন না থাকলেও পরিবহন গডফাদারের সহযোগিতায় এটি চলাচল করছে। 


সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে মুক্ত করে আমাদেরকে নসিব পরিবহন ফিরিয়ে দেয়া হলে আমরা বাস ভাড়াও বর্তমানের তুলনায় দুই টাকা কমিয়ে দিতে পারবো। 


নসিব পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ আশরাফ আওয়াল ও এমডি মোহাম্মদ আল আমিন জানান, কোম্পানীর পরিচালনা ফিরে পেতে আমরা পুলিশ সুপারের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছি। আমাদের আবেদনে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সুপারিশ করেছেন।


 নসিব পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ আশরাফ আওয়াল জানান, বর্তমানে বন্ধু পরিবহনের পরিচালনার মূল ভূমিকায় থাকা মুরাদ এক সময় আমার গাড়ির হেলপার ছিলো। নসিব পরিবহন দখল করার পর সে পঞ্চবটি, র‌্যালিবাগান ও বন্দরে তিনটি বাড়ি করেছে। বন্ধু পরিবহনে তিনটি ও বন্ধন পরিবহনে একটি বাস করেছে। 


বন্ধু পরিবহনের আরেক পরিচালক সাজা রুবেল ছিলো নসিব পরিবহনের সুপার ভাইজার। যার দৈনিক বেতন ছিলো একশ আশি টাকা। সে এখন বন্ধু পরিবহনে তিনটি বাসের মালিক দুইটি বাড়ির মালিক। 


সে এখন বন্ধু পরিবহনের ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে আছে। তাজুল ইসলাম ছিলো নসিব পরিবহনের একটি বাসের ড্রাইভার। সে এখন বন্ধু পরিবহনে দুইটি বাসের মালিক।    


অভিযোগের ব্যাপারে মুরাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নূর হোসেন যখন এবিএস এনেছিলো তখন নসিব পরিবহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। যখন আবার নূর হোসেন বিপদে পড়ে তখন আবার চালু হয়। 


কিন্তু বাসগুলি পুরনো হওয়ায় প্রশাসনের চাপে বাসগুলি বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়ে যায়। পরে আমরা বিভিন্ন মালিককে একত্রিত করে বন্ধু পরিবহন গড়ে তুলি। তখন নসিবেরও কোনো কোনো মলিক বন্ধুতে আসেন। 


তিনি বলেন, আরটিসি’র অনুমোদন আমাদের আছে। কাগজগুলি আমরা যোগাড় করছি। কয়েকদিনের মধ্যে আমরা আপনাকে কাগজগুলি পাঠিয়ে দেবো। আমাদের প্রতিষ্ঠানকে জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানীর অনুমোদন নেয়ারও প্রক্রিয়া চলছে। এটি সম্পন্ন হলেও কাগজপত্র আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেবো। 


বাস মালিকদের যথাযথভাবে বাসের আয় শোধ না করার অভিযোগ অস্বিকার করে তিনি বলেন, কোনো বাস মালিকের এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। সবার পাওনা যথাযথভাবে শোধ করা হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, একটি মহল আমিসহ বন্ধু পরিবহনের অন্য দুই পরিচালক রুবেল ও তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ও অপপ্রচার চালাচ্ছে।      


এ ব্যাপারে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক (ডিআই-২) সাজ্জাদ রোমন জানান, নসিব পরিবহনের অভিযোগটি আমরা পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। 
 

এই বিভাগের আরো খবর