শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানিসহ ২১ দিনে নির্যাতিত ১১ নারী-শিশু

প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি ২০২০  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : জেলায় বেড়েছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নির্যাতন। ৩ বছরের শিশু থেকে শুরু করে আশিউর্ধ্ব বৃদ্ধা, বাদ পড়ছে না কেউই। কখনও বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষন, কখনও যৌতুকের জন্য অমানসিক নির্যাতনসহ নানা লোমহর্ষক ঘটনার চিত্র উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।

 

নতুন বছরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। নতুন বছরের মাত্র ২১ দিনে শিকার হয়েছে ১১ নারী ও শিশু। এর মধ্য ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪ শিশুসহ ৫ জন, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১জন। এছাড়া যৌন হয়রানিসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫ নারী ও শিশু। এর মধ্যে মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কিশোরীকে (১৪) ধর্ষণের  মামলায় কাশীপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান শ্যামলসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। 

 

জানা যায়, অভিযুক্ত তুর্জ ভুক্তভোগী কিশোরীকে প্রায় সময়ই উত্যক্ত করতো এবং প্রেমের প্রস্তাব দিতো। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়াতে তুলে নিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিতো সে। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা আনিসুর রহমান শ্যামলের অফিসে গিয়ে বিচার দেয় ভুক্তভোগী কিশোরীর মা। কিন্তু শ্যামল বিচার না করে উল্টো বাদীকে গালিগালাজ করে। 

 

এদিকে গত ১৯ জানুয়ারি বিকেলে আরবি পড়তে যাওয়ার পথে কিশোরীকে অপহরণ করে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। দীর্ঘ সময় মেয়ে বাড়িতে না ফেরায় খুঁজতে বের হন মা। পরে তুর্জের বাড়ি থেকে মেয়েকে উদ্ধার করেন। ভুক্তভোগী কিশোরী ধর্ষণের বিষয়টি তার মাকে জানান।

 

এ সময় আনিসুর রহমান শ্যামল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিচার করা হবে বলে তার অফিসে নিয়ে যায়। পরে কোন বিচার কিংবা পুলিশে খবর না দিয়ে অভিযুক্ত তুর্জকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে শ্যামল। এমনকি এ বিষয়ে থানায় মামলা করতেও নিষেধ করে সে।

 

সোমবার (২০ জানুয়ারি) বন্দরে ষাটার্ধ্বো বৃদ্ধের বিরুদ্ধে এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীর মা বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

 

রোববার (১২ জানুয়ারি) ফতুল্লার মুসলিমনগরে লামিয়া নামের ১০ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে কালাম (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয়রা।  

 

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) রূপগঞ্জে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিককে ধর্ষণের অভিযোগে ওই কারখানার সুপারভাইজারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে বুধবার (১৫ জানুয়ারি) রাতে ভুক্তভোগী ওই নারী রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

 

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় থেকে দুই বোনকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা অভিযোগে আলমগীর হোসেন (২৫)  নামে  এক ভুয়া সেনাসদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর ছবি পোস্টের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গ্রেফতার আলমগীর  হোসেন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানাধীন কাটা কুশিয়া এলাকার এলাহি নেওয়াজ খাঁ’র ছেলে।

 

জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানায়, ২০১২ সালে  সে ঢাকা সেনানিবাসস্থ কচুেক্ষত আর্মি স্টোরে চাকুরি নেয়। সেখানে চাকুরীকালীন সময়ে সে সেনাবাহিনীর ভুয়া আইডি কার্ড ও ট্রাওজার সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে সে বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করত।

 

৯ জানুয়ারি গন্ধর্বপুর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠে। ভুক্তভোগী ছাত্রীকে ৫০০ টাকা ধার পরিশোধের কথা বলে ডেকে এনে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে দুদিন আটকে রেখে গণধর্ষণ করার পর শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের রাস্তায় ফেলে যায়। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে রূপগঞ্জ উপজেলার তারোবো পৌরসভা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবু সুফিয়ান সোহান, তৌসিফ, আফজাল, ও তানভীরসহ অজ্ঞাত ২-৩ জনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।

 

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) সোনারগাঁয়ে জামপুর ইউনিয়নের বশিরগাঁও  গ্রামে ১০ টাকার প্রলোভনে তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রীকে জঙ্গলে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। এ ঘটনার পর ওই ছাত্রীর বাবা মা গ্রাম্য শালিসকারীদের কাছে অভিযোগ দিলে থানায় মামলা করতে বাঁধা প্রদানের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। 

 

সোমবার (৬ জানুয়ারি)  মন্দিরে গিয়ে প্রেমিকাকে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের নামে চার বছর ধরে ধর্ষণ অভিযোগ উঠে সজীব আহম্মেদ (২৮) নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। গত ২ ডিসেম্বর রাতে ওই নারী বিবাহের নিবন্ধন করার কথা বললে সজীব অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে চলে যান। তখন থেকেই যোগাযোগ বন্ধ রাখে। পরে ভুক্তভোগী ওই নারী বাদী হয়ে বন্দর থানায় একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন।

 

মামলা সূত্রে জানা যায়, সজীব চার বছর আগে শহরের একটি মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে হিন্দু ধর্মমতে বিয়ে করেন মেয়েটিকে। বিবাহ নিবন্ধন ছাড়াই চার বছর শারীরিক সম্পর্ক করেন তারা। বিবাহ নিবন্ধন করতে বললেও আজ কাল বলে কালক্ষেপণ করেন সজীব। 

 

 যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন : সোমবার (১৩ জানুয়ারি) বন্দর থানার ২৩নং ওয়ার্ডস্থ একরামপুর সিটি কলোনি এলাকায় এক লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে রাখি রানী (২৪) নামে এক গৃহবধূকে মারধর করে শ^শুর বাড়ির লোকজন। পরে আহত গৃহবধূর পিতা মাসুদ লাল বাদী হয়ে ঘটনার ওই দিন বিকেলে বন্দর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে।

 

এর আগে রূপগঞ্জে যৌতুকের টাকা দিতে অস্বীকার করায় স্টিলের চামচ গরম করে গৃহবধূর দুই হাতে ছেঁকা  দেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় স্বামী নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

 

শনিবার (৪ জানুয়ারি) রাতে মুড়াপাড়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি ভাংগনিঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রোববার দুপুরে ভুক্তভোগী নারী ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে।

 

এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারায়ণগঞ্জ জেলা দেয়া (জানুয়ারি-নভেম্বর) তথ্যমতে ১১ মাসে নারায়ণগঞ্জে ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের হয়েছে ১৫১ নারী ও শিশু। এর মধ্যে ৬৯ জন  নারী ও শিশু ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের শিকারের ঘটনা উঠে এসেছে।

 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের সংরক্ষিত জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং সরাসরি অভিযোগের  ভিত্তিতে তৈরি এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চলতি বছরে নারায়ণগঞ্জে এ পর্যন্ত নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার ৪৭ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে শিশুসহ ৬ জনকে। নারী ও শিশু হত্যার ঘটনা ১৪টি, যৌতুকের জন্য স্বামী কর্তৃক হত্যার ঘটনা ৪টি, উত্যক্তকরণের শিকার ২২ জন, অপহরণের ঘটনা ৬টি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার ৪৩ জন, গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার ৪ জন। 

 

আংশঙ্কাজনকভাবে হত্যা ও ধর্ষণ ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলা  সভাপতি লক্ষ্মী চক্রবর্তী  জানান, সামাজিক অবক্ষয় ও অনাচারের কারণেই নারী ও শিশু নির্যাতন ক্রমাগত বাড়ছে। নারায়ণগঞ্জেও ব্যতিক্রম নয়। জেলা তিনটি উপজেলায় বন্দর, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারে এ ধরণের ঘটনার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আর এ অধিকাংশ ভুক্তভোগীই হচ্ছে গার্মেন্টস কর্মী, কিশোরীরা। এমনকি বাদ পড়ছেনা ৩ থেকে ৫ বছরের শিশুরাও। 

 

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে নারী ক্ষময়তায়ন বৃদ্ধি পেলেও  নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। যখনওই দেশে নারীদের অগ্রগতি কথা আসছে সাথে সাথে উঠে আসছে ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের হাজারো ঘটনা। এসকল প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যৌন নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ানোর পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার প্রতিরাধে আইনের সুষ্ঠ ব্যবহার আবশ্যক।  

এই বিভাগের আরো খবর