শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দি ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণ

ধকল কাটাতে দুর্নীতি ও দলীয়করণই বাধা!

প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০২০  

যুগের চিন্তা ডেস্ক: এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন সাময়িকী দি ডিপ্লোম্যাট ১৮ এপ্রিল শনিবার কোভিড–১৯ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কি প্রভাব ফেলবে তার একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। এটি লিখেছেন আনন্দ কুমার। তিনি দিল্লি ভিত্তিক মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড অ্যানালাইসিসের একজন অ্যাসোসিয়ট ফেলো।


ওই নিবন্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের প্রশংসা করেছে। কিন্তু তারা সতর্ক করেছে যে, এর সুফল কি হবে সেটা প্রধানত নির্ভর করছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি এবং দলীয় লোকদেরই আর্থিক সুবিধা পাওয়ার যে সংস্কৃতি এবং অতীত প্রবণতা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারার উপর।


উল্লেখ্য, ইকনোমিস্টের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টমতে আগামী বছর জিডিপি ৪ ভাগ কমবে। এডিবি বলেছে, প্রায় ৯ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। কিন্তু গার্মেন্টস খাতেই ইতিমধ্যে এর থেকে বেশি মানুষের চাকরি গেছে।


নিবন্ধটির অবিকল তরজমা নিচে তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশ বিশ্বায়নের প্রধান সুবিধাভোগী একটি দেশ । দেশটি উৎপাদনের আউটসোর্সিং থেকে উপকার পেয়েছে।


যেখানেই খরচ কম হতে পারে, সেখানেই দেশটি বাইরে উৎপাদন করিয়ে অধিকতর সুফল নিয়েছে। তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্প শ্রম নিবিড়। এবং বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে শ্রম পাওয়া যায় সস্তা দামে । শ্রমের প্রাচুর্যই বাংলাদেশকে একটি বড় শ্রম রফতানিকারক দেশ হিসেবেও তৈরি করেছে। যা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বয়ে আনছে ।


এছাড়া ওই অবস্থাটি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতিতেও সাহায্য করেছে । গত এক দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বায়নের ফল যে সব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার ফলে দেশটিতে খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে । গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি গড়ে উঠেছে । এটা এমন একটা সময় হচ্ছিল, যখন বিশ্বের বাকি অংশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছিল । তবে এই দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি এখন কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে ।


আরএমজি শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দুটি বড় অবদান রাখছে । দেশের জিডিপি ' র জন্য আরএমজি রপ্তানি এবং ম্যানুফেকচারিং খাতের অবদান ১৩ শতাংশ । এর অধীনে প্রায় চল্লিশ লাখ কর্মী কর্মরত রয়েছে । অনুমান করা হচ্ছে এর বাইরে ১০ লাখ কর্মী ইতিমধ্যে বেকার ।


আরএমজি শিল্পের জন্য, প্রধান রপ্তানি গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইতালি । তবে এসব দেশে গার্মেন্টস স্টোরগুলো এখন বন্ধ । মানুষ ইতিমধ্যে তাদের ব্যয় সীমিত করেছেন । বাংলাদেশে রপ্তানিকারকরা এখন সময়মতো তাদের পেমেন্ট পাচ্ছেন না । ক্রেতারা অর্ডার বাতিল বা পরিবর্তন করছেন । এর ফলে শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে অসুবিধায় পড়েছেন। ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে আসছেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে তা বাড়তি সমস্যা তৈরি করছে । এই শ্রমিকদের বেকারত্ব এবং শাটডাউনের জেরে খাদ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আরও সমস্যা তৈরি হবে ।


বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স । বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে রেমিট্যান্স বাবদ সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি ছিল। ২০১৭ সালে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা বাড়িতে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার পাঠান । ভারত ও পাকিস্তানের পর ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছিল রেমিট্যান্স গ্রহণকারী তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রাপক দেশ। এবং বিশ্বের মধ্যে ১১তম।


প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসে কাজ করছেন । এদের বেশিরভাগই উপসাগরীয় দেশ, পশ্চিমা দেশ, মালয়েশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে আছেন । তাদের স্বাগতিক দেশে বিঘ্ন ঘটার কারণে এই শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এখন বাড়ি ফিরছেন । অনেক স্বাগতিক দেশই এখন তাদের দেশে বিদেশীদের ভ্রমণের বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ এবং নিজেরাই অর্থনৈতিক মন্থরতার মধ্যে পড়েছেন। এই প্রত্যাগতরা সম্ভাব্য নতুন সংক্রমণের উৎস। আবার অর্থনীতির ব্যাপারেও অতিরিক্ত সমস্যা তৈরি করছে । বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তারা বিদেশে কাজের জন্য তাদের স্বাভাবিক স্থানে আর ফিরে যেতে পারবে না ।


পহেলা বৈশাখ Í বাংলাদেশের নববর্ষ Í সাধারণত এই সময়ে বাংলাদেশে ব্যবসা জমে ওঠে । এইসময়ে মানুষ প্রচুর কেনাকাটা করেন । দুর্ভাগ্যবশত, মহামারির কারণে বেশিরভাগ মানুষ তাদের কেনাকাটা বা উদযাপন করতে পারেননি। এটা বাংলাদেশের স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। যদিও কিছু ব্যবসায়ী মালিক অনলাইনে তাদের ব্যবসা শিফট করার চেষ্টা করছেন। তবে বাংলাদেশে বিশেষ করে খালি হওয়া স্থানগুলো পূরণে তা যথেষ্ট বলে গণ্য হবে না ।

মার্চ মাসের প্রথম দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অনুমান করেছে যে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় গেলে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ১.১ শতাংশ কমে যেতে পারে। আর তখন তা দেশটির তিনশ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থনীতি থেকে ৩.০২ বিলিয়ন ডলার মুছে দেবে। এডিবির আরও অনুমান, উপরন্তু ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০টি চাকরি হারিয়ে যাবে । দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে পোশাক খাতে ইতিমধ্যে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা এই সংখ্যাটিকে ছাড়িয়ে গেছে ।


চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার এবং তার শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সহ আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস । চীন এখন বাংলাদেশের জন্য রপ্তানি গন্তব্য হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছে । তাছাড়া বাংলাদেশে পর্যটক চলাচলের বড় অংশই আসে চীন থেকে । এখন চীন থেকে আমদানি করতে বাধা, কারণ চীনই করোনা ভাইরাসের মূল কেন্দ্রস্থল। তাই বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী খাতকে আঘাত করবে এবং সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হবে । এতে সার্বিক বাণিজ্যের উপরেও প্রভাব পড়বে ।বাংলাদেশের পর্যটকদের একটি বড় অংশ আসে চীন থেকে।


মহামারির প্রভাব প্রতিহত করতে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপকভিত্তিক একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে । এটা বাংাদেশী টাকায় ৭২৭ বিলিয়ন বা আটশ কোটি মার্কিন ডলার। গত ৫ এপ্রিল এটা ঘোষণা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । সরকার প্রাথমিকভাবে রপ্তানিমুখী শিল্পকে সমর্থনের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের জরুরি উৎসাহ প্যাকেজ ঘোষণা করে । ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের লক্ষ্যে পরে আরও প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় । মোট উদ্দীপক প্যাকেজের মূল্য এখন জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ ।


আরএমজি রপ্তানি এবং স্বাগতিক দেশগুলোতে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের ফিরে আসা নির্ভর করবে বিশ্বে কত দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে । এখন পর্যন্ত আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মহামারির প্রভাব পড়বে বিরাট । ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইইউ) হিসাব বলছে, আগামী বছরের জন্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৪ শতাংশ কমে যেতে পারে । বাংলাদেশ সরকার যে উদ্দীপক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা প্রশংসনীয় কিন্তু এটা দেখার বিষয় যে, অর্থ আত্মসাত এবং রাজনৈতিকভাবে যুক্ত থাকা ব্যক্তি এবং তোষামোদকারীদের ঋণগ্রহীতা হওয়ার বাংলাদেশী কালচারের মধ্যে তা কতোটা কাজে দেবে। (সূত্র: মানবজমিন)
 

এই বিভাগের আরো খবর