শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

তৃষ্ণা মিটছে দূষিত বরফ ও রাসায়নিক দ্রব্যে : বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০১৯  

নুসরাত জাহান সুপ্তি ও আশিক (যুগের চিন্তা ২৪) :  গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ। একটু স্বস্তির আশায় রাস্তার পাশের শরবত বা লাচ্ছির দোকানে হরহামেশাই ভিড় করছেন পথচারী, শারীরিক শ্রমজীবী মানুষ ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তীব্র দাবদাহে তৃষ্ণা মেটানোর আশায় কিছুটা প্রশান্তি পেতে সেখানে পান করছেন হাতে বানানো লাচ্ছি বিভিন্ন রকমের শরবত ও আখের রস। 

 

তবে তৃষ্ণা মেটানোর আশায় গ্রহণ করা এই পানীয়র সঙ্গে একই সময়ে ভোক্তাদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে নানা ধরণের দীর্ঘমেয়াদী অসুখ। অবশ্য সেটা জানার সুযোগ নেই সাধারণ মানুষদের। 

 

এই পানীয়র সঙ্গে মিশানো হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পানির বরফ ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য কেমিক্যাল। আর এসব মেশানো রঙিন পানীয় পান করে তৃষ্ণা মিটিয়ে সাময়িক প্রশান্তি পেলেও বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। 

সরেজমিনে দেখা যায়, তীব্র দাবদাহে চাষাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সামনে ও নগরের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে শরবত ও আখের রস বিক্রির ধুম পড়েছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সামনে অস্বাস্থ্যকর শরবত বিক্রি করছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।


নগরের কেন্দ্র বিন্দুস্থল হলো চাষাড়া শহীদ মিনার। এর চারপাশেই নারায়ণগঞ্জের প্রধান প্রধান স্কুল কলেজ হওয়ায় ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের সমাগম হয়। প্রচন্ড রোদের তাপে অসহ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা পান করছে এসব শরবত। এতে করে পেটের পীড়া, জ¦র-সর্দিসহ কিডনীর রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। 
চাষাড়া শহীদ মিনার ছাড়াও জিম খানা লেক, নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে শরবত ও আখের রসের বিক্রি রমরমিয়ে চলছে। চাষাড়া শহীদ মিনারের সামনে এক সিরিয়ালে ৬/৭ টি শরবতের ভ্রাম্যমান দোকান। 


লেবু, বিট লবণ, বরফ মেশানো শরবত বিক্রি হচ্ছে আর উপরে কিছু ফল ছড়িয়ে ফলের শরবতের নামে সিভিটা, সফট ড্রিংকস পাউডার মেশানো রঙিন শরবত ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


ছোট একটি বালতিতে ময়লা গ্লাস বারবার ধোয়ায় পানি নোংরা হয়ে যায়। সেই নোংরা পানিতে গ্লাস ধুয়েই শরবত দেওয়া হচ্ছে। একই ব্যবস্থায় আখের রস বিক্রি হচ্ছে। স্কুল কলেজ শেষে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা দেখা যায় এসব শরবতের দোকানে।


রাস্তার শরবত কতটা অস্বাস্থ্যকর সেটা কম বেশি জানা আছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তৃষ্ণা মেটাতে বাধ্য হয়েই এই পানি পান করছেন বলে জানান পথচারীরা। 
সকালের দিকে শহীদ মিনারের সামনে ভ্যান গাড়িতে করে বরফ বিক্রেতা বরফ কারখানা থেকে বস্তায় পেচিয়ে বরফ নিয়ে আসে। বস্তাগুলো পুরোপুরি নোংরা। বরফ এনে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে পাথরের উপর বস্তায় বরফ রাখে। জায়গা না পাওয়ায় কিছু বরফ রাখে ডাস্টবিনের উপরে।


তিনি প্রতিটি বরফের চাঁই ৮০ টাকা করে শরবত বিক্রেতার নিকট বিক্রি করেন। বরফ কোথায় থেকে আনেন প্রশ্নে বলেন, বরফ আইসক্রিম ফ্যাক্টরি থেকে আনি। ‘কোথায় কোথায় বরফ বিক্রি করেন’ এই প্রশ্নে বলেন, মাছ তাজা রাখতে মাছের বাজারে আর শরবতের দোকানে বেঁচি।


জিমখানা লেকের সামনে শরবত বিক্রেতা রাকিব মিয়া বলেন, এইটাই শরবত বিক্রির মৌসুম। কয়েকদিন ধইরা ভালো বিক্রি হইতাছে। কেউ বরফ মাছে দেওনের লিগা কিনে আমরা শরবত লিগা কিনি। বরফ পানি দিয়াই হয়। শরবত বানাইলেও সমস্যা নেই।


চাষারা খাজা মার্কেটের সামনে লেবুর শরবত বিক্রেতা মোঃ বশির জানান, লেবুর সঙ্গে পানি, চিনি, আপেল বার্লি পাউডার ড্রিঙ্ক মিশিয়ে বানানো হয় শরবত। ক্রেতা সমাগম বাড়ে, যখন পানিতে বরফের পরিমাণ থাকে বেশি। গরম হইলে কাস্টমার বেশি, গরম কম থাকলে কম।

তার বিক্রি করা পানীয়তে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু মেশানো হয় না বলে দাবি বশিরের। এলাকার একটি বরফকল থেকে ৮০ টাকা দরে বরফের চাঁই কিনে আনেন। সেই বরফ দেয়া হয় শরবতে।

 

বশির যে কারখানা থেকে বরফ কিনে আনেন, সেখানে গিয়ে জানা গেল, ৮০ টাকায় যে বরফের চাঁই বিক্রি হয় তা মূলত বানানো হয় মূলত সব ধরনের কাজের জন্য। মাছের ব্যবসায়ীরা এর বড় একটি ক্রেতা।

 

বরফকলটির মালিক শামীমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাওয়ার উপযোগী বরফ তার কারখানায় বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি হয়। এই বরফ দিয়েই মাছের সংরক্ষণ করাসহ সব ধরনের কাজ করা হয়। খাওয়ার জন্য বিশেষ করে বরফ বানানো হয়না এটাই সব কাজে ব্যবহার করা হয়। 

শামীম বলেন, আমাদের এখানে যেটার চাহিদা আছে আমরা সেটাই তৈরি করি। আমাদের এখানে আপনি যেটা বললেন ৮০ টাকা দামের বরফ। সরাসরি ডিপের পানি দিয়ে বানানো হয়। এখন এটা কে কোন কাজে লাগাই সেটা জানিনা। 

 

এক লেবুর শরবত ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, স্বাদ বাড়াতে এই লেবুর শরবতে মেশানো হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি বিটলবণ। রাস্তার ধুলাবালি তো মিশছেই। আর আছে অস্বাস্থ্যকর বরফ।

 

তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াদ বলেন, কলেজ থেকে বের হয়ে এই পর্যন্ত আসতে আসতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণা মেটাতে বাধ্য হয়ে খাচ্ছি। স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ জানি কিন্তু কিছু করার নাই।  

 

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ও ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, বর্তমান আবহাওয়ার যে অবস্থা, সকলের প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা জরুরী। তীব্র গরমের রাস্তার অস্বাস্থ্যকর পানি পান না করে ঘরের বাহিরে বের হলে সাথে করে পানি নিয়ে বের হওয়া উচিত। 


রাস্তার তৈরী এই শরবত মানব দেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এই শরবত একটানা পান করলে জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়া, টায়ফয়েড, কৃমি রোগ সহ কিডনির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শরবতের পরিবর্তে ঘন ঘন স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি ও ডাবের পানি পান করার পরামর্শ দেন তিনি।    


তিনি আরও বলেন, নগরীর পথচারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য ফুটপাতের এসব শরবতের দোকানের দিকে কড়া নজর দিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের প্রতি তাগিদ দিতে হবে।  পথচারীদের তৃষ্ণা নিবারণের কথা চিন্তা করে তিনি বলেন, ‘স্ট্রিট ফুড-এর ক্ষেত্রে লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। 

 

তাহলে বিক্রেতারা অস্বাস্থ্যকর খাদ্য কিংবা, পানীয় পরিবেশনে যেমন সতর্ক হবে, তেমনি এ ধরনের অপরাধের জন্য তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও নিশ্চিত হবে।

এই বিভাগের আরো খবর