বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ডা.আমিনুলের কুকীর্তি ‘ক্রাইম পেট্রোল’কেও হার মানালো!

প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

যুগের চিন্তা রিপোর্ট : মানবিকতা হচ্ছে ডাক্তারদের পেশাগত গুণ বা পরিচয়। ডাক্তারি পেশা একটি মানবিক পেশা। ডাক্তারি পেশা ও মানবিকতা একই সুতার দুই মাথা। ডাক্তারের কাজ অসুস্থ মানুষের প্রাণ বাঁচানো। ডাক্তারদের উপর রয়েছে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর দায়িত্ব। একজন ডাক্তারের মানুষের প্রাণ বাঁচানোর ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব সেটা সাধারণ মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ। এ জন্যই একজন ডাক্তারকে অতিমানবিক হতে হয়। কিন্তু সেই ডাক্তার যদি রোগীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ভিডিও করে পুনরায় তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করে, তাহলে সেখানে কতটা অমানুষিকতার প্রকাশ পায়?

 

এরূপ ঘটনা ভারতের ‘ক্রাইম পেট্রোল’ সিরিয়ালের ঘটনার মতো মনে হলেও এইরকম মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ উঠেছে খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের রেজিস্টার ডা.আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। যেখানে ডাক্তার মানুষের জীবন বাঁচান সেখানে তিনি রোগীদের জীবন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর করে তোলার অভিযোগ উঠেছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালেও ১৪ জুন বন্দরের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেই ঘটনা তিনি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ধর্ষিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে সকলের মুখ বন্ধ করে দেন। কিন্তু আমিনুলের যৌন লালসা দিন দিন চরম আকার ধারণ করে। ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর আবারো একজন সহযোগীকে নিয়ে হারপিক সেবন করা রোগী সহ আরো দুজন মেয়েকে তার যৌন লালসা মেটানোর জন্য এক কক্ষে নিয়ে যান। সর্বশেষ গত বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক মোহাম্মদ শাহীন উদ্দীনের আদালতে ফতুল্লার অন্তসত্ত্বা নারী বাদী হয়ে ডাক্তার আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে।

 

এই মামলা করার কারণেই ডা.আমিনুলের কুর্কীতির বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করে।  মামলার বাদী ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই তিনি থাইরোয়েড রোগের চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমিনুল ইসলামের খানপুরের নিজস্ব চেম্বার (গ্যাস্ট্রোলিভ ডায়াগোনস্টিক এন্ড কনসালস্টেশন সেন্টার) এ শরণাপন্ন হন। পরবর্তীতে ওই বছরের ২০ আগস্ট প্রাইম হাসপাতালে অপারেশন শেষে শরীর অবশ অবস্থায় আমিনুল বাদীকে ধর্ষণ করেন। সেসময়ই ধর্ষণের ভিডিও করে রাখেন। বাদী বুঝতে পারলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। ধর্ষণের ৩ ঘন্টা পর বাদী ঘুমিয়ে পড়েন এবং ঘুম থেকে জেগে চিৎকার করলে তাকে আমিনুল জানায় ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করেছে ও বাড়াবাড়ি করলে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি প্রদান করে। প্রতি সপ্তাহে আমিনুলের কাছে আসতে হবে এই ভয় দেখিয়ে তাকে চেম্বার থেকে বের করে দেয়।

 

মামলার বাদীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাদী বিবাহিত নারী এবং আত্মসম্মানের ভয়ে স্বামীর কাছে ঘটনাটি লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এই ঘটনার পর আমিনুল ইসলাম বাদীকে মোবাইল ফোনে ভয় দেখাতে থাকে। ভিডিও এর ভয় দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করে। বছরখানেক বাদে ডা. আমিনুল ইসলাম তাকে জানায় বাদীকে সে আর ডাকবে না। ভিডিও এখন আর নেই। কিন্তু যখন বাদী ৬ মাসের  অন্তঃস্বত্তা ডাক্তার তাকে হঠাৎ একদিন ফোন দিলে বাদী না চিনলে তাকে অভিযুক্ত ডাক্তার বলেন,‘ চিনো না ফেসবুকে ছেড়ে দিলে ঠিকই চিনবা।’ ভয়ে বাদী ফোন না তুললে তার বাড়ির সামনে গিয়ে ফোন দেয়। এর পরবর্তীতেও একাধিকবার তার সাথে একই ঘটনা ঘটায় ডা.আমিনুল। 

 

পরবর্তীতে আবার নারীর কাছে পিয়ন দিয়ে খবর পাঠায় রোগীকে কিছু টেস্ট করাতে হবে। ২০১৯ সালের ১৩ জুলাই বাদীর বোনকে সাথে নিয়ে ওই ডাক্তারের চেম্বারে গেলে বাদীর বোন বের করে দিয়ে চেম্বারের দরজা লাগিয়ে দেন এবং জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করেন। গর্ভবতী থাকায় সে সময় সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিলে সেখানে উপস্থিত কিছু মানুষ তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে তার বাসায় নিয়ে আসে। এদিকে বাদীর স্বামী এসকল ঘটনা সম্পর্কে জেনে বাদীকে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সন্তানসম্ভবা ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় তার মামলা করতেও বিলম্ব হয়।

 

কিন্তু বছরের পর বছর এভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চেয়ে রেহাই পেতে এবার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে মামলা করার আগে তিনি ডাক্তারের স্ত্রী শিপন (সেবিকা) সাথে দেখা করেন। প্রথমবার বিশ্বাস না করলেও পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর দেওয়া প্রমাণ দেখে তিনিও ভুক্তভোগীকে সাহায্য করবেন বলে জানান। মামলার স্বাক্ষী হন কিন্তু তিনি  এখন শিপন তার পাষণ্ড ও বর্বর স্বামী আমিনুল দ্বারা নির্যাতিত হয়ে স্বাক্ষী দিতে অসম্মতি প্রকাশ করছেন বলে জানায় বাদী।

 

মামলা করার পূর্বে অনেকের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। ৩০০ শয্যা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছেও সাহায্যের আবেদন করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দায় চাপায়, এটা তাদের হাসপাতালে হয়নি সুতরাং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। এরপরই তিনি ‘আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন নারায়ণগঞ্জের  কর্মকর্তা হাইউল ইসলাম হাবিবের কাছে সাহায্য চায় কিন্তু সেখান থেকে কয়েকদিন পর বাদীকে ও ডাক্তারকে আপোষনামায় করতে বলে এই কথা বলে যে ডাক্তার আর তাকে বিরক্ত করবে না। তিনিও তখন সেই কথায় বিশ্বাস করে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু এর কয়েকদিন পরেই আবারো তাকে ফোন করে বিরক্ত শুরু করে ডা. আমিনুল ইসলাম।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারীলোভী ডা.আমিনুল কয়েক মাস আগে আরও একজন কিশোরীকে ধর্ষণ করে পরিবারকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়েছেন। এছাড়া আরো ৫ জনের সাথে তিনি অশ্লীল আচরণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৪ জন বিবাহিত এবং ১ জন অবিবাহিত। যে দালালের মাধ্যমে ডা. আমিনুলের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন তার কাছ থেকেই তাদের সম্পর্কে জেনেছেন বলে জানায় ভুক্তভোগী বাদী।

 

বাদী আরও জানায়, বিষয়টি সাংবাদিকদের জানানোর কথা বললে ডাক্তার তাকে প্রতিত্তরে বলেন, ‘প্রতি মাসে সাংবাদিকদের ১ লাখ টাকা দেই। কে আমারে কী করব দেখুমনে। বাদীর অভিযোগ, আসকে স্বাক্ষর নেয়ার সময় স্বাক্ষী হিসেবে থাকা অনেকেই এরআগেও ডা.আমিনুলের এসব কাজ করে নিস্তার পেতে সহায়তা করেছে বলে তার ধারণা।

 

এদিক ৩০০ শয্যা হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুইজন কর্মচারী বলেন, হাসপাতালের জুনিয়ররা অনেক সময়েই ওনার (আমিনুলের) আচরণে বিব্রতবোধ করে। একবার অফিসের স্টাফ তার আত্মীয়রে ডা.আমিনুল ইসলামকেদেখাইতে যাওয়ার সময় তার আত্মীয়রে বলেন, সাবধানে যাইয়েন উনার আচরণ ভালো নাহ। 

 

ডা.আমিনুলের স্ত্রী এই হাসপাতালের নার্স। ডা. আমিনুলের ১ম স্ত্রী ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের কর্মচারী রওশনারা বেগম। প্রথম সংসারে আমিনুলের ২ টা সন্তান আছে। নতুন এই সংসারেও ১টা ছেলে আছে। ৩টা সন্তান রেখে এমন কাজ করে। তার পরিবারের সবার জন্য অনেক খারাপ লাগে। এর আগেও তার অনেক এমন কুকীর্তির কথা শুনছি বলে জানান হাসপাতালের কর্মচারীরা।

 

সূত্র জানিয়েছে, ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস ও মামলা দায়েরের পর থেকেই নানাঅজুহাতে হাসপাতালে যাওয়া থেকে বিরত থাকছে ডা.আমিনুল। উদ্দেশ্য, ঘটনা ধামাচাপা দেয়া। এদিকে তাঁর স্ত্রীও হাসপাতালে আসলেও স্বল্প সময় থাকছেন। হাসপাতালের লোকজন কানাঘুষা করছেন, স্বাক্ষী হওয়ায় আমিনুল তার স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন, এমনকি বিচ্ছেদের ভয়ও দেখাচ্ছেন। ছুটির অজুহাতে হাসপাতালের বাহিরে থাকায় এবং পিবিআইয়ের মামলা তদন্তকালীন সময়ে ডা.আমিনুল মুক্ত থাকায় ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে ধারণা হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের।

 

তারা কানাঘুষো করছেন, আমিনুলের হাত অনেক লম্বা, সবকিছু তিনি ম্যানেজ করে ফেলবেন। পত্রপত্রিকা ম্যানেজেও তিনি তার সিন্ডিকেটের লোক নামিয়েছেন, হাত খুলে টাকা খরচ করছেন। ডা.আমিনুলকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত চালালে অপরাধের প্রমাণ পেতে বেগ পেতে হবেনা। দৌঁড়ঝাপ করার সুযোগ না পেলে সত্য খুব দ্রুতই প্রকাশিত হবে। খানপুর হাসপাতালের কর্মচারীদের একটি বড় অংশ চাচ্ছে ডা.আমিনুলকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে যাতে মামলার তদন্ত করা হয়।  

 

এদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ডা. দেবাশীষ সাহা ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ডা.আমিনুলের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আমরা এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। পিবিআই এই বিষয়ে তদন্ত করছে। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি। পিবিআইয়ের তদন্তে এই বিষয় প্রমাণিত হয়ে গেলে এবং আমাদের তদন্তেও একই বিষয় উঠে আসলে বিএমএ’র পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হবে এবং সেই সাথে বিএমডিসির কাছে (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) তার চিকিৎসকের সনদ বাতিলের জন্য আবেদন করব। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রমাণিত হলে তার উপর সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।

এই বিভাগের আরো খবর