শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জিপিএ-৫ এর আসক্তি ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানবসম্পদ

প্রকাশিত: ১১ মে ২০১৯  

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয় ৬ মে, ২০১৯। এ দিন সকাল সাড়ে ১০টায় অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মিলনায়তনে শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনির হাতে ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে দেন বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ২১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৩৩ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৮৯২ জন ছাত্রী এবং ১০ লাখ ৭০ হাজার ৪৪১ জন ছাত্র।


দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গেল ২ ফেব্রয়ারি থেকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত ব্যবহারিক শেষ হয়।
এবারে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকের ও সমমানের পরীক্ষায় মেয়েদের পাশের হার বেশি। জিপিএ-৫ও বেশি পেয়েছে মেয়েরা। ফলাফলে দেখাযায় এবারের ছাত্রীদের পাসের হার ৮৩.২৮ শতাংশ। অন্যদিকে ছাত্রদের পাশের হার ৮১.১৩ শতাংশ অর্থাৎ ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের পাসের হার ২.১৫ শতাংশ বেশি।


এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৮২.২০ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫২ হাজার ১১০ জন ছাত্র । অন্যদিকে ৫৩ হাজার ৪৮৪ জান ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ বছর ঢাকা বোর্ডের পাশের হার ৭৯,৬৫ শতাংশ। মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাঁদের খাত পুনরায় মূল্যায়নের জন্য চ্যালেঞ্জ করেছে! ঢাকা বোর্ডের সূত্রে বলা হয় শিক্ষকের অবহেলা বা অমনোযোগিতার কারণ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


উল্ল্যেখ, এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার করার পর জিপিএ-৫ না পাওয়ার কয়েকটি জায়গাতে ছাত্র-ছাত্রীদের মৃত্যুর খবর জানা যায়। আত্মহত্যা করে তাঁরা তাদের প্রতিবাদ বা কষ্টের ভাষা প্রকাশ করছে।


সন্তানকে নিয়ে সব অভিবাবকেরই কিছু ভালোবাসা প্রকাশ বা উদ্বেগের কারণ থাকে, কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, কেমন রেজাল্ট করবে ? এই হলো মোটা দাগে আমাদের অভিবাবকদের অবস্থা। কিছু ব্যতিক্রমও আছে।


পড়াশুনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের এতোটাই চাপে রাখা হয় যে, মাঝে মাঝে তো আত্মহত্যায় রূপ নেয় ! ছোট থেকে যত বড় হতে থাকে তার উপর বাবা মার চাপ আত্মীয়-স্বজনদের চাপ একেবারে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যায়। চাপ এতটাই যে, যেকোন ভাবে জিপিএ-৫ পেতে হবে! শিশুদের মনে এমনভাবে গেঁথে যাচ্ছে যে, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য জিপিএ-৫। তা যে কোন মূল্যেই হোক।


শিক্ষকদের অবস্থা আরেক কাঠি সরেস, রাস্তার পাশে মোড়ে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি জিপিএর-৫ পাওয়ার গ্যারান্টি সহকারে পড়াই! কেচিংয়ে ছাত্রছাত্রী বাবা মায়ের লম্বা লাইন অমুক স্যারের কাছে পড়াতে হবে। তাহলে সন্তান ভালো রেজাল্ট করবে। ক্লাসের পড়ানো বাদ দিয়ে শিক্ষকদের মনোযোগ কোচিংয়ে, প্রাইভেট ও টিউশনিতে। গোল্লায়ে যাক ক্লাস, কোচিংটা যেন ঠিকঠাক চলে এবং দিনদিন যেন ছাত্রছাত্রী বাড়ে। যেন দোকানে কাস্টমার স্বয়ং মা লক্ষ্মী।

 


অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পড়ালেখা মানেই জিপিএ-৫। ভালো মানুষের বা ভালো ছাত্র হতে হলে জিপিএ-৫ পেতেই হবে। এরকম বহুমূল ধারণা কাজ করে। অভিভাবক, ছাত্র, শিক্ষক সবাই চিন্তা চেতনায়, ধ্যানে জ্ঞানে মননে- সর্বত্রই ওই একই চিন্তা জিপিএ-৫।

 


আমরা হাপিত্যেশ করি সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা কম বলে, কিন্তু আমরা সন্তানদের কী শিক্ষা দিচ্ছি ভালো রেজাল্টের জন্য। যেভাবেই হোক ভালো ফলাফল চাই। তবে এটা ঠিক সুশিক্ষা আর স্বশিক্ষা খুবই জরুরি।


পড়াশুনা করতে হবে নিজের জানার জন্য, সমাজকে বোঝার জন্য, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য, বিশ্বকে চেনার জন্য। নতুন কিছু শেখার জন্য এবং অর্জন করার জন্য। কারণ তা মানুষের চিন্তার প্রসার ঘটায়। কল্পনা শক্তিকে করে প্রখর। একই জিনিস অন্যদের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়, জানতে শেখায়, মানুষের বোধশক্তি বাড়ায়, মানুষের মনুষত্ববোধ তৈরী করে। যা অর্জন জীবরে সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা অবস্থার যা অনুপুস্থিতি ।


ভালো ফল মানেই ভালো ছাত্র নয়। সাজেশন, গাইড অথবা মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভর করে ভালো ফল করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে জানার পরিধি  থাকে সীমিত। আর দিনশেষে ফলাফল হয় ভায়াবহ! সফল ব্যক্তি না হতে হলে ভালো মানুষ হতে হবে। পেশাগত সাফল্য এলে যে কোন ব্যাক্তি প্রকৃত মানুষ হবেন তেমনটা মনে করার কোন কারণ নেই।


জিপিএ-৫ এর নামে ছোট ছোট শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার, শিক্ষা দেয়া হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক হবার। কী পড়েছো কিছুই বলা যাবে না। কোন কিছুই শেয়ার করা যাবেনা। জিপিএ-৫ এর নেশা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো অজানা গন্ত্যবে। অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।

 

দিনরাত ছুটছি স্কুল থেকে কোচিংয়ে। এক স্যারের কোচিং থেকে অন্য স্যারের কোচিংয়ে। ছুটছিতো ছুটছিই! শিক্ষার্থীদের শঙ্কা নিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র এর পিছনে অভিভাবকরা ছুঁটছে। সোনালী শৈশব আর দুরন্ত কৈশরের বাঁধা পড়ে আছে স্কুলে, কোচিংয়ে, স্যারের বাসায় আর বাসার পড়ায়। এ যেন এক যন্ত্র, মানুষ নয়।


জিপিএ-৫ এ আসক্ত একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। দায় শিক্ষার্থীদের নয়, রাষ্ট্রীয়শিক্ষা ব্যবস্থাপনার। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা চলে শিক্ষার্থীদের ছাড়া। নীতি একটি করা হলেও তা অনুসরণ করা হয়না। আমরা এখন সংখ্যায় বিশ্বাসী কিন্তু গুণগত মানে নয়। সংখ্যায় সাফল্য দিয়ে রাজনীতি করা যায়। গুণগত মানহীন শিক্ষা দিয়ে মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি বা রাষ্ট্র তৈরী করা যায়না।

 

লিজা কামরুন্নাহার

এই বিভাগের আরো খবর