শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘ইনডিজেনাস নলেজ’

প্রকাশিত: ১ মে ২০১৮   আপডেট: ৩ মে ২০১৮

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্রই৷ ভৌগোলিক অবস্থান ও নিত্যনতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ৷ সে কারণে আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় নিত্যসঙ্গী হচ্ছে প্রতিকূলতা৷

পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জসমূহকে মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন নয়৷ অনেক সমস্যা তারা নিজেরাই মোকাবিলা করে থাকেন, নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে৷ যাকে বলা হয়ে থাকে ‘ইনডিজেনাস নলেজ' বা ‘স্বদেশজাত জ্ঞান'৷ আর সেই জ্ঞান, সেই অভিজ্ঞতা, সেই শক্তিই আমাদের দেশের বহু সমস্যা সমাধানে হয়ে উঠতে পারে এক প্রধান হাতিয়ার৷ মন্তব্য বাংলাদেশ রিসার্চ সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ বা বারসিক-এর নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেনের৷

তাঁর কথায়, ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নত দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতাই শুধু নয়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে কাজ এবং এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ৷ আর ঠিক সেটাই করছেন তিনি গত প্রায় ১৫ বছর যাবৎ৷ সুকান্ত সেনের নিজের কথায়, ‘‘মানুষের যে সামর্থ্য আছে, যে ‘নলেজ সিস্টেম' আছে, যেটা সে যুগ যুগ ধরে চর্চা করে আসছে, পরিবার থেকে পেয়ে আসছে, তার সঙ্গে তার চারপাশের যে শক্তিগুলো রয়ে গেছে, ‘লোকাল নলেজ' রয়েছে - সেই শক্তিগুলিকে আমরা যদি কেন্দ্র হিসেবে ধরি, তখন আসলে দারিদ্রের সংজ্ঞা বদলে যায়৷ বদলে যায় অশিক্ষার সংজ্ঞাও৷'' এভাবেই ১৯৯৭ সালে নেত্রকোণার একটি গ্রাম এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরে কাজ শুরু করেন সুকান্ত ও তাঁর দল৷ বিভিন্ন ‘কমিউনিটি'-র সঙ্গে কথা বলে, তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে একত্রিত করেন তিনি৷ সুকান্তের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাতে কাজ করতে হবে একেবারে মাঠ পর্যায়ে৷ এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং এটি মোকাবিলায় সবাই উদ্বুদ্ধ হবেন৷

তাই সরকার যদি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে আসল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারে, তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বাইরে থেকে তহবিল নেয়ারও কোন প্রয়োজন হবে না৷ সুকান্ত সেন বলেন, ‘‘ডিজাস্টার প্রোজেক্ট বা জলবায়ু পরিবর্তনের নামে যেসব প্রোজেক্টগুলো উত্তরবঙ্গ বা গাইবান্ধা এলাকায় যায়, সেখানে কিন্তু মূল সমস্যা ঘর উঁচু করা না৷ কারণ, ওখানে যারা থাকেন তারা জানেন যে বর্ষার সময় ঘরগুলো উঁচু করতে হবে৷ এটা তার কাছে কোনো সমস্যা নয়৷ কিন্তু তার কাছে যে জিনিসটার সমাধান নেই, সেটা হলো, এই যে প্রতিবছর নদী ভেঙে যাচ্ছে, অর্থাৎ নদীর বাঁক পরিবর্তনের কারণে সে প্রতিবছর জমিহারা হচ্ছে - সেই সমস্যা৷ এর জন্য কিন্তু তার টাকার দরকার নেই৷ দরকার নিজের শক্তিকে বাড়ানো এবং পারস্পরিক সহযোগিতা৷ এক্ষেত্রে যদি আমরা ‘ট্রেনিং' করাতে চাই, তাহলে ‘প্যাসিভ' ভাবে ‘নলেজ ট্রান্সফরমেশন' হবে৷ হয়তো আমাদের ‘অ্যাকাডেমিক নলেজ'-ও এর মধ্যে ঢুকে যেতে পারে৷'' বলা বাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনে৷ আর বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সবচেয়ে হুমকির মধ্যে পড়বে৷

এক্ষেত্রে, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন সুকান্ত সেন৷ তিনি বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গে যেখানে অনেক বেশি খরা হয়, সেখানে হয়তো লবণ সহিষ্ণু ধান বাড়াতে হবে৷ এরকমই বাংলাদেশের প্রায় ১৮টি অঞ্চলে আমরা মানুষদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করেছিলাম, যে আসলেই তারা কী চায়? কোন সমস্যার সে মুখোমুখি হচ্ছে, তার কী ধরনের সমাধান সে চায়৷ আমাদের মূল ‘প্রসেস'-টাকে আমরা বলি ‘পিপল লেড ডেভেলাপমেন্ট অ্যাপ্রোচ' - অর্থাৎ, এখানে মানুষ যদি নিয়ন্ত্রক হয় তার উন্নয়নে, তাহলে সেই উন্নয়নটা কেমন দেখতে হবে৷ সেটা কিন্তু অনেক বেশি ‘সাস্টেনেবল'৷'' সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে শুধু খাপ খাইয়ে চললে হবে না৷ বরং যথাযথভাবে এর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদেরই৷ চিংড়ি চাষের জন্য অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কেটে ‘কালভার্ট' তৈরি করে লবণ পানির উত্তোলন বন্ধ করা, স্থানীয় জনগণের প্রস্তাব ও পরামর্শের ভিত্তিতে উপজেলা পর্যায়ে কৃষি জমি, ভূমি, মৎস্য আইন নীতিমালার সমন্বয় করে তা বাস্তবায়ন করা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ও জলাধারগুলোর ওপর সব ধরনের উন্নয়ন অবকাঠামো বাতিল করে জলপ্রবাহের প্রাকৃতিক গতিধারা নিশ্চিত করা, পরিবেশ ও ক্রমপরিবর্তনশীল জলবায়ুকে বিবেচনা করে এলাকাভিত্তিক স্থানীয় ও সহনশীল কৃষি ফসলের আবাদ বাড়ানো ইত্যাদি৷ সুকান্ত সেন জানান ‘ইনডিজেনাস নলেজ' ব্যবহার করে এ ধরনেরই বিভিন্ন পরিকল্পনা, তা সরকারের সঙ্গে ‘শেয়ার' এবং তার বাস্তবায়ন করছে ‘বারসিক'৷ এই যেমন, ‘‘শ্যামনগর মুন্সিগঞ্জের একটা এলাকা৷ সেখানে এক কিলোমিটার লম্বা একটা হ্রদের মতো আছে৷ যাতে সব সময়ই নোনা পানি থাকতো৷

এই লেক'টা লিজ দেওয়া হতো চিংড়ি চাষের জন্য৷ কিন্তু আমরা তাতে প্রায় এক লক্ষ টাকা ঢালি, সংস্কার করাই৷ কমিউনিটি এবং উপজেলা প্রশাসনও আমাদের সহায়তা করে৷ এবং গত বছর আমন চাষের সময় দেখা যায় যে, সেখানে ১১ টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদন হয়েছে৷'' জলবায়ু সংকট নিরসনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার জাতিসংঘসহ বিশ্ব ফোরামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে৷ পরিবেশগত মানবিক এ বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষার জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসাসাপেক্ষ৷ কিন্তু প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছেন না বারসিক-এর নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন৷ প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন

এই বিভাগের আরো খবর