বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

জমেনি ফতুল্লার ঈদ বাজার !

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ১৩ মে ২০২০  

পবিত্র মাহে রমজানের ১৮তম রোজা অতিবাহিত হলো। কিছুদিন পরই এ বছরের মত ইতি ঘটবে পবিত্র রমজান মাসের। করোনাভাইরাসের একরাশ আতঙ্ক নিয়েই মুসলিম বিশ^ উদযাপন করবে পবিত্র ঈদুল ফিতর।

 

ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে, এবছর ২৯ রোজা হলে ঈদ হবে আগামী ২৪ মে। আর ৩০ রোজা পূর্ন হলে ২৫ মে পালিত হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সে হিসেবে হাতে গোনা ১১ থেকে ১২ দিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর চলে আসছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মালম্বিদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবও যেন ম্লান করে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস।


পেছনের ইতিহাস বলছে, প্রতি রমজানের এই সময়ে ঈদের আমেজ ফুটে উঠে সব শ্রেনির মানুষের মাঝে। ঈদের উৎসবকে ঘিরে কত আয়োজন থাকে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীদের। পছন্দের পোশাক কিনতে বিপনী বিতানে আসা যাওয়ার ধুম পড়ে যায়।

 

প্রতিবছর নতুন নতুন কারুকার্যের পোশাকে ছেয়ে যায় মার্কেট গুলো। এসব পোশাক কেনার আনন্দে পূলকিত হয়ে উঠে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে, তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতীদের মন। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট ভিন্ন। করোনা নামক এই ছোঁয়াছে রোগের প্রভাবে সেই আবেগ-আনন্দে যেন ভাটা পড়েছে।    


দীর্ঘদিন মার্কেট বা পোশাকের দোকান বন্ধ থাকার পর ঈদকে সামনে রেখে সামাজিক দুরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১০ই মে থেকে তা চালু করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এই অনুমতির তৃতীয় দিনেও তেমন জমে উঠেনি ফতুল্লার ঈদ বাজার। ফলে বুক ভরা আসা নিয়ে পোশাক ও জুতোর দোকানীরা দোকান খুললেও সেই আসায় ফাটল দেখা দিচ্ছে শুরু থেকেই।


মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, গত ১০ মে থেকে সামাজিক দুরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রত্যয়ে সারা দেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মার্কেট বা বিপনী বিতান খোলা হয়। তিনদিন অতিবাহিত হলেও প্রত্যাশিত ক্রেতা না থাকায় হাসি নেই দোকানিদের মুখে। যেসব ক্রেতারা আসছেন, দর কষাকাষিতে তাদের সাথে বনিবনা হচ্ছে না দোকানীদের।


এমন চিত্র দেখা যায়, ফতুল্লার সমবায় মার্কেট, পাগলা সমবায় মার্কেট, শিবু মার্কেট, পঞ্চবটি গফুর মার্কেট ও আশপাশের বিভিন্ন বিপনী বিতান গুলোতে। এসব মার্কেট বা বিপনী বিতান এখনও জমে উঠেনি।


তবে, মার্কেট খুললেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা গেছে দোকানীদেরকে। জীবানুনাশক ব্যবহার ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার জন্য আলাদা স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিয়েছে মার্কেট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্রেতাদের মধ্যে একশ্রেনির মানুষ এখনও সচেতন হয়ে উঠেনি।


ফতুল্লা সমবায় মার্কেটে অবস্থিত মায়ের দোয়া বস্ত্র বিতানের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম যুগের চিন্তাকে বলেন, বেচা-কেনা ভালো না। যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আজ মঙ্গলবার, হাটের দিন। তাই অন্যান্য লোক সমাগম কিছুটা বেশি হচ্ছে বটে, কিন্তু কেনার মত কেউ দাম করছে না। লাভতো দুরের কথা, ক্রেতারা কেনা দামের ধারে কাছেও আসছে না।


তিনি বলেন, লকডাউনের আগে যেসব মালামাল কিনে মজুদ রেখেছিলাম, সেগুলো এখনও ধরা হয়নি। তাই আবার নতুন করে মালামাল আনার কোন মানেই হয় না। অনেক ক্রেতা ঈদের নতুন নতুন কালেকশন চাচ্ছেন, দিতে না পারায় ফিরে যাচ্ছে। মজুদকৃত মালামাল থাকা সত্বেও এই অবস্থায় নতুন কালেকশন আনি কি করে?


আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন- বছরের বেশির ভাগ সময় আমাদের এখানে তেমন বেচা-কেনা হয় না। ঈদ, পূজা ও বৈশাখের দিকে চেয়ে থাকি। এই সিজন গুলোতে ব্যবসা ভালো হতো। তা দিয়ে বছরের ঘাটতি পূনর করে থাকি। কিন্তু এবছর আরো বড় ঘাটতিতে পারেছি। দোকান খোলার জন্য মাত্র ১২-১৩ দিন সময় পেয়েছি।

 

এই সময়ের মধ্যে কী-ই বা হবে! আমাদের এই সমবায় মার্কেটতো উচ্চবিত্তদের জন্য নয়, এখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেনির মানুষেরই আনাগোনা থাকে। এই শ্রেণির মানুষদের জন্যই আমাদের এই মার্কেট টিকে আছে। কিন্তু করোনার কারণে নিম্ন বা মধ্যবিত্তরা কর্মহীন থাকায় তাদের হাতে টাকা-পয়সা নেই। তাই নিম্ন বা মধ্যবিত্ত শ্রেনির লোকেদের ঈদ নিয়ে তেমন আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না।

 

অনেকই হয়তো মার্কেটে আসবে না। তাই বেচা-কেনা তেমন বাড়ার সম্ভাবনাও নেই। গত ঈদের তুলনায় এবার অন্তত ৮০ শতাংশ বিক্রি কম হবে। দোকানে ৩জন কর্মচারী আছে, তাদের বেতন বোনাস দিতে হবে। দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, আবার পার্টির বকেয়া বিলও পরিশোধ করতে হবে। এসব চিন্তা মাথায় এলে রাতে ঘুমাতেও পারিনা।’


পাগলা সমবায় মার্কেটে অবস্থিত স্টাইল পয়েন্টের ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা বলেন- ব্যবসা নেই। তবুও ক্ষুধার তাড়ানায় দোকান খুলেছি। এবার কোন প্রত্যাশাই করছি না। কোন মত খেয়ে বেঁচে থাকলেই হবে। তবে, অনেক টাকা লোকশানের মধ্যে পড়েছি। সামনে আরো লোকসানের মধ্যে পড়তে হবে। পার্টির বিল, দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, সব বকেয়া রয়ে গেছে।   


সমবায় মার্কেট কমিটির সভাপতি মোঃ জাকির হোসেন যুগের চিন্তাকে বলেন- ক্রেতাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য আমরা সব রকম ব্যবস্থা করেছি। ১০জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিয়েছি। তারা হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। মার্কেটে আসা লোকদেরকে জীবানুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। কোথাও জটলা বাঁধলে তাদের সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার জন্য বলা হচ্ছে। হ্যান্ড মাইকও ব্যবহার করা হবে।


তিনি বলেন- মানুষ সচেতন নয়। বিশেষ করে নারীরা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়েও মার্কেটে প্রবেশ করছে। শেষের দিকে এসে ক্রেতাদের কন্ট্রোল করা হয়তো সম্ভব হয়ে উঠবে না। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ফতুল্লা সমবায় মার্কেটের অধিনে ৪৭টি দোকান আছে। প্রায় ৯০ শতাংশ দোকান খুলেছে। বাকি ১০ শতাংশ দোকান খোলা হয়নি। তারা লকডাউনে গ্রামের বাড়ি যাওয়ায় এখন যানবাহনের কারণে আসতে পারছে না।

 

আর যারা বুক ভরা আশা নিয়ে দোকান খুলেছিলো, তারা এখনই হতাশায় ভুগছে। আগের স্টক দেয়া মাল এখনও ধরাই হয়নি। আজ মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাটের দিন হওয়ায় কিছু ক্রেতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দোকানীদের সাথে দর-দামে মিলছে না। আবার অনেক ক্রেতারা ঈদের নতুন কালেকশন চাচ্ছে।


তিনি বলেন- সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখার নির্দেশনা থাকলেও পর্যাপ্ত ক্রেতা না থাকায় দুপুর ১টার মধ্যেই মার্কেট বন্ধ রাখার জন্য মৌখিক ভাবেও বলছেন কেউ কেউ।


পাগলা বাজার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ মাহবুবুর রহমান বাচ্চু যুগের চিন্তাকে বলেন, পাগলা বাজার সমবায় সমিতির অধিনে ৫টি পোশাকের মার্কেট রয়েছে। প্রতিটি মার্কেটেই সাব কমিটি আছে।

 

আমরা সব কমিটির নেতৃবৃন্দদেরকে ডেকে বলেছি যে, মার্কেটে যেন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করা হয়। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যবিধির তালিকা তৈরী করে মার্কেটে লাগানো হয়েছে। জীবানুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এরজন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।


তিনি বলেন- দোকানীদের অবস্থা ভালো নয়। এখানে যারা ব্যবসা করেন, তারা মধ্যবিত্ত পরিবারের। কোথাও হাত পাততে পারে না। তাই ক্ষুধার জ¦ালা মেটাতেই হয়তো দোকান খুলেছে। এই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে বেশি কিছু আসা করাটাও বোকামি।

 

আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে মার্কেটের অন্তত ৩০০ কর্মচারীকে খাদ্য সামগ্রী দিয়েছি। সমিতির ফান্ড থেকে কিছু দেয়া হয়নি। কারণ দোকানতো সব খুলে ফেলেছে। যদি বন্ধ থাকতো তাহলে দোকানীদেরকে ফান্ড থেকে সহায়তা করতাম।  


এদিকে মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাটের দিন হওয়ায় ফতুল্লা ডিআইটি মাঠে পোশাকের পশরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। একই সাথে মার্কেটের কিছু দোকানীরাও হাট উপলক্ষ্যে মাঠে বসেছেন। সব মিলিয়ে অন্তত ৩শত দোকান বসেছে ডিআইটি মাঠে। এসব দোকানে শিশু-কিশোরদের পোশাক চোখে পড়েছে বেশি। এখানেও ক্রেতাদের সমাগত দেখা গেলেও তেমন বিক্রি নেই।


 
একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিআইটি মাঠে বসা দোকান প্রতি ১৫০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। তাহলে ৩০০ দোকান থেকে একদিনেই চাঁদা উত্তোলণ করা হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকা। আজ থেকে নিয়ে ঈদ পর্যন্ত এভাবে মাঠে হাকারদের দোকান বসানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

 

সে হিসেবে ঈদের বাকি ১২ দিনে এই চাঁদার অংক দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। এই টাকার সামান্য কিছু হাটের প্রকৃত ইজারাদারগণ পেলেও মোটা অংকের টাকা ঢুকবে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার পকেটে। প্রতিবছর এমনটাই হয়ে আসছে বলে জানা গেছে।  
 

এই বিভাগের আরো খবর