শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ছিঁচকে চোরের ছেলে থেকে হাশিমের জঙ্গি হয়ে ওটা

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০১৯  

ডেস্ক রিপোর্ট (যুগের চিন্তা ২৪) : কয়েক বছর আগে এক দশকের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর গত সপ্তাহে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। এই হামলার ভয়াবহতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। ইস্টার সানডের সকালে হামলার মূল হোতা হিসেবে ইতোমধ্যে মোহাম্মদ হাশিম জাহরানের নাম উঠে এসেছে। আত্মঘাতী হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

 

তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে জিহাদি কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন হাশিম। সোশ্যাল মিডিয়ায় নাশকতার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। এমনকি স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যেও তাকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে আগে ভাগে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।


শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, দেশের পূর্ব-উপকূলবর্তী শহর কট্টানকুড়িতে দুই কামরার বাড়িতে মা-বাবা ও চার ভাই বোনের সঙ্গে থাকতেন হাশিম। তারা বাবা ছিলেন পেশায় ফেরিওয়ালা। আবার ছিঁচকে চোর হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। সেই অবস্থাতেই বেড়ে ওঠা হাশিমের। তবে ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী  এবং স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। মাত্র ১২ বছর বয়সে জামিয়াতুল ফালাহ আরবি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অল্পদিনের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নজরে পড়েন।


কিন্তু বুদ্ধিমত্তার জন্য যেমন সকলের নজর কেড়েছিলেন হাশিম, তেমনই একগুঁয়ে গোঁড়া স্বভাব কারো নজর এড়ায়নি। মাত্র তিন বছরের মধ্যে কোরআন মুখস্ত করে ফেলেছিলেন। তার পর নখদর্পণে এনে ফেলেছিলেন ইসলামি আইনও। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ততই অবাধ্য হয়ে উঠছিলেন।


এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেও মতবিরোধ দেখা দেয় তার। উদারপন্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তার কলেজের প্রাক্তন সহকারী অধ্যক্ষ এসএম আলিয়ার জানান, আমাদের পড়ানোর আদব কায়দা একেবারেই পছন্দ ছিল না হাশিমের। আমরা যেভাবে কোরআন ব্যাখ্যা করতাম, তার ঘোরবিরোধী ছিল হাশিম। ওর বিশ্বাস ছিল কট্টর ইসলামে।


আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৫ সালে কলেজ থেকে হাশিমকে বহিষ্কার করা হয়। এসএম আলিয়ার বলেন, ‘শেষবার বাবার সঙ্গে স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন তাকে। তার প্রায় ১৪ বছর পর, সংবাদমাধ্যমে আত্মঘাতী জঙ্গি হাশিমকে দেখতে পেলেন।’


কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ২০০৬ সালে দারুল আথার নামে একটি মসজিদে যোগ দেন হাশিম। সেখানের ম্যানেজমেন্ট কমিটিতেও জায়গা পেয়ে যান। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেননি। অন্য সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তিন বছরের মধ্যেই মসজিদের চাকরি খোয়াতে হয় তাকে।

 

দারুল আথারের ইমাম এমটিএম ফাওয়াজ জানান, কারো মতামত নেয়ার প্রয়োজন বোধ করতেন না হাশিম। নিজেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন। এমনকি ধর্মীয় গোঁড়ামি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মহিলাদের চুরি ও কানের দুল পরা নিয়েও আপত্তি ছিল তার।


স্কুলে পড়ার সময় হাশিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মোহাম্মদ ইউসুফ তৌফিকের। পরে হাশিমের অনুচরেও পরিণত হন তিনি। তিনি জানান, নিজের পছন্দ মতো কোরআনের উল্লেখিত নির্দেশের ভুল অর্থ উদ্ধৃত করা বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল হাশিমের। তার জেরেই তিনমাসের জন্য ধর্মোপদেশ দেয়া থেকে তাকে নিষিদ্ধ করে মসজিদ কমিটি।


তারপরই রাগে সেখান থেকে চলে যান হাশিম। নিজের অনুগামীদের নিয়ে দল তৈরি করেন। তাদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ধর্মীয় বক্তৃতা করতেন তিনি। নিজের মতো করে কোরআন ব্যাখ্যা করে শোনাতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের। ২৩ বছর বয়সে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে হাশিম বিয়ে করেন।


উদারপন্থী সুফি সাধকদের বিরুদ্ধেও একসময় হাশিম উঠে পড়ে লাগেন বলে জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার সুফি মসজিদ দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংগঠনের সচিব সাহলান খলিল রহমান। তিনি জানান, ২০০৪ সালে কট্টানকুড়ির একটি সুফি মসজিদে গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৬ সালে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বেশ কিছু বাড়িতে। এমনকি তাদের এক নেতাকে খুনের হুমকিও দেয়া হয় প্রকাশ্যে।


সুফি সাধকদের ধর্মান্তকরণের উদ্দেশ্যে মৌলবাদীরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছিল বলে দাবি তার। আর সেই সুযোগেই সুফি সাধকদের হেনস্থা করতে নেমে পড়েন হাশিম। সুফিদের প্রার্থনার সময় হলে সময় মাইক বাজিয়ে তাদের উদ্দেশে কটুক্তি করতে শুরু করেন তিনি। এমনকি ২০১২ সালে নিজের আলাদা মসজিদও শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানো হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।


সোশ্যাল মিডিয়ারও অপব্যবহার করতে শুরু করেন হাশিম। মুসলিম ছেলেমেয়েদের মগজধোলাই করতে অনলাইনে নানারকম ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করেন। জিহাদের ডাক দেন। হুমকি দেন নাশকতারও। একটি ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘এমন ঘটনা ঘটাব যে দেহাংশ খুঁজে বের করার সময়ও মিলবে না। আল্লাহকে যারা অপমান করে তাদের নরকে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে ছাড়ব।’


গত ২১ এপ্রিল, ইস্টারের সকালে শ্রীলঙ্কায় তার নেতৃত্বে আটটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এতে নারী, পুরুষ এবং শিশু মিলিয়ে ২৫০ জনের প্রাণহানি ঘটে। হামলাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশে ফেরত, উচ্চ শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের সন্তান বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম তাদের নেতৃত্বে থাকা হাশিম জাহরান। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একগুঁয়ে কিশোর থেকে তার মধ্য তিরিশের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার যাত্রা কিন্তু দেশের মধ্যেই, প্রশাসনের নাকের ডগায়। 

এই বিভাগের আরো খবর