বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

চেতনার উম্মেশ না হলে জাতীয় দাসত্ব ঘুচবে না

প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০১৮  

এ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার

বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম। দেশ, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র, যুদ্ধ, বিগ্রহ, ধর্ম, পারিবারিক বন্ধন সব কিছু মানুষকে নিয়েই। দেহতত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারাই মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে। চিকিৎসাবিদদের মতে ২০৬টি অস্থি নিয়ে মানুষের দেহ গঠিত। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন উপাদান। তবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মন ও বিবেক। 

 

অন্যদিকে মানুষ জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে দুই বিষয় যথা মানসিকতা ও বিবেক দ্বারাই তার অবস্থানের বহি:প্রকাশ ঘটায়। এছাড়াও পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই দাসত্ব ও স্বাধীনতা পারস্পারিক বিরোধীর বিষয়টিকে প্রধান্য দিয়ে পরিবার, গোষ্টি, গোত্র, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক বন্ধন ও বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছে। দাসত্ব প্রথা শুরু ও শেষ হওয়ার কথা এক দীর্ঘ ইতিহাস। দাসত্ব শুরু হয় “শক্তির” নিকট মাথা নতের মাধ্যমে। দাসত্ব দু প্রকার, শারীরিক ও মানসিক। একজন মানুষ শারীরিক ভাবে দাসত্ব মেনে নিলেও মানসিক ভাবে তা মানতে নাও পারে। এটা নির্ভর করবে শুধু মন মানসিকতার উপর। যখন তার স্বাধীন চেতনার উপর আঘাত আসে তখনই দাসত্বের সাথে অর্ন্তদন্দ শুরু হয় এবং এ অর্šÍদন্দ থেকে দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের চিন্তা চেতনার উম্মেশ ঘটনার চেষ্ঠায় লিপ্ত হয়, যদি চেতনার উম্মেশ না ঘটে তবে দাসত্ব দাসত্বই থেকে যায়। 

 

পৃথিবীর ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কোথাও মাসের পর মাস, কোথাও বৎসরের পর বৎসর আবার কোথাও যুগের পর যুগ যুদ্ধ বা আন্দোলন করে একটি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে সৃষ্টি করেছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্্র। স্বাধীন ও ঔপনেবিশিক বা পরাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে মৌলিক তারতম্য রয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রয়েছে যা পরাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের নাই। স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় সংবিধান দ্বারা যদিও সব রাষ্ট্রের লিখিত সংবিধান নাই। সংবিধান যখন কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয় তখনই সৃষ্টি হয় স্বৈরাচারের। তখন স্বাধীনতা বনে যায় কাজীর গরুর গোয়ালের মত, বাস্তবতার সাথে যার কোন মিল থাকে না। 

 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা, অনেক সেমিনার, সিম্পেজিয়াম, অনেক যুগান্তকারী রায় ও কথােকথন চলেছে, কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জনগণের মনে নিশ্চিত হয়েছে কি? সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৪(৪) এ উল্লেখ রয়েছে যে, “এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচার কার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন” অধিকন্তু সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।” স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১৮(৪) এ বলা হয়েছে যে, “নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।” দূনীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, “এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হইবে।” এ রূপভাবে প্রত্যেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব পালনে স্বাধীনতার রক্ষা কবচ দেয়া সত্বেও জনগণের নিকট কতটুকু বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করেছে? 

 

“পরাধীন সূখের জীবনের চেয়ে কষ্ঠের স্বাধীনজীবন অনেক মধুর” এ কথাটি “বাবুই পাখী” কবিতার মর্মার্থ থেকে পাওয়া যায়। অন্যদিকে আইন করে কি প্রকৃত স্বাধীন হওয়া যায়? আইনের প্রতিফলন কি সাধারণ জনগণ ভোগ করতে পারছে? বাংলাদেশে অনেক স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা আইনগতভাবে কাগজে কলমে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। রাষ্ট্র একটি সরকার দ্বারা পরিচালিত হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিকে সাংবিধানিক ভাবে কেন স্বাধীনতা দেয়া হলো? এর মূল কারণ সরকার তথা রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের নিপীড়িত নির্যাতন থেকে জনগণকে রক্ষা করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার “রক্ষা কবজ” হিসাবে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিকে সাংবিধানিক ভাবে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে “ন্যায়পাল” নামে একটি সাংবিধানিক পদ সৃষ্টির সূযোগ থাকা স্বত্বেও সরকার “পদ”টি সৃষ্টি না করে স্বেচ্ছাচারিতার বিপরিতে জবাবদিহিতার মুখ বন্ধ রাখার জন্য একটি অসাংবিধানিক পন্থা গ্রহণ করে “ন্যায়পাল” পদে কাউকে নিয়োগ দেয় নাই। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “(১) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন, (২) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের যে কোন কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন এবং (৩) ন্যায়পাল তাঁহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।”. যদি “ন্যায়পাল” পদে সরকার কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতো তবে নিয়োগ প্রাপ্ত ব্যক্তিটি কি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে জাতিকে সেবা দিতে পারতো? নাকি অন্যান্য কথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মতই সেবা দানের দৃষ্টান্ত স্থাপন হতো?

 

অন্যায় ও মিথ্যার মূখোমুখি দাড়ানো একটি অন্যতম যোগ্যতা। দেশ প্রেম একটি ভিন্ন বিষয়। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, সাধারণ সৈন্যদের বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য কোন যুদ্ধে পরাজয় হয় নাই, বরং সেনাপ্রধানের বিশ্বাস ঘাতকতাই ছিল মূখ্য। আলেয়া একজন নর্তকী, তার যে দেশপ্রেম ছিল, কিন্তু সেনাপতি মীরজাফর আলী খাঁ’র তা ছিল না, ফলে ৬৫ হাজার সৈন্য নিয়ে ক্লাইভের ৩,৫০০ সৈন্যের নিকট বাংলার স্বাধীনতা বৃটিশের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট বিকিয়ে দিতে হয়েছিল। মীরজাফর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সেনা প্রধান হওয়া স্বত্বেও মানসিক দাসত্বের কারণে তার বিবেক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে নাই। যদি তার বিবেক স্বাধীনভাবে কর্মক্ষম থাকতো তবে শত লোভ লালসা, অর্থ, প্রাচুর্য বা ক্ষমতার লোভে মীরজাফর দাসত্বের পথ বেছে নিতো না।

 

২০০৭ ইং সনে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় ভিন্নপথে ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি ত্বরান্বিত ও অতিসহজে সম্ভব হয়ে ছিল তৎকালিন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিনের কারণে, দাস্বত্ব বোধ থেকে ইয়াজ উদ্দিন নিজ ক্ষমতাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য মাথা নত করেছিলেন। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবিধানিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের ব্যক্তিত্ব ও মেরুদন্ড সোজা রাখার বিষয়ে জনগণের আস্থা কেন অর্জন করতে পারছে না? ১৬/৭/২০১৮ ইং তারিখে নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার আহুত বরিশাল সিটি কর্পোরেশন মেয়র কাউন্সিলরদের মত বিনিময় সভায় প্রার্থীগণ (সরকার দলীয় প্রাথী ব্যতীত) বলেন “নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্সে সিলমারা ভোট ঢোকানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ভোট বাক্স পাঠানোর অনুরোধ করেন” (সূত্র: জাতীয় পত্রিকা ১৭/৭/২০১৮ ইং)। সম্প্রতি কয়েক বৎসর যাবৎ ঘটে যাওয়া নির্বাচনে মিডিয়ার বদৌলতে ভোট হরিলুটের সচিত্র প্রতিবেদন জনগণ দেখেছে, অথচ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের অনড়গল মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যাচ্ছে যে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে। যদি নিজেদের মধ্যে মানসিক দাসত্ব না থাকতো তবে শপথ গ্রহণ প্রাপ্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নি:লজ্জ মিথ্যা কথা বলতে পারতো না।

 

কবি হোমার বলেছেন যে, “একটি মানুষের ভুলের যোগ ফলের নাম জীবন”। সে “জীবন” নিয়ে যখন কথা হয় তখন চর্তুরমূখী আলোচনা চলে আসে। ভুল, তঞ্চকতা, প্রবঞ্চনা ও দাসত্ব এক কথা নহে। ভুলের মাশুল অনুশোচনা হতে পারে, কিন্তু দাসত্বের কোন পরিমার্যনা হতে পারে না এ কারণে যে, মানুষ লোভ ও স্বার্থের বশবর্তী হয়ে দাসত্ব করে। মুক্ত মানুষ, কাগজে কলমে স্বাধীন হয়েও দাসত্ব করে শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে, যার মাশুল জাতিকে দিতে হয় এবং জাতি বঞ্চিত হয় তার ন্যায্য অধিকার থেকে।

 

ইরাকের বাগদাদিয়া টেলিভিশনের সাংবাদিক মুনতাজের আল জাইদি ২০০৮ ইং সনে জিসেম্বর মাসে আমেরিকার তৎসময়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবলিও বুশকে প্রকাশ্যে জুতা মেরে বিচারিক আদালতে ৩ (তিন) বৎসরের জন্য দন্ডিত হয়ে ছিলেন। সাংবাদিক জাইদির মস্তিস্ক বিকৃত ছিল না, তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, অশিক্ষিত ব্যক্তি নহে। জেনে শুনে কেন এই জাইদি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তি বুশকে কেন জুতা নিক্ষেপ করলো? কোন চেতনা থেকে সে উৎবুদ্ধ হলো সেটাও গভীরভাবে চিন্তার দাবী রাখে। কারো বিবেকের যদি স্বাধীনতা থাকে বা স্বাধীন ভাবে নিজ বিবেককে খাটাতে/প্রয়োগ করতে পারে তখন নিজ জীবনের মায়ার চেয়ে বিবেকটিই মূখ্য হয়ে দাড়ায়। বিবেকের তাড়নাই ১৯৭১ ইং সনে অস্ত্রহীন বাঙ্গালীরা সামরিক সুসজ্জিত পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে ছিল। অনুরূপ দেশাত্ববোধ ও নিজ বিবেককে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারার কারণেই একজন সাংবাদিক আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে জুতা মারতে সক্ষম হয়েছিল। বিবেক অনেক শক্তিশালী বিষয় যা মানুষের মেরুদন্ডকে সোজা রাখে, সত্য কথা বলতে, ন্যায় বিচার করতে তাড়না দেয়।  

 

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই স্বাধীন, তার চিন্তা চেতনার দিক থেকে। কিন্তু পরাধীন হয়ে যায় দূর্বল মানসিকতার কারণে এবং সে দূর্বলতা সৃষ্টি হয় লোভ ও স্বার্থপরতা থেকে। কোন ব্যক্তি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি নিজেকে নিজে স্বাধীন মনে না করে তবে আইন করে দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা দেয়া একটি বাতুলতা মাত্র। তাই দেখতে হবে, দায়িত্ব প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/বিচারক/ব্যক্তি নিজেকে নিজে দায়িত্ব পালনে স্বাধীন মনে করেন কি?      

এই বিভাগের আরো খবর