শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চিকিৎসা করাতে এসেও দালালদের খপ্পরে বন্দরের নির্যাতিতা ফাতেমা

প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪): বন্দরের দক্ষিণ কলাবাগ এলাকায় ইফসুফ মেম্বারের নেতৃত্বে যৌনকর্মী আখ্যা দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতিত তিন নারীর একজন ফাতেমা  বেগম। মুখমন্ডল, হাত-পা পুরো শরীর এখনো বীভৎসভাবে ফুলে আছে। দেহের বিভিন্ন জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এখনো অন্যের সহযোগিতায় চলাফেরা করছে। নির্যাতনের পরে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ডাক্তারের কাছে রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করতে এসে পড়েছেন দালালের খপ্পরে।  

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাকে ৩০০ শয্যা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। তাকে সেই সময় জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত ডাক্তার ঔষধ সহ কিছু রোগনির্ণয় পরীক্ষা দেয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ফাতেমা বেগম ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করান। ২৫ ফেব্রুয়ারি ফাতেমা বেগমকে তার মেয়ে জামাই হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ডাক্তারের কাছে পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে নিয়ে আসেন। এসে পড়েন হাসপাতালের দালাল চক্রের খপ্পরে। 
হাসপাতালের দালাল আসলাম তাদের ফাতেমা বেগমের পুরো শরীরের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে রোগীর টিকেটে জরুরী বিভাগের ডাক্তার মো. শাহাদাত এর স্বাক্ষর করে নিজেই পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেন।

সোমবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) হাসপাতালে জরুরী বিভাগে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়োজিত কর্মচারীরা হৈচৈ করছে জরুরী বিভাগে। জরুরী বিভাগের ডাক্তার কক্ষের বাহিরে দাড়িয়ে আছেন ফাতেমা বেগমের মেয়ে জামাই। তার সাথে হাসপাতালের কর্মীদের কথা চলছে। হাসপাতালের ডাক্তার দেখানো টিকেট ও রিপোর্ট হাসপাতাল থেকে রেখে দিয়েছে।   

ফাতেমা বেগমের মেয়ে জামাই বলেন, হাসপাতালে এক্সরে করাইসি। রিপোর্ট দেখানোর পরে একজন আইসা বলে রোগীর অবস্থা ভাল না। আমি বল্লাম পরীক্ষা কি আরো করাইলে ভালো হইব? ওনি (আসলাম) বলল পুরো শরীরের পরীক্ষা করেন। আমার ভাবলাম হাসপাতালের মানুষ, তারাই ভাল বুঝবে। আমি ওনারে বলছি, যেটা করলে ভাল হয় করেন। ওনি বললেন আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগব না। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে পরীক্ষা লেখায় আসতাছি।

আজকে আমার থেকে ১০০ টাকা নিছে। আগামীকাল সব পরীক্ষা করানোর পরে চা-পানির টাকা দিতে বলল। আমি ভাবছি আমি বুঝি না, হাসপাতালের মানুষ আমারে হেল্প করতাছে। আমার সাথে পুরা দুই নম্বরি কাজ করছে। ডাক্তাররে রিপোর্ট দেখাইতে আসছি। ডাক্তার বলতাছে, এই পরীক্ষা কে লিখছে? গুলোতো আমি লিখি নাই। পরে সেই লোকরে হাসপাতালের মানুষ ধইরা আনছে। সে (আসলাম) স্বীকার করে বলল, সে নিজেই সকল পরীক্ষার নাম লিখে ডাক্তারের স্বাক্ষর করে আনছে।    

হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী বলেন, এটা পুলিশ কেইস। সেটারে নিয়া এমন কাজটা করছে। পরীক্ষার নাম নিজে লিখছে। ডাক্তারের ভুয়া স্বাক্ষর করছে। তাদের হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ সত্ত্বেও হাসপাতালে আসে কিভাবে? হাসপাতালের কিছু মানুষের সহযোগিতা পাইয়াই দালালরা ভিতরে আসে।

অসুস্থ ফাতেমা বেগম জরুরী বিভাগের বিছানায় শুয়ে আছে। তিনি বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ সব রাইখা দিছে। আবার কি হয় কিছু বুঝতাছি না। শরীরের ব্যাথায় উঠতে পারতাছি না। হাসপাতালে আসছি ডাক্তার দেখাইতে। কে যেন কি লিখা দিছে, সেই পরীক্ষা করাইছি। এখন আমার সব কাগজ রাইখা দিছে। আমি যে মামলা করছি, এই কাগজ গুলো সব লাগব। আমারে এত মারছে, আমি অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম। আমি কি বিচার আমার পামু?

প্রসঙ্গত, বন্দরের দক্ষিণ কলাবাগান এলাকায় দুই মানসিক  প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন খালপারের মৃত মফিজ উদ্দিনের মেয়ে ফাতেমা বেগম ওরফে ফতেহ (৫০)। এক মেয়ে রোকসানাকে বিয়ে দিয়েছেন পাশের গ্রামেই। ফাতেমার কাছ থেকে প্রতিবেশি উম্মেহানীর স্বামী বিদেশ পাঠানোর কথা বলে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা ধার নেন। এই ধারের টাকাই উদ্ধার করতে গিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্যাতনের শিকার হন ফাতেমা এবং তাঁর দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন আসমা বেগম (৩৫) এবং বুরুন্দী এলাকার বকুল মিয়ার স্ত্রী বানু বেগমকে (৩০) চেনেননা ফাতেমা বেগম।

স্থানীয় ইউসুফ মেম্বারের নেতৃত্বে যৌনকর্মী আখ্যা দিয়ে তিন নারীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। ওই তিন নারীকে ঘর থেকে বের করে টেনে হিচড়ে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে ইউসুফ মেম্বারের নেতৃত্বে এলাকার কথিত বিচারকরা। কেবল মারধরই নয় জোর করে ওই নারীদের মাথার চুলও কেটে দেয়া হয়। এরপর ওই অবস্থায় কয়েক ঘন্টা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয় তাদের। এ ঘটনায় পরে ফাতেমা আক্তার ইউসুফ মেম্বারসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওইদিন রাতেই ইউসুফ মেম্বারকে পুলিশ গ্রেফতার করে। 

এই বিভাগের আরো খবর