শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

গরীব মানুষের বসবাস ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০১৯  

আমাদের অর্থনীতি এমনভাবে সাজানো যে গুটিকয়েক মানুষের সম্পদ ক্রমেই এবং অন্যায্যভাবে বাড়ছে। এর বিপরীতে কোটি কোটি মানুষ কোনোরকমে জীবনধারণ করেছে । বিশ্বে নারীরা নিরাপদ মাতৃসেবা পচ্ছেনা, শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না।

 

বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান সমস্যা হলো প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বৈষম্য। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখার হিসাবে দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা ২কোটি ৪১লাখ। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের বিবেচনায় হিসাব করলে তা হবে ৮কোটি ৬২লাখ। 

 

গত এক বছরে ধনী আরও ধনী হয়েছে। বিপরীতে গরিব হয়েছে আরও গরিব। বর্তমানে মাত্র ২৬জন ব্যক্তির হাতে বিশ্বের ৩৮০কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমান সম্পদ রয়েছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্যগোষ্ঠী অক্সফামের এক প্রতিবেদনে এই তথ্যে উঠে এসেছে।

 

সুইজারল্যান্ডে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) শুরু হওয়ার আগের দিন, প্রতিবেদনটি প্রকাশ করল অক্সফাম। এতে বলা হয়, ২০১৭ সালে বিশ্বের দারিদ্র জনগোষ্ঠীর সমান সম্পদ ৪৩ জন ধনকুবেরের হাতে ছিল। তার আগের বছর, ২০১৬ সালে ধনকুবেরদের এই সংখ্যা ছিল ৬১জন।

 


অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। দ্রুতত মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি বা ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতিগরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে।

 

বিশ্বব্যাংক পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র মানুষ আছে, এমন ১০টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) যাঁদের দৈনিক আয় ১ডলার ৯০সেন্টের কম, তাঁদের হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্ররেখা হিসেবে বিবেচিত হয় । বিশ্বব্যাংক ২০১৬ সালের মূল্যমান ধরে পিপিপি ডলার হিসাবে করেছে। বাংলাদেশে প্রতি পিপিপি ডলারের মান ধরা হয়েছে সাড়ে ৩২টাকা।

 

সেই হিসাবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকে গেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনো নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। এ কারণে বিশ্বব্যাংক নিম্ন মাধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অতিগরিব মানুষের একটি আলাদা হিসাব দিয়েছে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মানুষকে দারিদ্র সীমার ওপরে উঠতে হলে দৈনিক কমপক্ষে ৩দশমিক ২পপিপি ডলার আয় করতে হবে।

 

বিশ্বব্যাংক বলেছে, এভাবে হিসাব করলে বাংলাদেশে অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৮কোটি ৬২লাখ। আর দারিদ্র্যের হার হবে ৫২দশমিক ৯শতাংশ। এর মানে হলো, টেকসইভাবে গরিবি হটাতে বাংলাদেশের প্রায় ৬কোটি ২১লাখ মানুষকে দ্রুত দৈনিক ৩দশমিক ২ডলার আয়ের সংস্থান করতে হবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী এখন ঝুঁকিতে আছে।

 

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে সবচেয়ে বেশি ১৭কোটি ৫৭লাখ হতদরিদ্র আছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আগে দারিদ্র কমানোর পূর্বশর্ত ছিল প্রবৃদ্ধি বা দারিদ্র কমাতে হবে । দেশে ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও হয়েছে। এত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর দেখা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছ, বৈষম্যও বেড়েছে। 

 

অন্যদিকে দারিদ্র  হ্রাসের গতিও কমেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়ে দারিদ্র নির্মূল করা যাবে, এটা ঠিক নয়। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধিতে গরিব মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। গরিব মানুষের সম্পদ হলো পরিশ্রম। এই শ্রমের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে গরিব মানুষের মজুরি বাড়াতে হবে। আবার কৃষির বাইরের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের জন্য গরিব মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর নজর দিতে হবে।

 

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ এখন নিম্ন মাধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে। তাই ৩ দশমিক ২ডলারের দৈনিক আয়ের হিসাবও মাথায় রাখতে হবে। যে বিশাল জনগোষ্ঠী দুই হিসাবের মধ্যবর্তী স্থানে আছ। তাদের দ্রুত আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে হবে।

 

আয়ের বৈষম্য পরিমাপের পদ্ধতি হচ্ছে জিনি ( বা গিনি) সহগ। বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মান এখন-০.৪৮৩। জিনি সহগ ০.৫ পেরিয়ে গেলে তাকে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ বলা হয়। বাংলাদেশ এর খুব কাছে পৌঁছে গেছে ।  

 

গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স বলেছে, অতিধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম। গত বুধবার একই প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশের ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে।

 

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে শুন্যের কোঠায় দারিদ্র্য নামিয়ে আনা। এই সময়সীমার দুই-তিন বছর আগেই এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায় বাংলাদেশ। অর্থাৎ আগামী ১০ বছরে হতদরিদ্রের হার ৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এখন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান প্রায় ২০ কোটিতে পৌঁছাবে। এর মানে, তখনো বাংলাদেশে প্রায় ৬০লাখ লোক অতিগরিব থেকে যাবে।

 

এই বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (ডিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন-২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য নির্মূলকে প্রধান্য দিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টি পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া এখন যে অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্য ও আয় বৈষম্য আছে, তাতেও বিশেষ নজর দেওয়া হবে।

 

নিম্ন মাধ্যম আয়ের দেশের হিসেবে দারিদ্রসীমার ওপরে ওঠার জন্য আয় বৃদ্ধির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শামসুল আলম বলেন, বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে ২০২১ সালের মধ্যে অর্থনীতির সক্ষমতাও বাড়বে। আর্থসামাজিক অবস্থান পরিবর্তনও আসবে।

 

অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে প্রথম এখন দেখা যাচ্ছে, ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে, বিশ্বে তৃতীয়। দুটি তথ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের। সংস্থাটি বলেছে, আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশ ধনী মানুষের সংখা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে।

 

২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে এ হিসাব করেছে ওয়েলথ-এক্স। সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে বলা ছিল, ৩ কোটি ডলার বা আড়াই’শ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ওয়েলথএক্সের হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে।

 

এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ মোট ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। তবে ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে দেশে ধনী ও অতিধনীর সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধির চিত্র উঠে এলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসস) প্রতিবেদনে দরিদ্র মানুষের আয়ে বড় ধরণের বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। আবার অনেকে মনে করেছেন, এই ধনীদের বড় অংশের উত্থান ঘটেছে স্বজনতোষী পুঁতিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি কাজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ঘুষ- দুর্নীতির মাধ্যমে।

 

বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছররে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। বিপরীত একই সম সবেচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৭৩৩ টাকায়, যা ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৯১ টাকা ছিল।


 
জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে একটি টেকসই অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু এটার আলোচনা বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগকে ঢেকে দিচ্ছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, এখন গবেষণা হওয়া দরকার, এই ধনীদের উত্থান কি অর্থনীতিতে অবদান রাখার মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি অনৈতিক উপায়ে হচ্ছে। কারণ, ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়মের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ধনী হওয়ার ধারণাটিই সামনে চলে আসে।

 

এই অতি ধনী ও অতি গরিব মানুষের অবস্থানগত বৈষম্য দুঃখজনক। মুষ্টিমেয় মানুষের শক্ত অবস্থান একটি দেশের সামগ্রিক চিত্রকে প্রকাশ করতে পারে না। গরিব মানুষের অবস্থানের বিষয়টি বিবেচ্য বিষয়। বর্তমান সরকারকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।


লিজা কামরুননাহার

এই বিভাগের আরো খবর