শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঔষধ বিক্রি হবে সরকার নির্ধারিত দামে

প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারি ২০২০  

ইমতিয়াজ আহমেদ (যুগের চিন্তা ২৪) : নিয়ন্ত্রণহীন দেশের ওষুধের বাজার। নকল ও ভেজাল ওষুধে সয়লাব নারায়ণগঞ্জ। ভাল ভাল ওষুধ নকল হয় বেশি। ওষুধের প্যাকেটে খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ  ক্ষেত্রে সেই দামে বিক্রি হয় না। ১২ টাকার ইনজেকশন ৮শ’ এবং ৬০ টাকার ওষুধ ১৯শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

নারায়ণগঞ্জ জেলায়  মোট ১০ হাজার ওষুধের  দোকান রয়েছে। এরমধ্যে ৫ হাজার  বৈধ ও ৫ হাজার অবৈধ দোকান। বছরে জেলায় ৭‘শ কোটি টাকার বেশি ওষুধ কেনা বেচা হয়। সে হিসেবে  জেলায় শতকোটি টাকার ওষুধের বাজার। বৈধ-অবৈধ খুচরা ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দামে ওষুধ বিক্রি করছেন।

তাদের এ কাজে সহায়তা করেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের কারসাজি রুখতে কাজ করছে বাংলাদেশ কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস সমিতি। ১ জানুয়ারী থেকে সমিতির অন্তর্ভুক্ত খুচরা ঔষধ বিক্রেতাদের সরকার নির্ধারিত মূল্যে ঔষধ বিক্রয়ের জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু এ বিষয়টি ভাল চোখে দেখছেনা কিছু ঔষধ ব্যবসায়ী। 

তবে জনস্বার্থে অধিকাংশ ঔষধ বিক্রেতা সাধুবাদ জানিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস সমিতি নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি মো: শাহজাহান খান জানান, সরকার নির্ধারিত মূল্যে ঔষুধ বিক্রি না করে কিছু ব্যবসায়ী  কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধির সাথে যোগসাজশ করে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দাম বাড়িয়ে দেয়। ১০ টাকার ক্যাপসুল বিক্রি হয় ৪০ টাকা। 

এ ধরনের জোচ্চুরি রুখতে কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি ঔষধের প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্ধারিত মূল্যে ঔষধ বিক্রি করার কথা বলছেন। সমিতির নির্দেশ অনুসারে প্যাকেটের গাঁয়ে লেখা মুল্য থেকে কোন ব্যবসায়ী কম বা বেশি মূল্যে ঔষধ বিক্রয় করবেনা। কম মূল্যেতো ব্যবসায়ীরা কখনোই বিক্রি করেনা বরং সুযোগ পেলেই কৃত্রিম সংকট তৈরী করে কয়েক গুণ বেশি দামে ঔষধ বিক্রি করে। 

তাছাড়া নকল ও ভেজাল ঔষধে বাজার সয়লাব। ভাল ভাল ঔষধ নকল করে বিক্রি করার দায়ে সমিতির তরফ থেকে ঢাকার মিটফোর্ডে ৪০০ ঔষধের দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নকল, ভেজাল ও স্যাম্পল ঔষধ ও বিক্রয় নিষেধ। 

শাহজাহান খানের মতে, নারায়ণগঞ্জে পানের দোকান, মুদী দোকানেও আজকাল  ঔষধ বিক্রি হয়। গত বছর নারায়ণগঞ্জে ৫০ টা দোকান বন্ধ ও ২০০ দোকানকে জরিমানা করেছে জেলা প্রশাসন ও ঔষধ প্রশাসন। 

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নতুন নীতিমালার আওতায় এখন দেশে অত্যাবশ্যকীয় অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের তালিকা বেড়ে ২৮৫টি হয়েছে, যা আগে ছিল ৭০টি। একইভাবে ইউনানির অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ২২৩ ও আয়ুর্বেদিকের ৩৭০টি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ওভার দ্য কাউন্টার বা  প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনার উপযোগী ওষুধ থাকছে ৩৯টি। 


এই নীতিমালার আওতায় এখন দেশে  প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কেনা যাবে মাত্র ৩৯টি, বাকি প্রায় ১২০০ আইটেমের ওষুধ কিনতে  প্রেসক্রিপশন লাগবে। এ ছাড়া এবারই প্রথম অ্যালোপ্যাথিকের বাইরে আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানির মতো ওষুধকেও নীতিমালার আওতায় আনা হয়েছে। এতে বিশৃঙ্খলা অনেক কমবে। এছাড়া ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পাশাপাশি এবারই প্রথম ওষুধের ভোক্তাদের স্বার্থকেও অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।


একটি চক্র দেশের সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যসন্ত্রাস চালালেও নির্বিকার সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এ ছাড়া ওষুধের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিপণন খরচ মেটাতে সময়-অসময় দাম বাড়ায় ওষুধ কোম্পানিগুলো। মাত্র ১১৭টি ওষুধ ছাড়া বাকিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই প্রশাসনের। ফলে কারণে-অকারণে ওষুধের দাম বৃদ্ধির নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক সৈকত  কুমার কর গণমাধ্যমকে বলেন, সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে  কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি। বিভিন্ন কোম্পানির দাম বৃদ্ধির কিছু আবেদন  থাকলেও সেগুলোর অনুমোদন  দেয়া হয়নি। 


তবে দোকানিরা দাম বাড়িয়ে থাকলে বিষয়টি  প্রশাসনের  জানা নেই। এমনকি তারা কোনো অভিযোগও পায়নি। তিনি জানান, প্রশাসনের  কাজ চালাতে  প্রয়োজনীয়  লোকবল না থাকায় দেশের সব ওষুধের দোকানের ওপর নিয়ন্ত্রণ  রাখা সম্ভব হয় না।


অস্বাভাবিক  দামে ওষুধ বিক্রির একাধিক তথ্য এসেছে  ঔষধ প্রশাসনের কাছে। চলতি সপ্তাহে রাজবাড়ীতে ১২ টাকা মূল্যের একটি ইনজেকশন ৮০০ টাকায় বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত সেলাই সুতার দাম ১৫-২০ টাকা। ঢাকার শাহবাগের একটি দোকানে এই সুতার দাম নেয়া হয় ৬০০ টাকা। 


যশোরে একটি দোকানে বমির ওষুধ কিনতে গেলে দাম রাখা হয় ১৯০০ টাকা। অথচ ওষুধের প্রকৃত দাম মাত্র ৬০ টাকা। এ ধরনের ঘটনা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলায়  প্রতিনিয়ত ঘটছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপিতে প্রয়োজনীয় ডসেটিক্সেল, প্যাক্লিটেক্সেল, জেমসিটাবিন ইত্যাদি ওষুধের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ক্যাটামিন ইনজেকশনের দাম ৮০-১১৫ টাকা কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকায়।

খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওষুধের দাম প্রতি পাতায় (ট্যাবলেট ও ক্যাপসুলের ক্ষেত্রে) লেখা থাকে না। লেখা থাকে ৫ পাতা বা ১০ পাতার একটি বাক্সে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  ক্রেতা প্যাকেটের গায়ের দাম দেখার সুযোগ পান না। অন্যান্য পণ্যের মতো ওষুধের দাম সম্পর্কে  রোগীদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রোগীদের মুখ দেখেই একশ’ থেকে দু’শ গুণ দাম বাড়াতেও দ্বিধা করে না অসাধু বিক্রেতারা।


গত মাসে  শহরের প্রেসিডেন্ট রোডে একটি ওষুধের দোকানে অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত সেলাই সুতা কিনতে যান  দেলোয়ার হোসেন। এ সময় ওই দোকানি ১৫-২০ টাকা দামের সেলাই সুতা তার কাছে ৬০০ টাকায় বিক্রি করেন। বোন একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকায় তিনি দরদাম না করে সুতা নিয়ে  সেখানে ফেরেন। সেখানকার নার্সের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন দোকানি তাকে ঠকিয়েছেন। পরে ওই দোকানে গিয়ে টাকা ফেরত চাইলে দোকানি বিষয়টি অস্বীকার করেন।


কাঁচপুরে একই ধরনের ঘটনা ঘটে গত ডিসেম্বরে। একটি ফার্মেসিতে অ্যাপোনসেট নামের একটি বমির ওষুধ কিনতে গেলে দোকানি ওষুধের দাম রাখেন ১৯০ টাকা। অথচ ওষুধের প্রকৃত দাম মাত্র ৬০ টাকা। 


বিভিন্ন বিষেশায়িত হাসপাতালের সামনে ওই সব রোগের ওষুধের চাহিদা অনুসারে দাম বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে ওষুধের প্যাকেটে লেখা দামের কোনো পরিবর্তন হয় না। যখন যে ওষুধের চাহিদা বাড়ে তখন  কোম্পানির  প্রতিনিধি ও দোকানিরা মিলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে থাকেন।


শহরের ডিআইটি এলাকার একটি ওষুধের দোকানে দেখাগেছে, ডক্সিভা ২০০ মিলিগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। ওষুধটির নির্ধারিত মূল্য ৬ টাকা হলেও একজন ক্রেতার কাছে ৮ টাকা এবং আরেকজনের কাছে ১০ টাকা বিক্রি করতে দেখা যায়। ক্রেতাদের কাছে দাম জানতে চাইলে তারা বলেন, ওষুধের সঠিক মূল্য তারা জানেন না বা জানার  চেষ্টাও করেন না। কারণ হিসেবে বলেন, ওষুধ কেনা হয় সুস্থতার আশায়, তাই মূল্য ততোধিক গুরুত্ব পায় না। 

এ ছাড়া ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রে জানাগেছে, সাধারণত ওষুধের কাঁচামাল বা এপিআইয়ের দাম বাড়ার কারণে বাড়ে ওষুধের দাম। পাশাপাশি বিপণন খরচও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য  ইতিবাচক  ভূমিকা পালন করে। তারা জানান, বর্তমানে বেশিরভাগ কাঁচামাল আসে ভারত ও চীন থেকে। দাম বাড়লে কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসনে দাম বাড়ানোর আবেদন করে। কিন্তু দাম কমলে তারা আর ওষুধের দাম কমানোর কথা চিন্তা করে না।


এছাড়া বিদেশি ওষুধের কারণেও দামের তারতম্য দেখা যায়। যেমন ক্যান্সারের কেমোথেরাপির ওষুধের দাম সম্প্রতি বেড়েছে। সম্প্রতি কিছু বিদেশি কোম্পানি ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে কমিয়ে একটি অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যান্সার চিকিৎসায়  কেমোথেরাপিতে  প্রয়োজনীয় ডসেটিক্সেল, প্যাক্লিটেক্সেল, জেমসিটাবিন ইত্যাদি ওষুধের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। 


জানাগেছে, ১১৭টি ওষুধ সরকারের কাছে রেখে বাকি ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট  কোম্পানিগুলো- এমন প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সোমবার হিউম্যান  রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ রিট আবেদনটি  দায়ের  করা হয়। 


আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি জানান, দ্য ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ মতে, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার।  যেখানে মাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ সরকারের কাছে রাখে। বাকি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। এটাতো আইনের ব্যত্যয়।


পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৭‘শ কোটি টাকার ঔষদের বিশাল বাজার। এখানে কতিপয় ঔষধ ব্যবসায়ী ও কোম্পানীর প্রতিনিধি মিলে একটা সুযোগ পেলেই কৃত্রিম সংকট তৈরী করে ঔষধের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতেকরে বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। জীবন রক্ষায় ঔষধ না কিনেতো আর পারা যায়না। 


অসাধু চক্রটি কখনোই সরকারের নীতিমালা মানে না। এই চক্রের সদস্যরাই কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস সমিতির নির্দেশনা নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছেন। ওরা মানুষকে উল্টো বোঝাচ্ছেন, সমিতি কমদামে ঔষধ বিক্রি করতে নিষেধ করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছেমত ঔষধের দাম আদায়ের সুযোগটি আর থাকছেনা বলেই ঐ সকল ঔষধ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। কিন্তু আখেরে এতে কাজ হবেনা। 
 

এই বিভাগের আরো খবর