মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ৫ ১৪৩০

এতিম শিশুদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি, হরিলুট : নির্যাতনের অভিযোগ !

প্রকাশিত: ১৬ মে ২০১৯  

ফরিদ আহম্মেদ বাধন (যুগের চিন্তা ২৪) : ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার ওরা ৫২ জন। নিয়তির কারণেই আজকে ওদের ঠাঁই হয়েছে ফতুল্লার মুসলিম নগর বায়তুল আমান সরকারী শিশু পরিবারে(এতিমখানা)। তবে এখানেও নিয়তি তাদের পক্ষে নেই ! শিশু পরিবারে সরকারীভাবে যে খাবার  দেয়ার ও পরিচর্চার করার কথা রয়েছে তা তাদের ভাগ্যে নেই।

 

শিশু পরিবারের উপ তত্বাবধায়ক থেকে শুরু করে বাবুর্চিসহ সবার বৈরিতার শিকার হতে হয় কোমলমতি এই শিশুদের। কোথাও  নালিশ করার জায়গা তাদের নেই। পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি। রয়েছে একটি কমিটিও। কিন্তু বিগত ৩ বছরেও হয়নি এই প্রতিষ্ঠানটির কমিটির কোন সভা। 

 

প্রতিষ্ঠানটিতে শিশুদের যাবতীয় খাবার দেয়ার জন্য সরকারীভাবে টেন্ডার পাওয়া নিপা ট্রেডার্সের মালিক নুর হোসেন মোল্লাও  শিশুদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।  এতিমদের জন্য বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া দানের খাবারসহ বাৎসরিক নানা রকম জিনিসপত্রও লুট হয়ে যাচ্ছে সরকারী এই প্রতিষ্ঠান থেকে।   

 

বর্তমান সরকার হতদরিদ্র মানুষের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তবে কিছু অর্থলোভী ও মুনাফাখোরের কারণে সরকারে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড বিভিন্ন সেক্টরে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ঠিক তেমনই একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান মুসলিমনগর বায়তুল আমান সরকারী শিশু পরিবার। এই প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৫১জন পিতা-মাতা হারা শিশু রয়েছে। 

 

এর মধ্যে রয়েছে পরিবারের কাছ থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধ একজন ব্যক্তি। একই প্রতিষ্ঠানের ভিতর রয়েছে প্রতিবন্দীদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থাও। কিন্তু কতটুকু সেবা পায় এই প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়া শিশু কিশোররা। এমন প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই মুসলিম নগরবাসীর মনে ছিল। 

 

সরেজমিনে শিশু পরিবারে গিয়ে দেখা যায়, নোংরা পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছে ৫১জন শিশু ও একজন বয়োবৃদ্ধ। দুপুরে শিশুদের খাবারের ম্যানুতে ছিল ভাত, মুরগির ডিম, ডাল ও সব্জি। কিন্তু খাবারের টেবিলে গিয়ে শিশুদের প্লেটে দেখা গেছে শুধুমাত্র আলুভাজি। 

 

শিশুরা জানায়, খাবারের ম্যানুতে বিভিন্ন দিনে মাছ, মাংস থাকলেও তা ঠিক মতো দেয়া হয়না। প্রতিষ্ঠানে শিশুদের খাবার পরিবেশনে সরকারীভাবে টেন্ডার পেয়েছেন  গোদনাইলের নিপা ট্রেডার্সের মালিক নুর হোসেন মোল্লা। 

 

কিন্তু এই গুনধর ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে আঁতাত করে শিশুদের খাবার দেয়ার ব্যাপারে, কার্পন্য করছে অনেক আগে থেকেই।  এমন অভিযোগ এতিম শিশুদের। 

 

বায়তুল আমান সরকারী শিশু পরিবারের মূল তত্বাবধায়ক নেই। বর্তমানে উপ তত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার মিয়া ফিরোজ আহমেদ খান। অফিস সহকারী পদে রয়েছেন মেহেদী হাসান। শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষিকা হিসেবে রয়েছেন রোকেয়া নামের একজন নারী। 

 

তবে উপ তত্বাবধায়ক ঠিক মতো শিশু পরিবারে আসেন না। শিক্ষিকা রোকেয়া বেগমও শিশুদের নিয়মিত পাঠদান করেন না। শিশুরা কোন প্রতিবাদ করতে পারে না এখানে। খাবার নিয়ে কেউ কোন কথা বল্লে, তার উপর অফিস সহাকরী থেকে শুরু করে অন্যরা নির্যাতন চালায় বলেও অভিযোগ করেন বেশ কয়েকজন শিশু। 

 

বুধবার দুপুরে বায়তুল আমান শিশু পরিবারে সরেজমিনে গেলে কথা বলেন অফিস সহকারী মেহেদী হাসান। তিনি জানান, কয়েক মাস যাবৎ বায়তুল আমান শিশু পরিবারে তত্বাবধায়কের পদটি শূন্য রয়েছে। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন  উপজেলা শিক্ষা অফিসার  মিয়া ফিরোজ আহম্মেদ। তিনি মাঝে মধ্যে আসেন। 

 

শিশুদের খাবারের টেন্ডার পেয়েছেন নিপা ট্রেডার্সের মালিক নুর হোসেন মোল্লা। যথা সময়ে শিশুদের খাবার পরিবেশন করা হয়। 

 

শিশুদের খাবারের তালিকানুযায়ী খাবার দেয়া হয়না, এমন অভিযোগ তিনি অসত্য বলে দাবী করেন। অফিস সহকারী মেহেদী হাসান জানেননা শিশুদের জন্য বাৎসরিক কত টাকা বাজেট হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দেয়া দানের পরিমানের বিষয়েও  তথ্য দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।  

 

অফিস সহকারীর কথার পরেই অনাথ শিশুদের ব্যারাকে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বুধবারে দুপুরের খাবারের ম্যানুতে যে খাবার দেয়ার কথা তা দেয়া হয়নি। এছড়াও সকাল ও রাতের খাবারেও অনিয়ম হয় বলে জানায় শিশুরা। 

 

রাতে দায়িত্ববান  ব্যাক্তিকে শিশু পরিবারের ভেতরে অবস্থান করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ সময় তারা অনুপস্থিত থাকে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এছাড়াও পঁচাগলা বাসি খাবারও তাদের পরিবেশন করা হয় বলে অভিযোগ করেন  বেশ কয়েকজন শিশু। অনেক সময় খাবার মুখে দিতে না পেরে খেগুলো ফেলেও দেন তারা। 

 

সরকারী শিশু পরিবারের কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পদাধিকার বলে মুসলিমনগর বায়তুল আমান সরকারী শিশু পরিবারের সভাপতি সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। 

 

এছাড়াও সমাজসেবা অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন অফিসার ও এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। বিগত ৩ বছর যাবৎ এই কমিটির কোন সভা হয়নি। এতিম শিশুদের সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে তাই কমিটির লোকজন অবগতও নয়। 

অনেকটা অবহেলায় শিশুদের জীবন কাটছে। যে যার মতো শিশুদের সাথে আচরণ করছে বলে মৌখিক অনেক অভিযোগ আসে। কিন্তু সভা না হওয়াতে তেমন কিছু করা যাচ্ছে না। 

 

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান সরাকরী বরাদ্দ থেকে মুসলিমনগর বায়তুল আমান সরকারী শিশু পরিবারের ৩টি ভবন নির্মাণ করেছেন। শামীম ওসমানের ৭ হাজার ৫ কোটি টাকার উন্নয়নের মধ্যে ৩টি ভবন নির্মাণসহ শিশু পরিবারের অন্যান্য উন্নয়নও রয়েছে। 

 

তবে ঐ ভবনগুলোতে বসবাসরত শিশুদের ভাগ্যের তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের তত্বাবধানে  শিশু পরিবার পরিচালিত হয়ে আসছে। তদারকি না থাকায় শিশুরা থাকছে অবহেলিত।

 

একটি সূত্র জানায়, সাংসদ শামীম ওসমান গত বছর এতিমদের জন্য একটি গরু অনুদান দেন। সেই গরুর মাংস এ বছরও এতিমখানার ফ্রিজে রয়ে গেছে। সরকার কর্তৃক বরাদ্দের টাকা বাঁচাতে অনুদানের মাংস ফ্রিজে রেখে শিশুদের খাওয়ানো হয়। ১ বছর আগে ফ্রিজে রাখা মাংস নষ্ট হওয়ার পরও  সেই মাংস খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। 

 

এছাড়াও গুরুত্বপূর্ন দিবসগুলোতেও শিশুদের বিশেষ খাবার দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় না। বিভিন্ন সময় দেয়া ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুদানের খাবারও হরিলুটের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে। বছরে দুইবার সরকারীভাবে শিশুদের পোশাক দেয়ার কথা থাকলেও তা ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা দেন না বলেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। 

 

এই শিশু পরিবারে অপর ভবনের ৮জন প্রতিবন্দির বসবাস। তারাও সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ঠিকাদার নুর হোসেন মোল্লাও প্রতিবন্ধীদের খাবারের ঠিকাদারী পেয়েছেন। এখানেও তার কারিশমায় প্রতিবন্দীদের দেয়া হয় নি¤œমানের খাবার। 

 

এব্যাপারে বায়তুল আমান শিশু পরিবারের সভাপতি সদর উপজেলার ইউএনও নাহিদা বারিকের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। 

 

উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালে মুসলিমনগরের বেশ কয়েকজন দানশীল ব্যাক্তিদের জমিদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিনিয়র ইসলামিয়া মাদ্রসা। তৎকালীন সময়ে হাসমত উল্লাহ মাওলানা ঐ মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এতিমখানায় রুপ নেয়। 

 

ঐ সময়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মাদ্রসাটিতে সরকারী অনুদান দেয়ার ব্যাপারে এতিমখানটি পরিদর্শনও করেছিলেন। এক সময় এটি সরকারী করনও হয়। এরশাদ শাসনামলে এতিমখানাটির নাম করণ করা হয়েছিল এরশাদ শিশু পরিবার। 


এরশাদ সরকার পতনের পর মুসলিমনগর বায়তুল আমান সরকারী শিশু পরিবার হিসিবেই পরিচিতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। 

এই বিভাগের আরো খবর