শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

একমাসে ৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে বিকেএমইএ

প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল ২০২০  

তুষার আহমেদ :  করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের প্রথম জেলা হিসেবে লকডাউন করা হয় শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জ’কে। এছাড়াও দেশে করোনার সংক্রমণ এড়াতে পাঁচ দফা বাড়িয়ে প্রায় দেড় মাসের ছুটি ঘোষণা করে সরকার।  সরকারের পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী সবশেষ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির আওতায় থাকলেও পরিস্থিতি অনূকুলে না আসায় সেই ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত করা হয়।


কিন্তু এখনও করোনার ঝুঁকিমুক্ত হওয়া যায়নি। প্রতিনিয়তই সংক্রমনের সংখ্যা বাড়ছে নারায়ণগঞ্জে। তবে, অর্থনৈতিক সংকটে পড়ায় রাষ্ট্রীয় ছুটির মেয়াদ বহাল থাকলেও সংক্রমনের প্রবল ঝুঁকি নিয়ে  রোববার থেকে স্বল্প পরিসরে খুলতে শুরু করেছে নারায়ণগঞ্জের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো।


সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জ লকডাউন ঘোষণার পরই প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে একাত্মতা প্রকাশ করেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বৃহৎ সংগঠন বিকেএমইএ। এরপর গত ২৬ তারিখ থেকে এক মাস যাবৎ বন্ধ থাকে বিকেএমইএর আওতাধীন সকল নীটিং গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান। বন্ধ ছিলো অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানও। এমন পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ তথা দেশের অর্থনীতি যেন গতি হারিয়ে ফেলেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে জেলার লাখো মানুষ।  


কারখানা খোলার বিষয়ে রোববার নারায়ণগঞ্জ জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ মহাপরিচালক সৌমেন বড়ুয়া যুগের চিন্তা’কে বলেন, ‘যেহেতু দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু উর্ধতন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে আজ ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জের স্বল্প সংখ্যক কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আগামী ৩০ থেকে ৬ তারিখের মধ্যে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কল-কারখানা খোলা হবে।’


তিনি বলেন, অল্প সংখ্যক শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য বলা হয়েছে। সুইং সেকশনে অল্প সংখ্যক শ্রমিক থাকবে। যেমন ধরুন কোন কারখানায় ৬ হাজার শ্রমিক থাকলে সেখানে হয়তো এক থেকে দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করবে। আর শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মালিক পক্ষকে বলা হয়েছে।’


অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরী। করোনার প্রভাব পড়ায় কাগজে-কলমে গত ২৬ মার্চ থেকে নিয়ে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ একমাস ধরে বন্ধ রয়েছে বিসিকের সকল গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান। এই একমাসে শুধু ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীর ব্যবসায়ীরা অন্তত ১৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ক্ষতির সম্মূখিন হয়েছেন।

 

একই সাথে প্রাপ্ত অর্ডার সমূহ সময়মত সাপ্লাই দিতে না পারলে বিদেশী বায়াররা অর্ডার প্রত্যাখান করে অন্যকোন রাষ্ট্রকে দিয়ে দিতে পারে। আর এটা হলে দেশের অর্থনীতি আরো ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে। কেননা দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে গার্মেন্টস বা পোশাক কারখানাগুলো।   


এমন তথ্য জানিয়ে ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান যুগের চিন্তা’কে বলেন, ‘শনিবার রাতে মেসেজ পেয়েছি যে, জরুরী সাপ্লাই দিতে হবে এমন অল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই অল্প সংখ্যক পোশাক কারখানা খোলা হয়েছে।’


এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনার প্রবল ঝুঁকি নিয়েই প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে তা ঠিক। কিন্তু দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে এছাড়া আর কিছুই করার নেই। গত একমাস ধরে বিসিক শিল্পাঞ্চলের সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আমরা প্রাথমিক ভাবে একটি হিসেব টেনেছি। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত একমাসে অন্তত ১৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতি সাধিত হয়েছে শুধু বিসিকের পোশাক খাতে।’


তবে, কারখানার মালিক পক্ষ শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিলেও প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে সেই ব্যবস্থা তেমন কাজে আসবে বলে মনে করছেন না এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন- ‘মালিক পক্ষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেও সংক্রমন রোধে তা কাজে দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

 

কারণ গার্মেন্টস বা কারখানায় একসাথে অনেক শ্রমিক কাজের জন্য জড়ো হয়। আর কাজে থেকে সুরক্ষার মধ্যে থাকা যায়না। তাই প্রতিষ্ঠান খোলায় করোনার ঝুঁকি আরো বৃদ্ধিপাবে বলে আমি মনে করি। আসলে এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি ! সরকার ও সংশ্লিষ্টরা দোটানায় পড়েছেন।’


বিকেএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোঃ হাতেম যুগের চিন্তা’কে বলেন- ‘প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিষয়ে গতকাল (শনিবার) রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্বল্প পরিসরে খোলা হয়েছে। রোববার বিকেএমই এর অধিনস্ত ৮৩৮টি কারখানা হতে ২০ শতাংশ খোলা হয়েছে। আগামী ২ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কারখানা খোলা হবে। আপাতত নীটিং, ডাইং ও স্যাম্পল সেকশন চালু হবে। কারণ এই সেকশন গুলোতে লোকবল কম দরকার হয়।’


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ‘অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বায়ারদের অর্ডার সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় অর্ডার হাত ছাড়া হলে তারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। অর্ডার অন্যকোন রাষ্ট্রে চলে গেলে দেশের অর্থনীতি অপূরনীয় ক্ষতির মূখে পড়বে। তখন আরো বড় সমস্য দেখা দিবে।

 

আর অর্ডার না থাকলে একদিকে যেমন কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনি দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে বেকারত্ব বরণ করতে হবে। তাই করোনাকে আমরা আমাদের জীবনের অংশ হিসেবে নিয়েছি। এটা সাথে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ঝুঁকি নিয়ে হলেও কারখানা খোলা রাখতে হচ্ছে।’


তিনি বলেন, ‘বিকেএমইএ’র এক মাসের রপ্তানী ৩ বিলিয়ন। কিন্তু গত এক মাসে ৮৭ শতাংশ রপ্তানী কম হয়েছে। এই এক মাসের ক্ষতি পূরণ করতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। বাকি তিন মাসেও এই এক মাসের ক্ষতির প্রভাব পড়বে। যেহেতু এক মাসে ৩ বিলিয়ন ডলার হয়, সেহেতু তিন মাসে দাঁড়ায় ৯ বিলিয়ন ডলার। আর তিন মাসে এর আনুপাতিক ক্ষতির পরিমান অন্তত ৭ থেকে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার হবে। তাই দেশের অর্থনীতির কথা ভেবে আমাদের প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতেই হবে।’


এদিকে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হলেও শ্রমিকদের জন্য পিপিই বা অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রাণঘাতী করোনার চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে শ্রমিকদের মাঝে।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফতুল্লার রেললাইন বটতলা এলাকায় অবস্থিত জালাল আহমেদ স্পিনিং মিলের একজন শ্রমিক বলেন- ‘মালিক পক্ষ প্রতিষ্ঠান খুলেছে বলে আমরা কাজে এসেছি। কিন্তু করোনা নিয়ে আতঙ্কে আছি। কারখানার মালিক পক্ষ থেকে পিপিই বা অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়নি। এটা খুবই দুঃখ জনক।’


জানা গেছে ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হচ্ছেন বিএনপি নেতা শাহ-আলম। এই বিষয়ে শাহ-আলমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।


গার্মেন্টস বা মিল ফ্যাক্টরী খোলা হলে সংক্রোমন বৃদ্ধি পাবে কিনা তা জানতে নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে যুগের চিন্তা’কে তিনি বলেন- ‘এক্ষেত্রে ঝুঁকিতো থাকবেই। তবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে সংক্রোমন বাড়বে না। যেমন দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া। এসব না মানলেতো সংক্রোমন বাড়বেই।’


নারায়ণগঞ্জে করোনার ব্যাপক ঝুঁকি থাকা সত্বেও প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের বিগত দিনের ছুটি বা অন্যান্য তৎপরতা বিফলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন- ‘সরকার বা দেশের নীতি নির্ধারকগণ চিন্তা করেই ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন।

 

এখানে আমার মন্তব্য করার মত কোন বিষয় নেই। আমি বলব যে, সরকার যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রত্যেকেই যেন সেই সিদ্ধান্ত ও বিধি-নিষেধ সঠিক ভাবে মেনে কাজ করেন। তাহলেই হবে। আর আমার পরামর্শ থাকবে যে, যারা লকডাউনে নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করেছেন, শুধু তারাই যেন কাজে যোগ দেয়। এছাড়া যারা লকডাউনে অন্য জেলায় গিয়েছে, বা অন্য জেলা থেকে এসেছে, তারা যেন কাজে না আসেন। সেদিকে দায়িত্বশীলদের খেয়াল রাখতে হবে।’


 করোনার এই মহামারিতে ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ তথা দেশের পরিনতি আরো ভয়াবহ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিনা শেষ হয় করোনার তান্ডব।

এই বিভাগের আরো খবর