মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ৫ ১৪৩০

আড়াইহাজারে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা, ১২ দিনে পাঁচ লাশ উদ্ধার

প্রকাশিত: ১৮ আগস্ট ২০১৯  

আড়াইহাজার (যুগের চিন্তা ২৪) : আড়াইহাজারে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। ৪ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকার থেকে মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে চার নারী ও এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

 
তবে কেন বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। এ মৃত্যুর জন্য কে বা কারা দায়ি। এমন প্রশ্ন এখন অনেকের। অনেকেই বলেছেন পরিবার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের অভাবেই অপমুত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। অনেকেই পরিবারের মধ্যে মানসিকভাবে অস্বস্তিতে বসবাস করে যাচ্ছেন। দিনের পর দিন বিভিন্নভাবে অনেকে নিজের পরিবারের সদস্যের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে যাচ্ছেন। অকেনেই জড়িয়ে যাচ্ছেন পরোকিয়ায়। তিনি নারীও হতে পারেন আবার পুরুষও হতে পারেন। 


এসব ঘটনায় কোনো প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগীরা সর্বশেষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। প্রতিদিনই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে গৃহবধূরা থানা পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছেন। অনেকেই প্রতিকার পাচ্ছেন। তবে নানা কারণে অনেকেই পুলিশের কাছ থেকে বিমূখ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে নানা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েও তেমন একটা সমাধান পাচ্ছে না নির্যাততরা। এসব মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যু ও আত্মহত্যায় প্ররোচণার মামলা হচ্ছে। তবে অনেকেই জেদের বসেও আত্মহত্যা করছেন। 


এবিষয়ে আড়াইহাজার থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে জেদের বশভূত হয়ে। তবে প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক। পুলিশ এসব মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে।

 

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৬ আগস্ট রিনা বেগম (৩০) নামে এক গহবধূকে পরোকিয়া প্রেমে বাধা দেওয়ায় আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে শুক্রবার সকালে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। এর আগে সে গত বৃহম্পতিবার রাতে নিজের শোবার ঘরে কীটনাশক মিশ্রিত পোকামাকড় দমনের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। স্থানীয় জালাকান্দি সরকার বাড়ি নামক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সে ওই এলাকার হামজা মিয়ার স্ত্রী ও একই এলাকার মৃত রেহমত আলীর মেয়ে। সে এক সন্তানের জননী ছিল। 

 

স্থানীয় গোপালদী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ নাসির আহম্মেদ নিহতের ভাই এনামুল হকের বরাত দিয়ে জানান, প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরোকিয়া চলে আসছিল রিনার। এনিয়ে তাদের পরিবারে প্রায় সময় ঝগড়াঝাটি হতো। এরই জেরে নিজের শোবার ঘরে সবার অজানতে পোকামাকড় নিধনের কীটনাশক মিশ্রিত ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে। 


গত ১৪ আগস্ট তাসকিয়া আক্তার রানী (২৪) নামে এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সে স্থানীয় মহনপুর এলাকার ছাগীর হোসেনের স্ত্রী এবং লতব্দী দাবুরপুরা এলাকার ইতালী প্রবাসী হালিমের মেয়ে। লাশ রেখে নিহতের স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে যায়। নিহতের পরিবারের দাবি ছিল নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে। 


খবর পেয়ে পুলিশ নিহতের শ্বশুর বাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। নিহতের ছোট ভাই রানা পুলিশকে বলেন, আমার বোনকে ৭ বছর আগে মহনপুর নিজেরপাড়া এলাকায় বারেকের ছেলে ছগীরের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর তাদের সংসারে দুই সন্তানের জন্ম নেয়। তবে নানা বিষয় নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে বনিবনা হচ্ছিল না। প্রায় সময় স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতো। 


তিনি আরও বলেন, এরই জেরে তাসকিয়াকে থাকার কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘হাসপাতালে আনার আগেই ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার থুতনির নিচে আঘাতের চিহ্ন ছিল।


১০ আগস্ট আড়াইহাজার পৌরসভাধীন ‘আড়াইহাজার প্লাজা’ নামে ভবনের ৬তলার একটি কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় নুরে আলম লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে স্থানীয় দয়াকান্দা এলাকার শেম্ভুপুরা গ্রামের সবির আলীর ছেলে এবং সে পেশায় রং মিস্ত্রী ছিলেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা সে আত্মহত্যা করেছে। তবে নিহতের পরিবারের তাকে কেউ হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখেছে। 


আড়াইহাজার থানার এসআই শামীম জানান, নিহতের থাকার একটি কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তবে রং মিস্ত্রী নুরে আলমের মৃত্যুর ঘটনায় সন্দেহের তীর এখন তার ভাবীর দিকে। 

 

ঘটনার পর থেকেই নিহতের মামাতো ভাইয়ের স্ত্রী রাবেয়া আত্মগোপনে থাকায় এখন তার প্রতি সন্দেহ করা হচ্ছে। তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে সন্দেহ আরো ঘনিভূত হচ্ছে। সে স্থানীয় মাহমুদপুর ইউপি’র মর্দাসাদী এলাকার মোসলেম মিয়ার মেয়ে। তাকে আটক করা হলে সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল তা জানা যেতো। ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলেও নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। 


এদিকে নিহতের মামা হালিম জানান, নুরে আলমের মামাতো ভাই সৌদিআরব প্রবাসী স্থানীয় উচিতপুরা এলাকার মজিদের ছেলে আমান উল্যাহ’র সঙ্গে চার বছর আগে রাবেয়ার বিয়ে হয়। আত্মীয়তার সুবাদে রাবেয়া ও নুরে আলমের পরোকীয়া চলছিল বলে সন্দেহ করা হতো। এরই জেরে কয়েক দিন আগে তাকে উচিৎপুরা এলাকার মারধরও করেছিল। 

 

এদিকে মোসলেম মিয়া এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার মেয়ে বা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্যই মৃত্যুর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। তাদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।


এদিকে ভবনের ৬ তলার ওই ফ্ল্যাটের মালিক মিজান বলেন, তিন মাসে আগে বোরকা পরিহিত এক নারীকে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে নুরে আলম তার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শামীম হোসেন বলেন, সন্দেহভাজন ওই নারীকে খোঁজা হচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মৃত্যুর কারণ বের হতে পারে। তিনি আরও বলেন, তবে মরদেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলেই কেবল মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। 

 

গত ৭ আগস্ট পোকামাড়ক দমনের কীটনাশক মিশ্রিত ট্যাবলেট খেয়ে আড়াইহাজারে হোসনেয়ারা (২৮) নামে এক নববধূ আত্মহত্যা করেছে। সে স্থানীয় উচিৎপুরা ইউপির গুরুবদী এলাকার কামিজ উদ্দিনের মেয়ে এবং সোনারগাঁও থানাধীন বিষনাদী এলাকার প্রবাসী হোসেন মিয়ার স্ত্রী। পুলিশ খবর পেয়ে নিহতের বাবার বাড়ি থেকে লাশ উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করে। 


নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৭ মাস আগে বিষনাদী এলাকার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে হোসেন মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় হোসনেয়ারার। পরে স্বামী বিদেশ চলে যায়। দুই আগে সে বাবা বাড়ি গুরুবদীতে বেড়াতে আসে। পরিবারের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে তার মনোমালিন্য চলছিল। এরই জেরে রাতে সবার অজানতে পোকামাড়ক নিধনের কীটনাশক মিশ্রিত ট্যাবলেট খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। 


৪ আগস্ট আড়াইহাজারে সুলতানা (২০) নামে এক গৃহবধূর রহস্য জনক মৃত্যু হয়েছে। তিনি ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। স্থানীয় ব্রাহ্মন্দী ইউপির বালিয়াপাড়া এলাকা থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিজের শোবার ঘরের আঁড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা। 


তবে নিহতের পরিবারের দাবি তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে স্বামীসহ তার পরিবারের অন্যরা পলাতক রয়েছে। নিহতের পরিবারে সূত্রে জানা গেছে, এক বছর আগে সুলতানার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় একই এলাকার জৈনক সামছুল মিয়ার ছেলে সোহেলের। সে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বামী তার পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। এরই জেরে তাকে তারা হত্যা করে থাকতে পারে।

এই বিভাগের আরো খবর