মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

আলোকিত মানুষের চলে যাওয়া

প্রকাশিত: ৫ জানুয়ারি ২০২০  

আহামেদ তমিজ : নারায়ণগঞ্জের বরেণ্য লেখক, সাহ্যিত্য সংগঠক ও একজন মননশীল আলোকিত মানুষ মোহাম্মদ ইসহাক এই মায়াবী পৃথীবি ছেড়ে অনন্তের পথে চলে গেলেন। মোহাম্মদ ইসহাকের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তেমন কোনো উচ্চতায় না থাকলেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতা আমার স্মৃতির আরশিতে এখনও উজ্জ্বল ও অম্লান হয়ে আছে।

 

মৃদুভাষী ,কথা বলার সময় সদা হাস্যময় একজন প্রানবন্ত মিশুক মানুষ ছিলেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের আরেকজন লেখক কবি শাহেদ আলী মানসুর স্মৃতিময় আত্মজৈবনিক গ্রন্থ "চোখের দেখা " প্রাণের কথার উপর আমি স্থানীয় একটি দৈনিকে একটি রিভিউ লিখেছিলাম।

 

সম্ভবতঃ একারনেই ইসহাক ভাই তার প্রায় সত্তর বছর বয়সে লেখা প্রথম উপন্যাস "বিকর্ষণ"- এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমাকে উপস্থিত থাকার জন্য দাওয়াত-পত্র দিয়েছিলেন। সুধীজন পাঠাগারে সেই অনুষ্ঠানে দেশের খ্যাতিমান কবি - মরহুম ফজল শাহাবুদ্দিন সহ অনেক নামি-দামী লেখক-বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন। অনুস্থান শেষে ইসহাক ভাই আমাকে তাঁর উপন্যাসের একটি সৌজন্য কপি দিয়েছিলেন। উপন্যাসটি পড়ে এর উপর একটি রিভিউ লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 


নারায়ানগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র-১ হাজী ওবায়েদউল্লাহর বড় ভাই বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা আজহার হোসেন শামসু ভাইর চেহলাম অনুষ্ঠানে আমার পাশেই ইসহাক ভাই বসেছিলেন। সেখানে নানা আলোচনার এক ফাঁকে তাকে আমি বলে বসি - " ইসহাক ভাই আপনার উপন্যাস 'বিকর্ষণ'- এর উপর আমি একটি রিভিউ লেখে স্থানীয় দৈনিক যুগের চিন্তা-পত্রিকায় দিয়েছি। তিনি হেসে বললেন, ছাপা হলে একটি কপি আমাকে দেবেন "।

 

গ্রন্থ আলোচনা-  মোহাম্মাদ ইসহাকের উপন্যাস বিকর্ষণ - এই শিরোনামে রিভিউটি ছাপা হয়। রিভিউতে লেখকের ভাষাশৈলী ও শক্তিশালী সংলাপ এবং তার মননশীল গভীর পর্যবেক্ষণে পাঠক হিসাবে আমার মুগ্ধতার কথা যেমন ছিল তেমনিভাবে উপন্যাসটির পরিমার্জন জনিত কিছু দৃষ্টিকটু ভুল-ত্রুটির কথাও যথাযথ ভাবে তুলে ধরে ছিলাম। এক সন্ধ্যায় বোস-কেবিনের সামনে তাকে পত্রিকার একটি কপি দিলাম। রিভিউটি পড়ে তিনি খুশি হয়ে মন্তব্য করলেন, লেখাটি সুন্দর হয়েছে। তবে দ্রুততর সময়ে তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করতে গিয়ে - এ ভুলত্রুটি গুলো হয়েছে। আগামী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে।

 


এরপর থেকে সুধীজন পাঠাগারে যখনই কোন অনুষ্ঠান হয়েছে তখনই ইসহাক ভাই আমাকে উপস্থিত থাকার জন্য দাওয়াত পত্র দিয়েছেন। দীর্ঘদিন তার সাথে আমার দেখা-সাক্ষাত নেই,  বোস কেবিনেও কম আসেন। তিনি ঢাকায় থাকেন। তার মৃত্যুর তিন-চার মাস পূর্বে একদিন দুপুরের পরে- নারায়ণগঞ্জ নতুন জজ কোর্টে মামলা শেষে তিন তলা থেকে নিচে নেমে আসছি, দেখি ইসহাক ভাই লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠছেন। তাকে সালাম দিলাম। কুশল জিজ্ঞেস করলে বললেন, একটি ব্যক্তিগত মামলার কারণে কোর্টে এসেছেন। লক্ষ্য করলাম চেহারাটা ফ্যাকাসে-রক্তশূন্য, চোখদৃষ্টিতে ক্লান্তির ছাপ, স্বাস্থ্যটাও কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে, হাসিটাও ছিল ম্লান। তার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা।


অনেকেই বলে থাকেন লেখক জীবন শ্রদ্ধাস্পদ হলেও এ পেশায় আর্থিক দৈন্যতা প্রকট। ভারতীয় অর্থশাস্ত্রের পন্ডিত চানক্য বা কৌটিল্য বলেছেন, অধিক জ্ঞানচর্চা দারিদ্র ডেকে আনে। কিন্তু লেখক সংগঠক ইসহাক ভাই সংসার জীবনে একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে যেমন, তেমনি বৈষয়িক জীবনেও একজন সফল ব্যাক্তি ছিলেন। তার ছেলেটি একজন ব্যারিস্টার হিসেবে বিদেশেই  সেটেলড হয়েছে। আর এজন্যেই একজন বিষয়ী মানুষ হিসেবে তার উপন্যাস বিকর্ষণ-এ অবলীলায় বলতে পেরেছেন, " সংসারে যারা নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, যাদের মধ্যে আপসকামীতা নেই - তারা সুখী পারে না "।


পরিবর্তনে-পরিবর্তনীয়, এই মহাজনী বাক্যটি মোহাম্মাদ ইসহাকের জীবনেও কিছুটা লক্ষ করা যায়। বই বিচিত্রা লাইব্রেরী থেকে আধুনিক মুদ্রণশিল্পের সাথে জড়িত থাকায় একদিকে তার জ্ঞানস্পৃহা পরিতৃপ্ত করেছিলেন অন্যদিকে মুদ্রণশিল্পের সাথে জড়িত থাকায় প্রকাশনা শিল্পের কলা-কৌশলের সাথে সম্যক পরিচিতি-ও লাভ করেছিলেন। আবার যথা সময়ে সেই ব্যবসা থেকে সরেও এসেছিলেন।

 


লেখক জীবনে মোহাম্মদ ইসহাকের ব্যতিক্রমধর্মী-অবিস্মরণীয় কাজটি ছিল নারায়ণগঞ্জের শিক্ষা, সাহিত্য ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তিত্বদের নামে স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনা নারায়নগঞ্জের ঘরে ঘরে যিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই স্মরণীয়-বরণীয় শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিষ্ঠাবান সাহিত্যিক-সাংবাদিক সিরাজুল হক, সাধারণ মানুষের অসাধারন রাজনৈতিক নেতা আলী আহম্মদ চুনকা, শিক্ষাক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ অধ্যক্ষ হামিদা আলী, একজন সাহসী শিক্ষায়িত্রী হিসেবে খ্যাতিমান সাবিকুন নাহার হাসমত(পরী) সহ ছয়টি স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনা তার মেধা ও মননশীলতার স্বাক্ষর বহন করছে।

 


ইসহাক ভাইয়ের প্রকাশিত কিছু গল্প প্রবন্ধ আমি বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়েছি। যে লেখাগুলোতে আবেগ-ভাবাবেগ বা কল্পনার বিচ্ছুরন কম বলে মনে হয়েছে। সম্ভবত একারণেই আবেগ, কল্পনা বা  রোমান্টিজমের বাহন কবিতা লেখা থেকে তিনি দুরেই ছিলেন।

 


একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, মানুষের জীবনটা হচ্ছে একখন্ড বরফের মতো - প্রতি মুহূর্তে গলে গলে নিঃসার হয়ে যাচ্ছে। আর জীবন প্রবাহের আর এক নাম মৃত্যু। ঐশ্বর্যময় বালাখানা এই স্বপ্নিল মায়াবী পৃথিবী ছেড়ে একদিন আমাদের সকলকেই অনন্তের পথে চলে যেতে হবে। এর হাত থেকে  কেউ পলায়ন করতে পারবেনা।


এক আধ্যাত্নিক কবির ভাষায় ঃ মুনতার্তে ঝরছে পাতা - কে জানে কার উঠছে নাম -শুদ্ধ হওয়ার সময় বা কই - মুহূর্ত পর সব তামাম। আল্লাহ ইসহাক ভাইকে জান্নাতবাসী করুন।


লেখকঃ আইনজীবী/সাংবাদিক

 

এই বিভাগের আরো খবর