
ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। হয়তো এই কারণেই ক্রিকেট এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। মূহূর্তেই রঙ বদলানো, অন্য খেলায় হয়তো এতটা হয় না! এই যেমন চট্টগ্রামের প্রথম ওয়ানডে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শুরুতে উইকেট খোয়ানো বাংলাদেশ রেকর্ডবুক ওলটপালট করে জিতেছে। মেহেদী হাসান মিরাজ ও আফিফ হোসেনের ২২৫ বলে ১৭৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটির ওপর দাঁড়িয়ে ৭ বল হাতে রেখে ৪ উইকেটের জয় তুলে নিয়েছে। যে জয় এককথায় অবিশ্বাস্য ও অতুলনীয়। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতে টস হেরে বোলিং ভালোই করেছিল তামিম ইকবালরা। আফগানিস্তানকে ২১৫ রানে অলআউট করে সহজ লক্ষ্য পেয়েছিল। কিন্তু রান তাড়া করতে নেমে দলীয় ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বসে। তবে সপ্তম উইকেট জুটিতে মিরাজ ও আফিফ দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ওয়ানডে ইতিহাসে সপ্তম উইকেটে ১৭৪ রানের জুটি গড়ে জেতার রেকর্ড নেই আর! ২০০৫ সালে ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ভারতের দেওয়া ২২১ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছিল স্বাগতিক লঙ্কানরা। ৯৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ম্যাচটা হারতে বসেছিল তারা। কিন্তু সপ্তম উইকেটে মাহেলা জয়াবর্ধনে (৯৪*) ও উপুল চন্দনা (৪৪*) মিলে অবিচ্ছন্ন ১২৬ রানের জুটি গড়েন। আর তাতেই ১২ বল আগে ৪ উইকেটে জয় নিশ্চিত করে শ্রীলঙ্কা।শুধু তা-ই নয়, আফগানদের বিপক্ষে দারুণ এই জয়ে ৪৭ বছরের পুরনো রেকর্ড নতুন করে লিখেছে তামিমরা। বুধবার বাংলাদেশের ৬ উইকেট পড়েছিল ৪৫ রানে। ৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারিয়ে সপ্তম উইকেটে অবিচ্ছন্ন থেকে একটি দলই কেবল জিততে পেরেছিল। ১৯৭৫ সালের ওই ম্যাচে ইংল্যান্ড আগে ব্যাট করে ৯৩ রানে অলআউট হয়। ৩৯ রানে ৬ উইকেট হারালেও শেষ পর্যন্ত ডগ ওয়াল্টার্স এবং গ্যারি গিলমোর মিলে ৫৫ রানের জুটি গড়ে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের বন্দরে পৌঁছান। ৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারিয়ে ছয়টি দলের জয়ের রেকর্ড থাকলেও তারা কেউই সপ্তম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ছিলেন না।
রেকর্ডময় দুর্দান্ত এক ম্যাচ উপভোগ করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারখানেক দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করলেন অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ। জয়ের নায়ক মিরাজ-আফিফকে নিয়ে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে উৎসব হয়েছে।
অথচ শুরুটা হয়েছিল ভয়ঙ্কর ভূতুরে! নিজেদের মাঠ, চেনা কন্ডিশন, ব্যাটিং বান্ধব উইকেট- সবকিছু বাংলাদেশের পক্ষে। তবু বাংলাদেশের টপ অর্ডার আফগান পেসার ফজল হক ফারুকীর গতির সামনে উড়ে যায়! দুই ওপেনার তামিম-লিটনের পর অভিজ্ঞ মুশফিক ও অভিষিক্ত ইয়াসিরকে থিতু হতে দেননি ফারুকী। মূলত পাওয়ার প্লেতেই বাংলাদেশ দল ম্যাচ থেকে অনেকটাই ছিটকে গিয়েছিল।
১২তম ওভারে ৪৫ রান দিয়ে ৬ উইকেট তুলে নেওয়া আফগানরা তখন উৎসবের অপেক্ষায়। কিন্তু সেখানে জল ঢেলে দিলেন আফিফ-মিরাজ। এই দুই ব্যাটারের ব্যাটিং যেন আফগানদের হৃদয়ে শিল হয়ে বিঁধেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আফগান ক্রিকেটারদের মুখের হাসি উধাও! ইনিংসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের টপ অর্ডারকে সাজঘরের পথ দেখিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতা ফারুকীকে বেদম মেরে ঠিকঠাক প্রতিশোধটা নিয়ে নিয়েছেন মিরাজ-আফিফ। মোহাম্মদ নবী-রশিদ খান-মুজিব উর রহমানের স্পিনে টপ অর্ডার ব্যাটারদেরই নাজেহাল হতে হয়েছে, সেখানে আফিফ-মিরাজ জুটি সহজেই খেলেছেন তাদের।
চার পান্ডবের শক্তিশালী দল নিয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চারজনই হতাশ করেছেন। কেবলমাত্র সাকিব (১০) দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। বাকি তিন ব্যাটার- মাহমুদউল্লাহ, তামিম ও মুশফিক হয়েছেন পুরোপুরি ব্যর্থ। অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে অবলীলায় আফগান স্পিনারদের খেলেছেন মিরাজ-আফিফ। প্রথম ওভারে বোলিংয়ে এসেই সাফল্য পাওয়া লেগ স্পিনার রশিদ খানকে বাকি ৯ ওভারে কোনও সুযোগ দেননি তারা। মুজিবর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। নবী পুরো ১০ ওভার বোলিং করে মিরাজ-আফিফ জুটি ভাঙতে পারেননি।
এছাড়া ৫ ওভারে ১৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট তুলে নেওয়া ফারুকী বাকি ৫ ওভারে ৩৫ রান খরচ করে ছিলেন উইকেটশূন্য। সব মিলিয়ে পুরো ১০ ওভারে ৫৪ রানে তার শিকার ৪ উইকেট। ফারুকীর শেষ ২ ওভারে বাংলাদেশের টপ অর্ডারকে ফিরিয়ে দিয়ে যে উচ্ছ্বাস ছিল, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটি উধাও হতে থাকে। ৪৬তম ওভারে ফারুকীকে দুটি দারুণ শটে চার মারলেন আফিফ। পুরো গ্যালারি তখন উৎসবে মাতোয়ারা। গ্যালারির উত্তাপও যেন প্রেসবক্সে ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিকরাও কিছুক্ষণের জন্য হয়ে গেলেন সাধারণ দর্শক!
বুধবার দুজনই ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস খেলেছেন। আগে সর্বোচ্চ ৪৫ রানের ইনিংস খেলা আফিফ পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক হাফসেঞ্চুরির দেখা। সাত নম্বরে নেমে আফিফ ১১৫ বলে ১১ চার ও ১ ছক্কায় নিজের ইনিংসটি সাজিয়েছেন। অন্যদিকে মিরাজ পেয়েছেন দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরির দেখা। ১২০ বলে ৯ চারে ৮১ রানে অপরাজিত থাকেন এই অলরাউন্ডার। দুজন মিলে সপ্তম উইকেটে গড়েন অবিচ্ছন্ন ১৭৪ রানের জুটি। সপ্তম উইকেটে ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও আদিল রশিদ সর্বোচ্চ ১৭৭ রানের জুটি গড়েন।
সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি ছিল ৮৫। ২০০২ সালে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিপক্ষে এনামুল হক জুনিয়র ও খালেদ মাসুদ পাইলট মিলে ৮৫ রান করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তবে সপ্তম উইকেট জুটির ওপর দাঁড়িয়ে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে একটি জয়ের ইতিহাস আছে সফরকারী বাংলাদেশ দলের। সেন্ট কিটসে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ ও নাঈম ইসলাম মিলে ৪৯ রানে জুটি ওরে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে চট্টগ্রামে অলৌকিক কিছুই ঘটলো। যারা মাঠে উপস্থিত ছিলেন, তাদের চোখও যেন বিশ্বাস করছিল না- কীভাবে এমন জয় ধরা দিলো? সত্যিই অবিশ্বাস্য!