শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

প্রসঙ্গঃ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনায়ক, আদালত ও সরকার

প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৭

যুগের চিন্তা ২৪ ডটকম : সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি জনাব এস.কে. সিনহা বলেছেন যে, সরকার বিচার বিভাগের কাজে প্রভান্বিত করছে। এমনি ধরনের সাহসিকতাপূর্ণ বক্তব্য তিনি ইতোপূর্বেও দিয়েছেন। মাঝখানে তিনি এও বলেছেন যে, তিনি সরকারের সাথে আর কন্টকে জড়াবেন না। বিচার বিভাগের সাথে সরকারের টানপোড়ন যাহাই হউক না কেন জনগণের শেষ আশ্রয় সরকার নয় বরং বিচার বিভাগই জাতির আশা আখ্যাংকার শেষ ভরসাস্থল। সে ভরসাস্থল নিজেই যদি কন্টকের মধ্যে থাকে অর্থাৎ প্রভান্বিত বা সরকারী হস্তক্ষেপের আওতায় পড়ে তবে জাতি দাড়াবে কোথায়? বিভিন্ন কারণে জনমনে সংসয় সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকারের মূখপেক্ষী হয়ে বিচার বিভাগকে চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে আসীন ব্যক্তিত্ত্ব (সম্প্রতি এ্যাপিলেট ডিভিশন থেকে অবসর প্রাপ্ত সরকারী ঘরনার হিসাবে চিহ্নিত) জন সম্মূখে বিচার বিভাগ প্রধানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন যা থেকে তিনি (প্রধান বিচারপতি) নিজেকে হেফাজত করতে পারেন নাই। এ অবস্থার পরেও রাষ্ট্র বা সরকারের নিকট বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব স্বাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন পড়ে না, বিবেকমান মানুষের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আরকেহ যদি বুঝে না বুঝার ভান করে থাকেন, তাদের কথা ভিন্ন। দেশে “গণতন্ত্রের” “গন” অর্থাৎ জনগণ (অর্থাৎ অসহায় জনগণ) থাকলেও এখানে “তন্ত্র” বলতে কিছুই নাই। যদি “তন্ত্র” থাকতো তবে তার একটি নিজস্ব নীতিমালা বা ব্যাখ্যা থাকতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের এখানে কোন গুরুত্ব নাই, ব্যক্তির ইচ্ছাটাই মূখ্য বিষয়। যে ব্যক্তি যখন ক্ষমতায় থাকে রাষ্ট্র যন্ত্র তাকেই তুষ্ট করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে, সেটা জনস্বার্থে হউক বা না হউক। রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রখ্যাত রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন যে, “ রাষ্ট্র এমন একটি সংঘ যা সরকারের ঘোষিত আইন অনুসারে কাজ করে। সরকার আইন ঘোষনা করে এবং কার্যকর করার শক্তির অধিকারী। ঐই শক্তির সাহায্যে সরকার নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলার বাহ্যিক ও সার্বজনীন অবস্থা বাজারে রাখে। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সর্ব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা।” ম্যাকাইভারের সংঙ্গা যদি গ্রহণযোগ্য হয় তবে “রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা।” প্রশ্ন হলো এখন রাষ্ট্র কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করছে? “সব নাগরিকের” স্থলে যদি “সরকারী সমর্থকদের” প্রশ্ন উঠে, তবে বিষয়টি ভিন্ন। কারণ কোন কথার “ব্যাখ্যা” এখন অভিধানিক বা স্বাভাবিক নিয়মে চলে না বরং তা চলছে সর্বমুন্ডের কর্তা যে কথা বললে খুশী হবেন সে ভাষাই ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে। দেশের মানুষ এখন কথা বলতে পারছে না। বিরোধী দল যাদের দায়িত্ব জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলা। তাদেরকে (বিরোধী দল) দিনে দিনে মামলা, গ্রেফতার, ক্রস ফায়ার, গুম, হত্যা, মিছিলে লাঠি চার্জ প্রভৃতির মাধ্যমে নিরব নিস্তব্দ করে দেয়া হচ্ছে। যে গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (গণতন্ত্র) আজ অসহায় ও নিরব দর্শক। ০৩/৫/২০১৬ ইং তারিখে টি.আই.বি’র মূখপাত্র সূলতান কামাল বলেছেন যে, “কথা বলতে বা মত প্রকাশ করতে না পারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। দেশের মানুষ এখন কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।” নাগরিকদের ভয়ভীতির উর্দ্ধে রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য আইন, আদালত, রাষ্ট্র যন্ত্রগুলি নাগরিকদের অর্থে লালিত পালিত হচ্ছে। “নিরাপত্তা” শুধু জানমালের নিরাপত্তা নয় বরং সংবিধানে একজন নাগরিক তার অধিকার আদায়ের জন্য যে কথা বলা দরকার, মত প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা রয়েছে তা নির্ভয়ে পালন করার অবস্থা সৃষ্টি করে দেয়াই “নিরাপত্তা।” রাষ্ট্র যন্ত্র দ্বারা নাগরিকগণ এখন নিরাপত্তাহীন। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে যা সংবিধানের শোভা বর্দ্ধন করলেও কার্যত: অধিকার বঞ্চিত সাধারণ মানুষ ফল লাভ করছে না। স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, এ সব কিছুর ফসল (out put) সংবিধান। সে সংবিধানকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এটাও verdict প্রদান করা হয়েছে যে, দেশের কোন প্রচলিত আইন যদি সংবিধানের সহিত সাংর্ঘষিক হয় তবে সংবিধানে উল্লেখিত “আইন” ই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে। জনগণ রক্ত দিয়ে যে সংবিধান রচিত করলো সে সংবিধান আজ জনগনকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন প্রবাদ সংযোযিত হয়েছে, সেটি হলো “আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র।” পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির পরেও “রাষ্ট্র নায়ক” বলে একটি পদ পদবী পোষ্টার ফেষ্ঠুনে শোভা পাচ্ছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের পাশেই সংযোজিত হচ্ছে। এ পদবী ব্যবহারে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে কোন আপত্তি করা হয় না বলে এ ব্যাপকতা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশটি এককভাবে রাষ্ট্রনায়কের ইচ্ছায় চলবে এটাইতো রাষ্ট্রযন্ত্রের চিন্তা চেতনায় থাকবে বলেই জনমনে ধারনা। ব্যক্তির ইচ্ছা যদি সকলের ইচ্ছা আখ্যাংকার প্রতিফলন না ঘটায় তবে এটাই স্বৈরতন্ত্র যার বিরুদ্ধে দেশবাসী বার বার আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে। পাক-ভারত উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নতুন মোড় নিয়েছে। তাহলো নতুন করে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির জন্য হাসিনা-মোদির বৈঠক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে অবস্থান করার আমন্ত্রন প্রভৃতি প্রভৃতি। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীকে অবস্থান করার আমন্ত্রনকে আমি স্বাগত জানাই এ জন্য যে, এতে আমার দেশ বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, কিন্তু দুঃক্ষজনক হলেও সত্য যে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ দেশবাসী (যারা সংবিধানের ৭নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রের মালিক) কিছুই জানে না। ইতোপূর্বেও জনগণের অজান্তে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যাকে এ দেশের রাজনৈতিক দল, মিডিয়া সকলেই বলেছিল “গোলামী দাসক্ষত।” জনগণ আশা করেছিল তিস্তা নিয়ে চুক্তি হবে। চুক্তি হওয়া তো দূরের কথা কবে নাগাদ হবে তারও দিন তারিখ ঠিক করা যায় নাই। বরং পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, “তিস্তাতে পানি নাই, আমি কি করবো?” অনুরূপ মন্তব্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন শিংও করেছিলেন। দেশবাসী আরো প্রত্যাশা করেছিল যে, বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের বাহিনী সীমান্তে পাখিরমত গুলি করে এ দেশবাসীকে হত্যা করবে না। কিন্তু সে ধরনের কোন কথাই উঠে নাই দু’দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনায়। শুধু আলোচনা হয়েছে বন্ধুত্ব কি ভাবে সুদৃঢ় করা যায়। বাস্তবতা এই, যে বন্ধুত্বের ফসল জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে না তা বন্ধুত্ব নয় বরং মিছরীর ছুরি। যেখানে এ সব বিষয় নিয়ে কথা উঠবে, আলোচনা পর্যালোচনা হবে সে সংসদও অকার্যকর। বাংলাদেশের অংশ বেরুবাড়ীকে ভারতের নিকট হস্তান্তরের বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা গেলেও বর্তমানে প্রেক্ষাপটে দেশবাসী আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে কি? এ সব নিয়ে চিন্তা করলে বার বার সমরাট লুই এর কথাটি দৃশ্যপটে ভেঙ্গে আসে। সম্ম্রাট লুই বলতেন ‘I am the state” অর্থাৎ আমিই রাষ্ট্র। দেশকি সে মতবাদের দিকেই এগুচ্ছে? আরো মনে পড়ে সেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের সেই সংলাপ যাহা - ‘When the soul of the king is polluted, the people of that country must suffer’. লেখক- এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার কলামিষ্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬ E-mail: [email protected]
এই বিভাগের আরো খবর