বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

না’গঞ্জে প্রথম প্রতিরোধ ২৭ মার্চ

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৭

রফিউর রাব্বি : ১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভাষণের পরদিন লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাম পত্রিকায় ‘পুরাতন পাকিস্তানের ইতি’ শিরোনামে সাংবাদিক ডেভিড লুসাক একটি প্রতিবেদনে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার সুস্পষ্ট ভবিষ্যত বাণী করেন। তখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমই বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার সংবাদটি তুলে ধরছিল। এখানে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক ব্যর্থ হলে এদেশের মানুষ বুঝে নেয় যে, পশ্চিমাদের সাথে অনিবার্য এক যুদ্ধের মুখোমুখি এসে তারা দাঁড়িয়েছে। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে সামনে রেখে দিনটি বিভিন্ন দল বিভিন্নভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকরে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরোধ দিবস, ভাষানী ন্যাপ স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস, জাতীয় লীগ স্বাধীন বাংলাদেশ দিবস, কৃষক শ্রমিক পার্টি লাহোর প্রস্তাব দিবস ইত্যাদি। ঐদিন ভোর ৫টায় বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পাতাকা উত্তোলন করেন। ঐদিন এ দেশের বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এখানে অবস্থানরত বিভিন্ন দুতাবাসও ঐদিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। টেলিভিসনে ঐদিন পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শিত হয় নাই। ঐ দিনটি সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের  কুখ্যাত জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেছেন, ‘২৩মার্চ ছিল শেখ মুজিবের আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক দিন। পাকিস্তান দিবসটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পারন করতো। অথচ শেখ মুজিব দিনটিকে ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেছিল।’ সে দিন থেকেই মূলত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জে ২৫ মার্চ সকালে তৎকালীন ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি দল নারায়ণগঞ্জ কোর্টে অবস্থিত মালখানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যান। মালখানার বাঙালী কর্মকর্তারাও সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন। তারা ছাত্রদের বলেন, আমরা তোমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারবো না, তবে তোমরা লুট করে নিয়ে যাও আমরা বাধা দেব না। ছাত্ররা মালখানা ভেঙ্গে সেখান থেকে ১২১টি রাইফেল ও ৬ পেটি গুলি সংগ্রহ করেন। অস্ত্রগুলো দেওভোগ জনকল্যাণ সমিতিতে জমা রাখা হয়। ঐদিন বিকেল থেকেই তাঁরা নাগবাড়ি মাঠে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ছাত্রদের সাথে যোগ দেন সাধারণ জনতা। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ হলে ২৬ মার্চ সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে- যেকোন সময় পাক হানাদার বাহিনী এখানে চলে আসবে এবং এখানেও তারা হত্যাযজ্ঞ চালাবে। তখন প্রস্তুতি শুরু হয় ব্যারিকেড স্থাপনের। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে আলীগঞ্জ, পাগলা, ফতুলা ও নারায়ণগঞ্জের সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করা হয়। আলীগঞ্জ, পাগলা, ফতুলায় বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। রেল ষ্টেশন থেকে ওয়াগন এনে চাষাঢ়া ও ২নং রেল লাইনের উপরে রাখা হয়। তখন মন্ডলপাড়া ও সলিমুলাহ রোডের ২টি কারখানায় ১টি চিনি কলের জন্য ট্রলি তৈরী হচ্ছিল। ছাত্ররা সেই ট্রলিগুলো এনে রাস্তায় ফেলে ডায়মন্ড হল মোড় থেকে চাষাঢ়া রেললাইন পর্যন্ত ব্যারিকেড তৈরী করে। ছাত্র-জনতা ফতুলা থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত রেল লাইনের ¯িপার তুলে ফেলে; যাতে রেল পথেও পাক বাহিনী নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে। ঐদিন দুপুর থেকেই নারায়ণগঞ্জবাসী শহর ছাড়তে শুরু করে। ২৭ মার্চ ভোর রাতে পাক বাহিনী ট্যাংক, কামান ও আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে রওনা হয়। তারা ব্যারিকেড তুলে তুলে আস্তে আস্তে নারায়ণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রহমতউলা ক্লাব তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। সকাল ১০ টার দিকে ক্যাম্পে খবর আসে পাক সেনারা নারায়ণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পাক বাহিনী ঢাকার টিকাটুলি থেকেই গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাগলা অঞ্চলে প্রথমে তারা এক নাইট গার্ডকে হত্যা করে। সকাল ১১টার দিকে পাক বাহিনী পঞ্চবটীর কাছাকাছি চলে আসে। এদিকে সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি গ্রুপ মাসদাইর কবরস্থানের কাছে অবস্থান নেয়, একটি গ্রুপ মাসদাইর খায়ের সাহেবের বাড়ীর কাছে ও অপর গ্রুপটি চাঁদমারী টিলাতে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে ছাত্রদের একটি দল অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের সংগ্রহে থাকা বন্দুক, পিস্তল রহমতউলা ক্লাব ক্যাম্পে এসে জমা দিতে থাকে। বহু পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য তাঁদের অস্ত্র দেশের যুদ্ধের জন্য ক্যাম্পে এসে জমা দিয়ে জান। একদিকে ট্যাংক কামান ও ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনী অপরদিকে শুধু রাইফেল আর দোনালা বন্দুক নিয়ে তাদের প্রতিরোধের জন্য ছাত্র-জনতা। পাক বাহিনী পঞ্চবটী থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে কবরস্থানের কাছে অবস্থান নেয়া গ্রুপটি অতর্কিতে পাক বাহিনীর দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে একজন পাক সেনা গুলিবিদ্ধ হলে পাক বাহিনীর একটি জীপ তাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পাক সেনারা সেখানেই থমকে যায় এবং ট্যাংক সামনে রেখে জীপ থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ছাত্রদের গ্রুপটি পেছনে হটতে থাকে এবং চাষাঢ়া এসে অবস্থান নেয়। পাক বাহিনী গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। বিকেল ৩টার দিকে তারা মাসদাইর এলাকায় পৌঁছে গানপাউডার দিয়ে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়িঘর থেকে ধরে এনে গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ সাধারণ মানুষকে। তারা এম.এ ছাত্তারের (পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা) জেষ্ঠ্য পুত্র তৌফিক সাত্তার ও তৌফিক সাত্তারের বন্ধু জালালকে হত্যা করে। মাসদাইরে জামিরুল হকের বাসায় ঢুকে তাঁকে সহ তাঁর পুরো পরিবারকে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী বাসায় ঢুকে হত্যা করে আব্দুস সাত্তারকে ও তাঁর বাড়ির দারোয়ানকে। মসজিদ পবিত্র স্থান, এখানে পাক সেনারা হামলা করবেনা ভেবে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে অনেকে মাসদাইরে ‘হানজত আলীর মসজিদ’ নামে একটি মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেন। হানাদার বাহিনী বুট জুতা পায়ে সে মসজিদে ঢুকে ভেতর থেকে ১৫/১৬ জনকে ধরে এনে বাইরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে তাঁদের হত্যা করে। এখানে শহীদ হন ব্যাংক কর্মকর্তা শরিয়তউলাহ (পিতা-আশেক আলী মাতব্বর), জসিমউল হক ও তার স্ত্রী লায়লা হক, মোঃ জিন্নাহ (পিতা-পাগলা বাদশা), ফটিক মিয়া (পিতা-বেলায়েত আলী), ফকির চাঁন (পিতা-শ্যামা মুন্সী), সাচ্চু মিয়া (পিতা-সামসুল হুদা), ড্রাইভার নুরুল ইসলাম, বেলায়েত হোসেন, উত্তর মাসদাইরের ওমর আলী, আব্দুস সাত্তার নামে আরও এক জন। তারা অবাঙ্গালী দুই সহোদর আলী আক্তার ও আলী আহাম্মদ কে হত্যা করে। বাড়িঘরে দাউ দাউ আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনে পুড়ে শহীদ হন সমিরউদ্দিন সারেং এর স্ত্রী তাহেরুন্নেছা। ঐদিন পাক বাহিনী শহরে প্রবেশ না করে রাতে নারায়ণগঞ্জ সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। আর এ সময়ের মধ্যে শহরের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শহর ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। ২৮ মার্চ পাক বাহিনী পূনরায় আক্রমণ শুরু করে। সকাল প্রায় ১০টার দিকে তাদের একটি দল পশ্চিম দিক থেকে চাষাঢ়া ও অন্য একটি দল চাঁদমারী ঘুরে আক্রমনে এগিয়ে আসে। দুইদিকের আক্রমনে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ দলটি পেছনে হঠতে থাকে। পাক বাহিনী বেলা ১২টার দিকে চাষাঢ়া অতিক্রম করে শহরে প্রবেশ করে। মূল সড়ক দিয়ে চলতে চলতে তারা নিতাইগঞ্জ পুলে এসে অবস্থান নেয়। পথে যেতে তারা দুইপাশের ভবন বাড়িঘর মেশিনগান ও কামানের গোলায় ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। তারা প্রেসিডেন্ট রোডের মোড়ে পাকবে ভবন, হাজেরা কুটির, পৌরসভা অফিস কামানের গোলায় ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। ঐ রাতেই তারা ছাত্রদের পরিচালিত ক্যাম্প রহমতউলা ক্লাব, দেওভোগের সমাজ উন্নয়ন ক্লাব সহ বহু বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর নারায়ণগঞ্জে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। নৃশংস সে হত্যাযজ্ঞ চলে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তথ্যসূত্র ঃ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার। নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব / আবদুল মান্নান। বাংলাপিডিয়া, খন্ড ৮। মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ / রীতা ভৌমিক। তথ্যসহায়তা / হাসান জাফরুল বিপুল। ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
এই বিভাগের আরো খবর