শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সরকারের আগামীর লক্ষ্য অপুষ্টি দূর

প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৭

যুগেরচিন্তা২৪.কম: স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের চ্যালেঞ্জ ছিল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। বর্তমান দেশ সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার মাধ্যমে বর্তমানে সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা’। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক এ বিষয়ে বলেন, দেশ থেকে অপুষ্টি দূর করার প্রতি সরকার বিশেষভাবে জোর দিচ্ছে। কারণ সরকার বিশ্বাস করে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করতে হলে সবার আগে পুষ্টিহীনতা দূর করতে হবে। সেক্ষেত্রে মা ও শিশুদের প্রতি বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টিই পুষ্টি সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনকি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও (এমডিজি) অপুষ্টির সমস্যা সমাধানের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রশংসিত হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দরিদ্রতা ও অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় বাংলাদেশকে ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড দেয় জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। কিন্তু অপুষ্টি বাংলাদেশ থেকে এখনো বিতাড়িত হয়নি। উল্টো অপুষ্টি এখনো দেশের অন্যতম সমস্যা। এমনকি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে পরিকল্পনা রয়েছে, সে জন্য সরকারকে অপুষ্টি দূর করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের শিশুদের একটি বড় অংশ অপুষ্টির শিকার। এই অপুষ্টির কারণে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় বাংলাদেশের। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ৮০ টাকা) এর পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা। অপুষ্টি দূর করতে সরকার কয়েকটি প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর সঙ্গে আরো কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- অপুষ্টি দূর করতে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান চালানো, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন, প্রাণিজ ও আমিষ জাতীয় খাদ্য উৎপাদনের প্রতি জোর দেওয়া প্রভৃতি। এরই মধ্যে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইশতেহার প্রায় চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এবার দলটির আগামীদিনের কর্মসূচিতে গুরুত্ব হিসেবে ধরা হচ্ছে ব্লু ইকোনমি। পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ দেশ থেকে অপুষ্টির চিরতরে দূর করা। জানা গেছে, এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী একেকটা ধাপ শেষ করে পরবর্তী ধাপে পা দেওয়া হচ্ছে। স্বল্প সুদে পর্যায়ক্রমে দুগ্ধ খামারিদের ২শ’ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে নতুন পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এসব পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ডেইরি শিল্প বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এমনকি আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটেও বিষয়টিতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের মতো বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে আগামী বাজেটেও বরাদ্দ দেওয়া হবে। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়া দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য প্রতিবন্ধক। এ ছাড়া অপুষ্টিও আমাদের অন্যতম সমস্যা। এ দুটি সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। ক্ষুদ্র চাষিরা দেশে দুধ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড় আকারে ডেইরি ফার্ম গড়ে ওঠেনি। তাই, ক্ষুদ্র চাষিদের শ্রম কাজে লাগিয়ে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রাণিসম্পদ প্রজাতি উন্নয়নের প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে।। এমনকি দেশব্যাপী ১শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। এসব অঞ্চলগুলোতে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্যও নির্দিষ্ট স্থান রাখার সিদ্ধান্ত রেখেছে সরকার। এসবই খাদ্য চাহিদা পূরণ এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণে সরকারের কার্যক্রমের অংশ। সেভ দ্য চিলড্রেনের উপদেষ্টা ডা. গোলাম মোতাব্বির বলেন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে শিশুদের পুষ্টিহীনতার হার ছিল ৬৬ শতাংশ। ২০১০ এর এক জরিপ অনুযায়ী তা কমে ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অনুযায়ী যতটা অগ্রগতি হবার কথা ছিল সেই হিসেবে এই অগ্রগতি যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে আরো দ্রুত গতিতে এগুতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে মানুষের অপুষ্টি দূর করা এখনো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৪ অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৩৬ শতাংশের উচ্চতা ও ৩৩ শতাংশের ওজন বয়সের তুলনায় কম, আর ১৪ শতাংশ কৃশকায়। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে শিশুরা খর্বকায় ও কৃশকায় হয়, তাদের ওজন হয় বয়সের তুলনায় কম। অপুষ্টির শিকার হলে শিশু বয়সের তুলনায় খাটো, ওজনে কম, শুকনো ও অপুষ্ট হয়। তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকরা আরো বলছেন, অপুষ্টির শিকার শুধু পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাই নয়; পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী, প্রসূতি, এমনকি পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষদের মধ্যেও অপুষ্টি রয়েছে। পরিণত বয়সের আগেই মা হয়েছেন, এমন নারীদের মধ্যে অপুষ্টির হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি। মায়েদের অপুষ্টির কারণে নবজাতক ও দুগ্ধজাত শিশুদেরও পুষ্টির অভাব ঘটে। যদিও দারিদ্র্য হ্রাস, সম্পদ বৃদ্ধি ও শিক্ষিত মা-বাবার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ার ফলে গত এক দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর গতি অত্যন্ত ধীর। তাছাড়া অপুষ্টির কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে, যেগুলো দূর করতে হলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বণ্টনব্যবস্থার বৈষম্য কমাতে হবে। জনগোষ্ঠীর সব অংশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপুষ্টি সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক বলেন, দেশ থেকে অপুষ্টি দূর করতে সরকার বদ্ধপরিকর। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। দুধের ঘাটতি পূরণে সরকার বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৪৫ শতাংশ আসছে পোল্ট্রি খাত থেকে। আগামীতে এ সংক্রান্ত কর্মসূচির সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে।
এই বিভাগের আরো খবর