শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মোদের গরব মোদের আশা || রাহাত খান

প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

যুগেরচিন্তা ২৪.কম: ১৯৭৬ সালের ঘটনা। সাংবাদিকতায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে পশ্চিম জার্মানির বার্লিনে গিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ নিতাম বিশ্বখ্যাত ‘ইন্টারন্যাশনাল ল ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম’ শিক্ষায়তনে আর সেখানে ১১টি দেশ থেকে আগত (এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার) বিদ্যার্থীর সংখ্যা ছিল ২১ জনের মতো। ছেলেমেয়ে সবাই যুববয়সী। একসঙ্গে বাস করতাম আমরা। ভারত থেকে গিয়েছিল দুজন, তাদের একজন তরুণ বসু, বাঙালি হলেও দুই পুরুষ থেকে দিল্লিতে বাস করছে। আমি ও তরুণ সুযোগ পেলেই বাংলায় কথা বলতাম। একদিন দুজনে শিক্ষায়তনের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেখানকারই তৃতীয় কর্মকর্তা মিস হোফট যে আমাদের কথা শুনছিলেন তা আমরা কেউই লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ মিস হোফট আাদের দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, আমরা দুজন কোন ভাষায় কথা বলছি?পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের আটানব্বই ভাগ লোক বাংলায় কথা বলে, এ ধারণা সূত্র দিয়ে মিস হোফটকে জানালাম, আমরা বাংলায় কথা বলছি। মুগ্ধ ও বিস্মিত মিস হোফট জানালেন, বাংলা ভাষা এমন ধ্বনিময়, শুনতে এমন মধুর লাগে-এ সম্পর্কে তার আগে কোনো ধারণাই ছিল না।মিস হোফটের কথা শুনে খুব খুশি হই দুই দেশে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী দুই যুবক। তরুণ বসু গেয়ে ওঠে- মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। তরুণের বোধ হয় ভাঙা বেসুরো গলায় আরো বেশ কিছুক্ষণ বাংলা গানের সর্বনাশ করার ইচ্ছা ছিল। বাঙ্গালের (আমি) চোখে অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে দেখে বেশ দুঃখিত হয়ে সংগীত চর্চার ইতি টানে তরুণ। তবে বাংলা ভাষা সম্পর্কে মিস হোফটের উক্তি আমাদের দুজনকেই খুব গর্বিত ও উদ্দীপ্ত করেছিল। এতদিনেও তা স্পষ্ট মনে আছে। ভাষা হিসেবে বাংলার এই গুণ, মাধুর্য বহু বিদেশীকে মুগ্ধ করে; হাজার বছর ধরেই করে আসছে। সম্ভবত বিখ্যাত ইতিহাসবিদ সুখময় মুখোপাধ্যায়ের একটি বইতে পড়েছিলাম, ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে দিল্লীর মোগল সম্রাট বাবর বাংলার উপপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, বিহারের বৃহদাংশ অধিকার করার পর বঙ্গ দেশটিও জয় করে নেয়ার আশায়। বাবর ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। তুর্কি ভাষায় এ যাবৎকালের সেরা কবি ও গদ্য লেখকদের একজন বলে গণ্য করা হয় তাকে। বাংলা ভাষার ধ্বনি মাধুর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। তখন বঙ্গদেশে (রাজধানী গৌড়) চলছিল হাবসীদের রাজত্ব। ছয় বছরে আটজন হাবসী সুলতান ছয়মাস থেকে এক বছরের স্থয়ীত্বে রাজত্ব করছেন। একজনকে খুন করে আরেকজনের সিংহাসন দখর করে সুলতান হওয়ার ভয়াবহ রক্তারক্তি কাণ্ড চলছিল তখন। সব দেখেশুনে বঙ্গদেশের উপপ্রান্ত থেকে পাততারি গুটিয়ে দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন বাবর। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আগে পর্যন্ত বঙ্গদেশ ছিল মোগলদের অধরা। তবে মোগলদের আগে পাঠান এবং পাঠানদের আগে গুপ্ত, বৌদ্ধ ও সেন রাজারা বঙ্গদেশের একাংশ বা বৃহদাংশ জয় করে এদেশেই পুরুষানুক্রমে রাজত্ব করে গেছেন। অনেকে বাঙালির ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে লীন হয়ে গেছেন, মূলত ভাষার (বাংলা) মাধুর্যের কাছেই আত্মসমর্পণ করে।কে জানে বঙ্গদেশে মোগলদের শাসনামলে মনে-প্রা্ণে এদেশী হয়ে যাওয়া ব্যক্তি বাঙলা ভাষার চর্চা করেছেন! শের আফগানের স্ত্রী, ‘ইরানি বুলবুল’ নূরজাহানও বাংলা সংগীত এবং বাঙালি সামাজিকতা ও আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন কিনা কে জানে! নূরজাহান কবিতা গান (গজল) লিখতেন আর হাজার বছর ধরে বাংলা তো কবিতা ও গানেরই ভাষা।তবে সেটা বাংলা ভাষার বহু স্বভাব বৈশিষ্টের একটি মাত্র। বাংলা যেমন নম্র, কোমল ধ্বনি মাধুর্যের ভাষা তেমনি বজ্র কঠোর উচ্চারণ সংগ্রাম ও গণযুদ্ধের ভাষা। ১৯৫২ সালেল ৮ ফাল্গুন ইংরেজি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার পক্ষে, ভাষার দাবিতে বাঙালির গণবিস্ফোরণ বিশ্ববাসী দেখেছিল অবাক বিস্ময়ে। বাংলা ভাষা মননশীল বাঙালি জাতির নিজ সত্তার কাছে এক হয়ে মিশে গেছে। জয়তু বাংলা ভাষা।
এই বিভাগের আরো খবর