বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চৈত্রসংক্রান্তির পার্বণে দুয়ারে কড়া নাড়ছে পহেলা বৈশাখ

প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৭

যুগের চিন্তা ২৪ ডটকম : ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, মুছে যাক গ্লানী’ বিদায়ী সূর্যের কাছে এ প্রণতি। আজ ৩০ চৈত্র, ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। চৈত্র সংক্রান্তি। গ্রীষ্মের আগমনে নতুন এক বছরকে আগমনের শুভেচ্ছা জানাতে আয়োজন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তির। পূর্ব দিগন্ত থেকে ছুটে আসা ভোরের নরম আলো রাঙিয়ে দেবে পৃথিবী, স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনায় সূচিত হবে নতুন বছর। পুরোনো বছরকে বিদায় আর নতুনকে বরণ করে নিতে নগরীতে চলছে নানা রকমের প্রস্তুতি। এই দিনটিকে আনন্দের সাথে বিদায় জানাতে উঠান থিয়েটারের আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তির আলোর ভাসান ৪র্থ আবর্তন অনুষ্ঠিত হবে। তাদের এবারের স্লোাগান “রক্ত জবার লাল, জ্বলে উঠবেই প্রতিকুল তীরে”। বাংলা বছরের সমাপনী মাস চৈত্রের শেষ দিনটিকে ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ বলা হয়। নানা আয়োজনে আজ যখন চৈত্রসংক্রান্তির পার্বণ, তখন একই সঙ্গে দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। নতুন বছর ১৪২৪-কে স্বাগত জানাতে পুরো বাংলাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জে ও চলছে নানা রকমের আয়োজন। প্রকৃতির নিয়মে বাংলার ঋতুচক্রের পালাবদলে আসে গ্রীষ্ম উষ্ণতা নিয়ে প্রখর তপন তাপে আকাশ তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠে। মানব মনও তৃষিত হয় প্রকৃতিকে বরণ করে নিতে স্মরণ করতে। এরিই মাঝে চৈত্রের যাই যাই রব। বাংলা বছরের সমাপনীমাস চৈত্র। চৈত্র’র শেষ দিনটিকে চৈত্র-সংক্রান্তি বলা হয়। আমাদের লোকাচার অনুযায়ী এদিনে বিদায় উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। যা বাঙ্গালী জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। চৈত্র-সংক্রান্তির দিনের সুর্যাস্তের মধ্য দিয়ে নতুন এককালের আগমন ঘটবে। বাংলাদেশের মানুষ সহ অবস্থানে বসবাস করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে তাই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সমাজবদ্ধ আচার অনুষ্ঠান একইসাথে পালন করে থাকে। বাঙ্গালী এই দিনটিতে বেশকিছু লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। যেমনÑ গজল, নীল পুজা বা চড়ক পুজা, চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা, শেষ প্রস্তুতি চলে হালখাতার। ঠিক একই সময় আদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে বর্ষবিদায়, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসাবি। যে চৈত্র-সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীর এত আয়োজন এবার আমরা দেখব চৈত্রের আদি ইতিহাস। বাংলা সনের শেষ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নামানুসারে। আদি গ্রন্থ পুরাণে বর্ণিত আছে, সাতাশটি নক্ষত্র আছে যা রাজা দক্ষের সুন্দরীকন্যার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। প্রবাদতুল্য সুন্দরী এই কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তায় উৎকণ্ঠিত রাজা দক্ষ। উপযুক্ত পাত্র কোথায়? যোগ্যপাত্র খুজে পাওয়া কি সহজ বিষয়? যোগ্যপাত্র পাওয়া না গেলে কি অনূঢ়া থেকে যাবে তারা? না, বিধির বিধানে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল। একদিন মহাধুমধামে চন্দ্রদেবের বর সাথে বিয়ে হলো দক্ষের সাতাশজন কন্যার। দক্ষের এককন্যা চিত্রার নামানুসারে চিত্রানক্ষত্রা এবং চিত্রানক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। রাজা দক্ষের আরেক অনন্য সুন্দরী কন্যা বিশখার নামানুসারে ‘বিশখা’ নক্ষত্র এবং ‘বিশখা’ নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ মাসের নাম করণ করা হয়। বলে রাখিÑমাস হিসাবে বৈশাখের প্রথম হবার মর্যাদা খুব বেশী দিনের নয়। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেখানেও বৈশাখের সন্ধান মেলে। বৈদিক যুগের সে তথ্যানুযায়ী বৈশাখের স্থান ছিল দ্বিতীয়। তৈত্তিরীয় ও পঞ্চবিংশ ব্রাক্ষ্মণের মতে বৈশাখের অবস্থান ছিল বৎসরের মাঝামাঝি জায়গায়। অন্যদিকে ব্রক্ষ্মামন্ড। পুরাণে অনুষঙ্গপাদের একটি স্লোক অনুসারে মাসচক্রে বৈশাখের অবস্থান ছিল চতুর্থ। তখন বাংলা সন বলতে কিছু ছিলনা। ছিল ভারতীয় সৌরসন গণনা পদ্ধতি। মোঘল সম্রাট আকবর ‘সুবে বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ফসল কাটার মৌসুম অনুসারে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে নতুন একটি সনের প্রবর্তনের জন্যে অনুরোধ করেন বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও পন্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ্ সিরাজীকে। সিরাজী হিজরী চন্দ্রমাসের সঙ্গে স¤্রাটের সিংহাসনের আরোহোনের বছর এবং ভারতীয় সৌরসনের সমন্বয়ে বাংলাসনের প্রবর্তন করেন। মাসের নামগুলো সৌরমতে রেখেই পূর্ণবিন্যাস করেন তিনি। সে অনুযায়ী বৈশাখ বাংলা সনের প্রথমে চলে আসে। বছর শেষ তাই শেষ দিনটিকে আনন্দের সাথে বিদায় দিতেই আয়োজন  চৈত্র সংক্রান্তির। চৈত্র সংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ গাজন। গাজন একটি লোকউৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসবের সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতাদের নাম। যেমন- শিবের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি। এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পতœীরূপে কল্পিত পৃথিবীতে বিবাহ দেওয়া। গাজন উৎসবের পিছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচন্ড উত্তাপ থাকে তখন  সূর্যের তেজ  প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যজনক বলে মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এই উপলক্ষে একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজেনৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে। এ সময়ে শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লে¬খ থাকে। এই মেলাতে সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছের ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধরণের খেলা একেবারেই কমে গেছে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বাঁশ, বেত, প¬াস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরী বিভিন্ন ধরণের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল-ফলাদি ও মিষ্টি ক্রয়-বিক্রয় হয়। বায়াস্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। অঞ্চলভেদে এই মেলা তিন থেকে চারদিনচলে। বাঙালী এ দিন চৈত্র সংক্রান্তি পালন করে থাকে সেদিন আদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে থাকে তাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরন অণুষ্ঠান-বৈসাবি ।
এই বিভাগের আরো খবর