মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মহান মে দিবস, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষ্ময়কর উপাখ্যান

প্রকাশিত: ১ মে ২০১৭   আপডেট: ১ মে ২০১৭

যুগের চিন্তা ২৪ ডটকম : ১৮৮৬’র ১ মে। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে জড়ো হয়েছিল অনাহারক্লিষ্ট, অতি পরিশ্রমের ভারে শিরদাড়া বাঁকা হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কারখানার প্রাণিগুলো! প্রাণিগুলো এ অর্থেই বলছি উৎপাদন আধুনিক হলেও মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাবার আইনি স্বীকৃতি তখোনো অর্জিত হয়নি ‘মজুরি দাস’দের। পিঁপড়ার মতো দলে দলে এসে মিলিত হলো ১ মহাসমুদ্রের। শুরু হলো ঐতিহাসিক শ্রমিক সমাবেশ। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ একে একে বক্তৃতা করতে লাগলেন। সম্মিলিত কন্ঠে ঘোষণা হলো “৮ ঘন্টা কাজের বিনিময়ে বাঁচার মতো মজুরি, ৮ঘন্টা বিশ্রাম, ৮ ঘন্টার ব্যক্তি স্বাধিনতা।” তাদের অনুপ্রেরণা ছিল দাসপ্রথা উচ্ছেদ বিরোধী সংগ্রাম, আমেরিকার জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম (১৭৭৫-১৭৮৩)। ১৮৫৫ সালের শিকাগো শহরের নারী শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলন ১৮৭১ সালের ফ্রন্সের শ্রমিক শ্রেনীর নেতৃত্বে প্যারি কমিউন। চলতে থাকা ধর্মঘটে ৩ মে মালিক গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক সমাবেশে বোমা বিস্ফোরন ঘটায়। এ সন্ত্রাসী হামলায় পুলিশসহ ১০/১২ জন নিহত হয়। শুরু হয় গুন্ডা বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশি হামলা গ্রেফতার। হত্যা মামলা হয় শ্রমিকনেতাদের নামে। মার্কিন আদালতে প্রহসনমূলক বিচারে  অগাষ্ট স্পাইজ, ফিসার, এঙ্গেল, পারভীন এই ৪ নেতার মৃত্যুদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে অগাস্ট স্পাইজ দৃপ্তকন্ঠে বললেন “আমাকে তোমরা শ্বাস রোধ করতে পারো কিন্তু আমার কন্ঠ কে নয়। শ্রমিক বিক্ষোভে জ্বলে উঠে আমেরিকা এমনকি ইউরোপও। ১৮৯১ সালে ২য় কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসে ১ মে কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের শিল্প শ্রমিকদের কি অবস্থা ? ১৯৭১ সালে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধিনতা। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রমজীবি মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে সামনের কাতারে ছিল। পুরো পাকিস্তান পর্বে পাঞ্জাবী শাসকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রত্যেক সংগ্রামে কারখানা শ্রমিকরা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বৈরশাসক আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে আদমজী টঙ্গি তেজগাঁওয়ের শ্রমিকরা অভুতপূর্বভাবে কারখানা ধর্মঘট ও ঘেরাও আন্দোলন শুরু করে । স্বাধীন দেশে আমরা ভেবেছিলাম শ্রমিকদের দূর্দশার লাঘব হবে। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি পাব। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। নতুন শাসকরা শিল্প শিল্পের জাতীয় করনের কর্মসূচী দিয়ে জাতীয় লুটপাটের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত করার যাত্রা শুরু করলেন। জাতীয় নূন্যতম মজুরীর প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের বয়স ৪৬ পার হলেও আজো কোন সরকার জাতীয় নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করেনি।  ২০১১ সালের অর্থ মন্ত্রনালয়ের অর্থনৈতিক সমিক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশের শ্রমখাতে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৫ কোটি ৭ লাখ, ২ কোটি ৩৩ লাখ কৃষি শ্রমিক, ৮২ লাখ হোটেল রেস্তারার শ্রমিক, ৭২ লাখ কারখানা শ্রমিক, ৪৫ লাখ পরিবহণ শ্রমিক, ২১ লাখ নির্মাণ শ্রমিক। এই বিপুল অংশের শ্রমজীবী মানুষের নূন্যতম মজুরি নাই! অথচ তাদের শ্রমের উপর বাংলাদেশের অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তায় রাষ্ট্র বাধ্য। বৈশ্বিক শ্রমখাত হিসেবে ৮০‘র দশকে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠে। বর্তমানে ৪৪ লাখ শ্রমিক এ খাত যুক্ত আছে যাদের অধিকাংশ প্রায় ৮০% নারী শ্রমিক। এই খাতেও চলছে শ্রম লুন্ঠনের অবাধ প্রক্রিয়া। মজুরি, ছাঁটাই, ট্রেড ইউনিয়ন, অধিকার সহ নানাবিধি সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। এমনকি শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তাও প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে। তাজরিন, রানাপ্লাজা সহ গার্মেন্টস অব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার শ্রমিক হত্যা ও খুনি মালিকের বিচার না হওয়ায় স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে। রাষ্ট্রের পক্ষে পক্ষপাত মূলক আচরণে মজুরির দাবিসহ শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলে ক্ষমতাসীন দলীয় বাহিনী রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর নির্মম নির্যাতন চললেও খুনি মালিকরা জামাই আদরে থাকে।  তার কি কারণ? মজুরি বাড়লে কার লাভ কার ক্ষতি? শুধু গার্মেন্টস খাতের দিকেও তাকাই দেখব বর্তমানে যে ৪৪ লাখ শ্রমিক তাদের পরিবার হিসেব করলে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখের কাছাকাছি। শ্রমিক মজুরি বাড়া মানেই এই দেড়কোটি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া। তারা বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আগে যা কিনতো ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে আরো বেশি পরিমাণ কিনবে। মাছ, মাংস, ডিম, থেকে শুরু করে বছরে প্রত্যেক ১ জোড়া করে জুতা ও যদি বেশি কিনে তাহলে দেড় কোটি নতুন জুতার তৈরির চাহিদা বাড়বে। একইভাবে শার্ট, প্যান্ট, শাড়ী,লুঙ্গি বার্মিজ ইত্যাদির জন্য কতগুলি নতুন দেশিয় কারখানা তৈরি করতে হবে। আরো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে নতুন কর্মসংস্থান হবে। এই কারখানাগুলোর মালিকও নিশ্চই শ্রমিক হবেনা অন্তত যতদিন রাষ্ট্র ক্ষমতা তারা দখল করতে না পারবে। আর এভাবেই উৎপাদনশীলতা বাড়ে। জাতির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মালিকের মুনাফা যদি বাড়তে থাকে আমরা বর্তমানেই দেখি প্রায় ৪ হাজার মালিক। অনেক গার্মেন্টস মালিকই কানাডায় বেগম পাড়া করেছেন। অনেকেরই ইউরোপ আমেরিকায় সন্তান পড়াশুনা করছে। সাধারণ চিকিৎসার জন্যও বিদেশ যাচ্ছেন। ঈদের উৎসবে বিদেশে ঘুরে দেশেরই টাকা খরচ করছেন। তাদের ঘরের আসবাবপত্রও বিদেশী। দেশজ অর্থনীতিতে তাদের এই ভূমিকা। দেশের প্রধান ১টি দৈনিক পত্রিকা ২০১৬ সালের ৮ মাসের ১টি হিসেবে দেখিয়েছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১ লক্ষ কোটি টাকার উপর পাচার হয়েছে। এই টাকা কারা পাচার করছে? শ্রমিক না মালিক? বর্তমান মহাজোট সরকার প্রায় ৪ লাখ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুন করেছেন। কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়তো যৌক্তিক। প্রধানমন্ত্রীর বেতন ৬০ হাজার থেকে বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক খেতমজুর তাদের ব্যাপারে সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মজুরি নির্ধারণের বিষয়টিকে পাশ কাটিয়েছেন। রাষ্ট্র বার বার প্রমাণ রেখেছেন আইন সবার জন্য সমান নয়। মালিকরা আইনের উর্ধ্বে। সুতরাং এমন একটি শ্রমিক শিল্প স্বার্থ বিরোধী সরকার আইন সংখ্যা গড়িষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণির উপর জেঁকে বসে আছে। তাকে বদলানো দরকার। ইতিহাস স্বাক্ষী পরিবর্তনই হচ্ছে অপরিবর্তনীয় সত্য। ১৮৮৬ সালে রক্তে অর্জিত মহান মে দিবসই শ্রমিকদের দাবী আদায়ের নতুন পথ দেখায়। লেখক- অঞ্জন দাস আহ্বায়ক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি নারায়ণগঞ্জ জেলা।
এই বিভাগের আরো খবর